আমাকে দেখতে এসে চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা
- ওয়ালিদ হোসেন, ঢাকা কলেজ
- প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৭ AM , আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৩৭ AM
‘আমি সেদিন খালি আল্লাহকে ডেকেছিলাম, আর চোখ বন্ধ করেছিলাম’। কথাগুলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত হওয়া ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল ইমরানের। পায়ে গুলি লেগে হাড় ভেঙে তীব্র রক্তক্ষরণ হয় তার। সেদিন আর্তনাদ করে শুধু আল্লাহকে ডেকেছিলেন তিনি। গত ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনের সময় পুলিশের ছোঁড়া ছয় ইঞ্চি তরল বারুদযুক্ত ইলেকট্রিক বুলেটবিদ্ধ হন তিনি। এরপর থেকে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ইমরান।
গত ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ১৫ বার ইমরানের পায়ে অপারেশন হয়েছে। চিকিৎসকের তথ্য অনুযায়ী, সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে তিনি ফিরতে পারবেন কিনা, জানা যাবে দুই বছর পরে। আব্দুল্লাহ আল ইমরান ঢাকা কলেজ মনোবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলায়। তার ভাষ্য, ‘আমাকে দেখতে এসে চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।’
পঙ্গু হাসপাতালে আব্দুল্লাহ আল ইমরানকে দেখতে শেখ হাসিনা এসেছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা ২৬ জুলাই আমাকে দেখতে এসে চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়ে গেছেন। বুঝতে পেরেছেন যে, আমি কোটা সংস্কার আন্দোলন করেছি। আওয়ামী লীগপন্থী না। এরপর আমার ঠিকমতো সেবা দেয়নি। আমার ওটি ৫টায় হলে আমাকে ওটিতে ঢুকায় রাত ৮টায়। আমার পায়ের পচা গন্ধে আমি থাকতে পারি না। আশেপাশের মানুষ থাকতে পারে না। আমার ব্যাথা-চিৎকারে মানুষ কান্না করেন।’
‘২০ জুলাই ফজরের সময় পঙ্গু হাসপাতালে আমাকে তিনটি ওটি করায়। আমার রক্ত ছিল ‘ও’ নেগেটিভ। একটা রক্ত ম্যানেজ করতে পারিনি। এক ব্যাগ রক্ত ৬ হাজার টাকা করে কিনেছিলাম। এরকম সাত ব্যাগ রক্ত আমার লেগেছে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গত জুলাইয়ে আহত হওয়ার ঘটনার স্মৃতিচারণ করে আব্দুল্লাহ আল ইমরান বলেন, ১৯ জুলাই জুমার নামাজের পর যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলন করছিলাম। তখন পুলিশের ছোঁড়া গুলি আমার পায়ে এসে লাগে। গুলিটি একটি নিষিদ্ধ বুলেট। ৬ ইঞ্চি লম্বা ইলেকট্রিক ফাইবার দিয়ে তৈরি, ভিতরে ছিল তরল বারুদ।
তিনি বলেন, আমি সেদিন ২০ থেকে ২৫টি লাশ দেখেছি। ভেবেছিলাম খাবার খেয়ে আন্দোলনে আসব। কিন্তু জুমার নামাজের পর আন্দোলনে এসে যখন খাবার খেতে যাব, তখন আমার সামনে শুধু একটার পর একটা লাশ পড়ছে। এ দৃশ্য দেখার পর রাস্তা থেকে আর যেতে ইচ্ছা করেনি। তখন ভাবছিলাম খেয়ে বা না খেয়ে মারা যাওয়ার মধ্যে তফাৎ তো নেই। গুলিটা আমার পায়ের হাড়ে ঢোকার সাথে সাথে পায়ের মধ্যেই ব্লাস্ট হয়।
ইমরান জানান, হাড় নয়টি টুকরা হয়ে পায়ের মাংশগুলো সব বের হয়ে যায়। অপারেশনের পরে তিটি টুকরো হাড় বের করে ফেললেও বাকি ছয়টি ভেতরে থেকে যায়। পায়ের দু’পাশে তিনটি করে টুকরা আর মাঝখানে কোনও হাড় নেই। গুলি লাগার পর আন্দোলনকারীরা আমাকে পাশের একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়।
বুলেটবিদ্ধ হওয়ার পর তার পায়ের অবস্থা বর্ণনা করে তিনি বলেন, গুলি লাগার পরে আমার পায়ের হাড়গুলো বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল, মাংস ঝুলে ছিল। কিছু মাংস রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল। পুরো পা কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল। তখন যে পরিমাণ রক্ত ক্ষরণ হয়েছিল, আমি বাঁচব কি বাঁচব না- এমন একটা ব্যাপার আমার সামনে। প্রথমে রক্তক্ষরণের সময় আমার পুরো শরীরের রগগুলো কাপতে থাকে। কিছুক্ষণ পর অনুভব করি আমার মস্তিষ্কও কাপছে। আমি তাকিয়ে আছি দেখি, কিন্তু চোখে দেখছি না। প্রায় ছয় ঘণ্টা আমি চোখে কিছুই দেখিনি, একদম ঝাপসা। আমি সেদিন খালি আল্লাহকে ডেকেছিলাম, আর চোখ বন্ধ করেছিলাম।
গুরুতর আহত অবস্থায় পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল ইমরানকে। সে সময়ের কথা স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, গুলি লাগার পরে চার-পাঁচটা হাসপাতালে যাওয়ার চেষ্টা করে বিকেল ৪টার দিকে মিডফোর্ড হাসপাতালে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন সেখানে ছোট অপারেশন করা হয়েছিল। পা কেটেই ফেলতে হবে এমন একটা মুহুর্ত যখন আমার সামনে, তখন আমার বন্ধুরা এসে বলে পা যদি কাটতেই হয় তবে এখন নয় পরে কাটা যাবে। ৫ ঘণ্টা পরে হলেও কাটা যাবে, দুই দিন পরে হলেও যাবে।
তিনি আরো বলেন, আমরা শেষ পর্যন্ত দেখতে চাই পা রাখা যাবে কিনা। শেষে জাতীয় পঙ্গু হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়। ২০ জুলাই ফজরের সময় পঙ্গু হাসপাতালে আমাকে তিনটি ওটি করায়। আমার রক্ত ছিল ‘ও’ নেগেটিভ। একটা রক্ত ম্যানেজ করতে পারিনি। এক ব্যাগ রক্ত ৬ হাজার টাকা করে কিনেছিলাম। এরকম সাত ব্যাগ রক্ত আমার লেগেছে।
‘আমার বাবা বলে, আমি বাড়ি ঘর সব বিক্রি করে দেব, এখানে চিকিৎসা না করালে আমি প্রাইভেট হাসপাতালে আমার ছেলেকে নিয়ে যাব। শেখ হাসিনার নির্দেশে আমাকে পঙ্গু হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া যাবে না। অন্য হাসপাতালে ভর্তি করানো যাবে না। এমনটা বলেছিল ডাক্তাররা। খুব ঝামেলায় ছিলাম, আল্লাহ রহমত করছে। ৫ আগস্টের পর থেকে আমি ভালো চিকিৎসা সেবা পাচ্ছি। সমন্বয়ক সারজিস আলম আমাকে দেখতে এসেছিল’, যোগ করেন তিনি।
আরো পড়ুন: অবৈধভাবে ভারতে যাওয়ার পথে সাংবাদিক শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল আটক
স্বৈরাচার সৃষ্টিতে এদেশের মানুষ দায়ী উল্লেখ করে নতুন স্বাধীন বাংলাদেশে ইমরান তার প্রত্যাশার কথা বলেন, ‘আমার প্রত্যাশা এদেশে কাউকে চরম ক্ষমতার অধিকারী করা যাবে না। চরম ক্ষমতার অধিকার যাকে দেওয়া হবে, সে এদেশে স্বৈরাচারী হবে। যেকোনও রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠানে, সংস্থায় এমন হবে। যে চরম ক্ষমতার অধিকারী হবে, সে স্বৈরাচারী হবে। তাদেরকে প্রথমেই প্রতিহত করতে হবে। প্রথমে তাকে মনে করিয়ে দিতে হবে, তার সীমা কতটুকু। এরকম সুযোগ দিলে এই পরিস্থিতে বার বার আসবে। প্রতিবার স্বৈরাচারের সৃষ্টি হবে।
তাঁর কথায়, শুধু শেখ হাসিনা না, যদি প্রথম থেকে বোঝানো হয় আপনার ক্ষমতা কতটুকু, আপনার কার্যকালাপ কি? আপনি কতটুকু করতে পারবেন। যাকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে সে স্বৈরাচার হবেই। সে যেই হোক, ফেরেশতা হোক। স্বৈরাচার সৃষ্টি করে আমাদের অবহেলা, অদায়িত্ব্, অজ্ঞতা।