আগুন থেকে যেভাবে প্রাণে বাঁচলেন নার্সিং ছাত্রী মুক্তা

ছাত্রী মুক্তা আক্তার
ছাত্রী মুক্তা আক্তার  © সংগৃহীত

সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে বেঁচে ফিরেছেন ঢাকার নাইটিঙ্গেল নার্সিং অ্যান্ড মেডিকেল ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী মুক্তা আক্তার। তার সাথে থাকা পরিবারের আরও ৪ জন বেঁচে ফিরেছেন। হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা। লঞ্চে আগুনের সেই বীভৎস অভিজ্ঞতা নিয়ে বলেছেন মুক্তা আক্তার।

মুক্তা আক্তার বলেন, সেই রাতে লঞ্চের স্টাফরা সবাই ঘটনা আঁচ করতে পেরে লঞ্চ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কূলে উঠে যান। কেউ আগুন নেভানোর জন্য ন্যূনতম চেষ্টা পর্যন্ত করেননি। আগুনের সূত্রপাত থেকে যদি নেভানোর চেষ্টা করা হতো তাহলে এত মানুষের মৃত্যু হতো না। অথচ শেষ সময়ে গ্রামবাসী অসংখ্য মানুষকে বাঁচিয়েছেন।

আরও পড়ুন: মায়ের পরামর্শে প্রাণ বাঁচল সাতার না জানা জবি শিক্ষার্থীর

তিনি বলেন, কলেজ বন্ধের ছুটিতে বড় বোন, বোনের ১০ বছর ও ৬ মাসের দুই সন্তান এবং চাচাতো বোনকে নিয়ে ঢাকা থেকে বরগুনা যাচ্ছিলাম। আমরা লঞ্চের দ্বিতীয় তলার ডেকে সিট নিই। যেখানে বসে ছিলাম সেখান থেকে লঞ্চের ইঞ্জিন বেশ দূরে ছিল। লঞ্চ যখন ঢাকা থেকে বের হয়ে কিছু দূর গেল তখন দেখি, যেসব যাত্রী ইঞ্জিন বরাবর ছিলেন তারা উঠে যাচ্ছেন। তারা বলছেন ডেক গরম হয়ে গেছে, তাপের কারণে বসতে পারছিলেন না। আমি মনে করি ওই লঞ্চের ইঞ্জিনে আগে থেকেই ত্রুটি ছিল।

বিষয়টি তখনই লঞ্চের স্টাফদের জানাই। তারা বলেন, এটা কোনো সমস্যা নয়, ঠিক হয়ে যাবে। এ কথার পর যাত্রীরা সবাই ভেবেছিলেন মনে হয় ঠিক হয়ে যাবে।

আরও পড়ুন: ইউপি নির্বাচনে হেরে গেলেন গোলাম রাব্বানীর মামা

রাত ৩টার দিকে আমার আপুর ঘুম ভাঙে। আপু তার বাচ্চা আমাকে বলে, ‘ওঠো আগুন লাগছে।’ উঠে দেখি, ইঞ্জিনের কাছাকাছি জায়গা আগুন বের হচ্ছে। আগুন ছাড়া তখন কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। সব অন্ধকার আর কালো ধোঁয়ায় পূর্ণ।

তিনি বলেন, আমি যখন উঠে দাঁড়ালাম তখন আর খালি পায়ে ডেক-এ দাঁড়াতে পারছিলাম না। কয়েক সেকেন্ডেই গরম হয়ে গেছে। এর মধ্যে আমার চাচাতো বোন ওর বাবাকে ফোন দিয়ে বলে- ‘আব্বু লঞ্চে আগুন লাগছে, আমি হয়তো বাঁচব না।’

এরপর আমরা পাঁচজন সবাই সিঁড়ির দিকে ছুটে গিয়ে দেখি, পুরো সিঁড়ি লোকে পরিপূর্ণ। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার উপায় নেই। ওদিকে আমরা যেখানে ছিলাম সেখানে আর দাঁড়ানো যাচ্ছিল না। এমনকি তখন লঞ্চের দোতলায় নিশ্বাস নেওয়াটাও কষ্টকর ছিল। অক্সিজেনের সংকট দেখা দেয়।

নিশ্বাস নিতে না পরে দৌড়ে লঞ্চের জানালার পাশে যাই। পর্দা সরিয়ে কোনো রকমে মুখ বের করে নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করি। তখন আমার সঙ্গে আমার চাচাতো বোনও ছিল। আর আমার বড় বোন তার দুই সন্তান নিয়ে লঞ্চের বিপরীত পাশে ছুটে যান। মুখ বাইরে বের করলেও শরীর আগুনের তাপে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কোনো হিটারের মধ্যে আমাকে রাখা হয়েছে। মানুষের ধাক্কায় আমার বড় বোন আগেই আলাদা হয়ে গেছে। এ অবস্থায় আমি চিন্তা করেছি, আমার সঙ্গে যে আছে তাকে নিয়ে আপাতত বেঁচে থাকার লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে।

