আমার বোনকে কি ফিরিয়ে দিতে পারবে এ পহেলা বৈশাখ?
নুসরাতের স্মৃতি খুঁজে ফিরছেন পরিবারের সদস্যরা
- নুর হোসেন ইমন, সোনাগাজী থেকে
- প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০১৯, ০১:৩৪ AM , আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৯, ০১:১১ PM
আগুন হামলায় নিহত ও যৌন হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর নুসরাত জাহান রাফি। আগুনে দগ্ধ হয়ে পাঁচদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে না ফেরার দেশে চলে যাওয়া নুসরাত জাহান রাফির সবকিছু এখন স্মৃতির পাতায় বন্দী।
নিজ শিক্ষকের যৌন লালসার শিকার সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার এই ছাত্রী আগুনে পুড়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দোষীদের শাস্তির দাবিতে লড়ে গেছেন। সবাইকে কাঁদিয়ে তার অকাল মৃত্যু এখনও মেনে নিতে পারছেন না তার পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনরা। তাদের প্রিয় নুসরাতের শোকে কাতর হয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা-বাবা ও তার ভাইয়ের। বাংলা নববর্ষের আনন্দ তাদেরকে ছুঁতে পারছে না। বরং এমন আনন্দ উপলক্ষে নুসরাতের না থাকা তাদের বেদনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
ফেনী জেলার সোনাগাজী থানার উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামে নুসরাতের বাড়ি। তার বাবার নাম মুছা মানিক। তিনি একটি ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষক এবং স্থানীয় একটি মসজিদের ইমাম হিসেবে কর্মরত আছেন। মা গৃহিনী। ভাই-বোনের মধ্যে নুসরাতই ছিলেন একমাত্র মেয়ে। আর রয়েছে তিন ভাই-নোমান, আরমান ও রায়হান।
বড় ভাই নোমান একই মাদ্রাসার ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত আর ছোট ভাই রায়হানও একই মাদ্রাসার ১০ম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। তারা দুজন অনেকটা সমবয়সী বলে ভাইবোনের মধ্যে খুনসুটি লেগেই থাকত। মেঝো ভাই আরমান রয়েছেন কুয়েতে।
নুসরাতের তিন ভাই তাদের একমাত্র বোনকে হারিয়ে শোকে পাথর। তার অকালে চলে যাওয়া কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তারা। সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছেন ছোট ভাই রায়হান। মাত্র দুই বছরের বড় ছোট হওয়ায় নুসরাতের সঙ্গে তার স্মৃতি রয়েছে সবচেয়ে বেশি। নুসরাতের মৃত্যুর পর থেকে অনেকটা খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন রায়হান।
গুরুতর অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় শুক্রবার রাতে রায়হানকে ফেনীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর শনিবার বিকেলে তাকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আনা হলেও অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। বুক চাপড়িয়ে চাপড়িয়ে কান্না করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছে সে। সর্বশেষ, শনিবার বিকেলে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল নুসরাতদের বাড়িতে সমবেদনা জানাতে আসলে সেখানেও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে। এরপর থেকে তেমন কথা বলছেন না কারও সাথে। এরই মধ্যে পাশ থেকে কেউ একজন কোন স্কুলের নববর্ষ উদযাপনের আয়োজন নিয়ে কথা বলছিলেন। তাদের কথা শুনে একসাথে বেড়ে উঠা এ ভাইয়ের বক্তব্য, আমার বোনকে কি ফিরিয়ে দিতে পারবে এ পহেলা বৈশাখ?
পৃথিবীর সবচেয়ে অভাগা পিতাদের অন্যতম নুসরাতের বাবা মুছা মানিক। যার নিজের কন্যাকে নিজেই জানাজার ইমামতি করে কবরে নামাতে হয়েছে। বাবার কাঁধে চেপে কবরে গিয়েছিল সন্তানের লাশ।
শনিবার দুপুরে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কন্যা হারানোর শোকে কাতর নুসরাতের বাবা মুছা মানিক। তারপরও সাংসারিক কর্ম থেকে ফুরসত পাচ্ছেন না তিনি। তার বাড়িতে প্রতিনিয়ত আসা আত্মীয়-স্বজন ও সংবাদ মাধ্যেমের লোকজনের সাথে কথা বলছেন। এর মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে কাতর হয়ে কেঁদে উঠছেন। একই সঙ্গে নিজেকে সামলে আবার সান্ত্বনা দিতে হচ্ছে পুত্র নোমান এবং রায়হানকেও। কারণ তিনিই এখন তাদের শেষ ভরসা। তাকে হার মেনে গেলে চলবে না!
নুসরাতের সাথে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর মামলা করা থেকে শুরু করে পরবর্তীতে হাসপাতালে আনা নেয়াসহ কাজকর্মের বড় একটি অংশ করতে হয়েছে নোমানকেই। এতকিছুর পরও বোনকে বাঁচাতে না পারায় এখন তার একটাই চাওয়া অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি। পিবিআইয়ের তদন্তে দোষীদের অনেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবান দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বোনের হত্যার সাথে জড়িতদের কেউ যেন রেহাই না পায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ দাবিই করেন।
প্রসঙ্গত, ৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজীতে পরীক্ষাকেন্দ্রের ভেতর নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে হত্যাচেষ্টা চালায় দুর্বৃত্তরা। সকালে সোনাগাজী পৌর এলাকার ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসাকেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। নুসরাত ওই মাদ্রাসা থেকেই আলিম পরীক্ষা দিচ্ছিলেন।
পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত কক্ষ থেকে ছাদে ডেকে নিয়ে কয়েকজন বোরকাপরা লোক পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যার চেষ্টা করে। নুসরাতের পরিবারের সদস্যরা জানান, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে করা মামলা তুলে না নেয়ায় এ ঘটনা ঘটেছে। এ তথ্য ফেনী সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন স্থানীয় পুলিশকেও জানিয়েছেন নুসরাত।
তার অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় ওই দিন বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের ১০২ নম্বর কক্ষে ভর্তি করা হয়। পরে তাকে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়। তাকে লাইফসাপোর্ট দেয়া হয়। এরপর গত বুধবার না ফেরার দেশে চলে যান মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি।