এসবি প্রধান মনিরুলের অফিস থেকে ২৫ কোটি টাকা চুরি, সন্দেহে তিন কর্মকর্তা

পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম  © ফাইল ফটো

পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলামের অফিস কক্ষ থেকে ২৫ কোটি টাকা চুরি হয়েছে। এ ঘটনায় তৎকালীন অতিরিক্ত ডিআইজি (অর্থ) মো. সরোয়ার, এসবির স্পেশাল সুপার (অর্থ) নজরুল ইসলাম ও স্টাফ অফিসার (এসপি মর্যাদা) মোহাম্মদ আশরাফকে সন্দেহ করা হচ্ছে। 

এসবির একটি সূত্র জানায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমন-পীড়নের কাজে ব্যয় করার জন্য শেষ সময়ে ৩ বা ৪ আগস্ট গণভবন থেকে ‘সোর্স মানি’ হিসেবে ২৫ কোটি টাকা পান মনিরুল ইসলাম। পুরো টাকাই তার অফিসে রাখা ছিল। বিষয়টি তৎকালীন এসবি প্রধানের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন জানতেন। তারাই যোগসাজশ করে সরকার পতনের পরপর পুরো টাকাটা সরিয়ে নেন। 

অভিযোগ আছে, গত ৭ আগস্টের পর তাদের প্রত্যেকের সেই প্রবেশাধিকার লক করে দেন এক কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তারতত্ত্বাবধানেই টাকা লুটপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, ৭ আগস্ট থেকে ছয় দিন কৌশলে এসবি কার্যালয়ের সব সিসি ক্যামেরা ও ইন্টারনেট লাইন বন্ধ করে টাকা লোপাট করা হয়। এ ঘটনায় গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি এরই মধ্যে সন্দেহভাজনদের জবানবন্দি নিয়েছে। তদন্ত চলছে।

আরও পড়ুন : এসবি প্রধান মনিরুল ও ডিএমপি কমিশনার হাবিবকে বাধ্যতামূলক অবসর

ঘটনা অনুসন্ধানে পুলিশ সদর দপ্তরের স্পেশাল সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রকেটশন ব্যাটালিয়নের ডিআইজি (অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) গোলাম কিবরিয়াকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি এরই মধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, আলামত সংগ্রহ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য নিয়েছে।

কমিটির সদস্যরা বলছেন, তৎকালীন এসবির সাবেক প্রধানের দপ্তরে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল, তা নির্ণয়ে তদন্ত কমিটি কাজ করছে। সংশ্লিষ্টদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে কমিটি প্রতিবেদন জমা দেবে। তবে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে চাচ্ছেন না কমিটির সদস্যরা। 

একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এসবি প্রধান মনিরুল ইসলামের কক্ষে নিজেদের আঙুলের ছাপ দিয়ে স্টাফ অফিসার মোহাম্মদ আশরাফ ও পিএস জাহাঙ্গীর আলমসহ পাঁচজন ঢুকতে পারতেন। মনিরুল ইসলামের কক্ষে মো. সরোয়ার, নজরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ আশরাফের ছিল অবাধ যাতায়াত। হাসিনা সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট থেকে মনিরুল ইসলাম আর এসবি কার্যালয়ে যাননি। মনিরুল ইসলামের ব্যাচমেট ও ঘনিষ্ঠ সহযোগী অতিরিক্ত ডিআইজি সরোয়ার অতি উৎসাহী হয়ে এসবি প্রধানের কক্ষে ও সিটি এসবি অফিসে তালা দেন। পরের দিন এসবির তৎকালীন প্রশাসন ও অর্থ শাখার ডিআইজি আব্দুল কুদ্দুস আমিনের অনুমতি ছাড়াই তার কক্ষে কর্মকর্তাদের সভা ডাকেন। চেইন অব কমান্ড না মেনে সভা করা নিয়ে আব্দুল কুদ্দুস আমিনের সঙ্গে তার বাকবিতণ্ডা হয়। মনিরুল ইসলামের বেইলি রোডের বাসা শিমুল ভবনের ফ্ল্যাটেও তল্লাশি করা হয়।

আরও পড়ুন : ওএসডি হলেন সাবেক এসবি প্রধান মনিরুলের স্ত্রী

কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অর্থ লুটের বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলোচনা শুরু হয় এসবির নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে। বিষয়টি নিয়ে ক্যাডার কর্মকর্তাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেও আলোচনা শুরু হয়। একপর্যায়ে বর্তমানে পদোন্নতি পেয়ে ডিআইজি হওয়া মো. সরোয়ার হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের অ্যাডমিন পরিবর্তন করে অনলি অ্যাডমিন করে দেন।

কর্মকর্তারা জানান, এসবি প্রধানের কক্ষে প্রবেশের জন্য পাঁচ ব্যক্তির আঙুলের ছাপের অনুমোদন ছিল। সেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট পরিবর্তন করে ফেলা হয়। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ নথি আছে উল্লেখ করে তালা দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে দফায় দফায় সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বন্ধ করে টাকা লুট করা হয়। 

কর্মকর্তারা জানান, এসবি প্রধানের মূল কক্ষের পেছনে একটি সিন্দুক রয়েছে। সেখানে মূলত রাষ্ট্রের অতিগুরুত্বপূর্ণ কিছু ডকুমেন্ট রাখা হয়। কিন্তু ওই সিন্দুকে টাকা ছিল বলে কোনো কোনো সূত্র দাবি করেছে।  

বিপুল অঙ্কের টাকার উৎসের বিষয়ে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত জুন ক্লোজিংয়ের কারণে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজসহ অন্যান্য কাজের ঠিকাদারদের বিল, সোর্স মানিসহ বিভিন্ন খাতের বড় অঙ্কের টাকা ছিল এসবি প্রধান ও এসএস ফিন্যান্সসহ কয়েকজন কর্মকর্তার কক্ষে। এছাড়া ৩ বা ৪ আগস্ট গণভবন থেকে মনিরুল ইসলাম আন্দোলন দমনের জন্য সোর্স মানি হিসেবে এসবি কার্যালয়ে টাকা নিয়ে আসার পর সেগুলো আর বণ্টন করা হয়নি। এ বিষয়টি জানতেন কয়েকজন কর্মকর্তা। 

এসবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, গত ৬ থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত মোট ১৯ ঘণ্টার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পাওয়া যায়নি। এই সময়ের মধ্যেই সেখান থেকে অর্থ সরানো হয়েছে। ওই ১৯ ঘণ্টা কেন সিসি ক্যামেরা বন্ধ ছিল, সে বিষয়ে এসএস টেকনিক্যাল সাজেদুল ইসলামের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। তিনি এ বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

আত্মগোপনে থাকা সাবেক এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম টেলিফোনে গণমাধ্যমকে জানান, তিনি ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে কোনো টাকা সরকার থেকে পাননি। তদন্তেই সব বেরিয়ে আসবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।  

বিসিএস ১৫ ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে। তিনি হাসিনা সরকারের আমলে পুলিশের সবচেয়ে প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের একজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। গত ১৩ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তিনি কয়েক ডজন মামলার আসামি। তাকে গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান চলছে। 


সর্বশেষ সংবাদ