আরও পড়ুন: নদী শুকিয়ে গেলে বাংলাদেশটাও শুকিয়ে যায়: তথ্যমন্ত্রী

তিনি বলেন, একপর্যায়ে আর সেখানে থাকতে না পেরে জানালার কাপড় সরিয়ে নিচে নামতে গিয়ে যখন পর্দায় হাত দিলাম সেটা এতোটাই উত্তপ্ত ছিল যে হাত পুড়ে যাচ্ছিল। তারপর অনেক কষ্টে বের হয়ে দোতলার গ্রিল ধরে বাইরে ঝুলে ছিলাম। উত্তাপ বেড়ে যাওয়ায় গ্রিলটা ছেড়ে দিয়ে নিচে পড়ে যাই। নিচে পড়ে প্রচণ্ড ব্যথা পাই। মনে হচ্ছিল শরীরের সব হাড় ভেঙে গেছে। আমি সরাসরি পানিতেও পড়তে পারছিলাম না। বাইরে এত অন্ধকার যে নদীর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। ওদিকে আমার চাচাতো বোন সাঁতার জানে না। তাকেও একইভাবে দোতলা থেকে নামিয়েছি। সেও প্রচণ্ড ব্যথা পেয়ে লঞ্চের বাইরের অংশে কোনো মতে দাঁড়ায়।

“পুরো লঞ্চে শুধু বাহিরের অংশটুকু ঠান্ডা ছিল। বাইরে চাচাতো বোনকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে সাহস করে বড় বোন আর তার সন্তানদের খুঁজতে ভেতরে যাই। অনেক খোঁজার পরও তাদের পাইনি। এর কিছুক্ষণ পর লঞ্চের একজন কেবিন বয় একটা বাচ্চা নিয়ে হাঁটছে আর বলছে, ‘আমি একটি বাচ্চা পেয়েছি। বাচ্চাটি কার? এক নারী আমার কোলে দিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন।’ আমি দৌড়ে গিয়ে বাচ্চার চেহারা দেখতে চাইলাম। দেখলাম আমার বোনের ছয় মাসের বাচ্চা। এদিকে আমার চাচাতো বোনের অবস্থাও ভালো না। ওর পুরো পিঠ পুড়ে যাচ্ছিল। আমি সাহস পেলাম আপু সাঁতার জানে সে বাঁচবে। কিন্তু আবার আপুর বড় বাচ্চাটার কথা ভেবে থমকে গেলাম”

“চারদিকে দাউ দাউ করে আগুন ধেয়ে আসছিল। আমি ওই সময়ে মৃত্যুর জন্য সার্বক্ষণিক প্রস্তুত ছিলাম। আমি জানতাম যে কোনো সময়ে আমি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাব। তারপরও উদভ্রান্তের মতো ছুটাছুটি করেছি। চিৎকার করেছি। মানুষের সাহায্য চেয়েছি। কিন্তু কে কাকে সাহায্য করবে? সবাইতো একই পরিস্থিতির মধ্যে।”

আরও পড়ুন: এমপি-ছাত্রলীগ নেতার আশ্রয়ে বেপরোয়া ধর্ষক আশিক

তিনি কান্না কণ্ঠে বলেন, একটি শিশু প্রথমে আমার দিকে ছুটে আসছিল। হঠাৎ দেখি সে ঘুরে আগুনের দিকে দৌড় দিল। চোখের সামনে দেখলাম সেই শিশুটি পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেল। ওর হয়তো কোনো হুঁশ ছিল না কোন দিকে যাবে। ভেতরে ঢুকে অনেক বৃদ্ধকে দেখেছি উঠে বসার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তার আগেই আগুন এসে গ্রাস করে ফেলছে। নারীদের দেখেছি জীবন্ত পুড়ে যাচ্ছেন। এত বীভৎসভাবে মানুষ পুড়তে দেখেছি যা কেউ কখনো দেখেনি। ওই লঞ্চে একে অপরকে বাঁচানোর কেউ ছিল না। যে যার মতো করে বাঁচার চেষ্টা করেছেন। সবাই যদি সম্মিলিতভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করতেন তাহলে হয়তো মৃত্যু কমিয়ে আনা যেত।

তিনি বলেন, সবাই বাঁচার জন্য ছুটাছুটি করছিল আর মানুষগুলো পিপীলিকার মতো পুড়ে যাচ্ছিল তখন আমিও লঞ্চের ভেতর থেকে বের হয়ে বাইরে আসি।

প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত ৩টার দিকে মাঝনদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে আগুন লাগে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন শতাধিক। এর মধ্যে ৭২ জনকে ভর্তি করা হয়েছে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এখন পর্যন্ত ৪১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।


সর্বশেষ সংবাদ