যে বিচারে শুদ্ধাচার পুরস্কার পেয়েছিলেন তৎকালীন আইজিপি বেনজীর

তৎকালীন আইজিপি বেনজীর আহমেদ
তৎকালীন আইজিপি বেনজীর আহমেদ

২০২২ সালে জাতীয় পর্যায়ে শুদ্ধাচার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন তৎকালীন আইজিপি বেনজীর আহমেদ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাত থেকে তার পুরস্কার নেয়ার ছবি বেশ সুনামের সাথে প্রচারিত হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। তবে সম্প্রতি সেই ছবি নিয়ে বেশ আলোচন সমালোচনা দেখা গেছে। 

অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, শুদ্ধাচারের জন্য জাতীয় পুরস্কার পাওয়া এই সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার আচার কতটা শুদ্ধ ছিল? দুর্নীতির অভিযোগে তার সম্পত্তি ক্রোক করা হয়েছে। সপরিবারে দেশ ছেড়েছেন তিনি। তাহলে কোন শুদ্ধতার বিচারে এমন কর্মকর্তাকে শুদ্ধাচার পুরস্কার দেয়া হয়েছিল?

শুদ্ধাচার কী ও কেন?
বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির অভিযোগ বেশ পুরোনো। দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশকে প্রথম অন্তর্ভুক্ত করা হয় ২০০১ সালে। তবে প্রথমবারেই দেশটির অবস্থান হয় তালিকার শীর্ষে। সর্বশেষ ২০২৩ সালের জরিপেও বাংলাদেশ দশম স্থানে অবস্থান করছে।

এমন বাস্তবতায় "রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠার" লক্ষ্য নিয়ে ২০১২ সালে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রণয়ন করা হয়। সেখানে শুদ্ধাচার-এর একটি ধারণা দেয়া হয়েছে। "শুদ্ধাচার বলতে সাধারণভাবে নৈতিকতা ও সততা দ্বারা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষ বোঝায়। এর দ্বারা একটি সমাজের কালোত্তীর্ণ মানদণ্ড, নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্যও বোঝানো হয়। ব্যক্তিপর্যায়ে এর অর্থ হলো কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা তথা চরিত্র নিষ্ঠা।" এতে আরো বলা হয়, প্রাতিষ্ঠানিক শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তি পর্যায়ে শুদ্ধাচার অনুশীলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, কৌশল প্রণয়ন করা হলেও এটি বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এটি কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। সংশ্লিষ্ট লোকদের বেশিরভাগ হয়ত এটা খুলেই দেখেননি। বাংলাদেশের সাবেক স্থানীয় সরকার সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, শুদ্ধাচার কৌশলের "উদ্দেশ্য মহৎ থাকলেও পরে দেখা গেল এটা তেমনভাবে কার্যকর নয়"। শুদ্ধাচার কৌশলের ধারাবাহিকতায় প্রবর্তন করা হয় "শুদ্ধাচার পুরস্কার"।

যে যোগ্যতায় পুরস্কার প্রদান করা হয় 
প্রার্থীর যোগ্যতা হিসেবে ছয়টি বিধান যুক্ত করা হয়েছে পুরস্কারের নীতিমালায়:

১. বিবেচ্য কর্মচারীকে সংশ্লিষ্ট অর্থবছরে ন্যূনতম ছয় মাস সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে হবে।
২. কোনো কর্মচারীর গুণাবলির সূচকের বিপরীতে প্রাপ্ত সর্বমোট নম্বরের ভিত্তিতে সেরা কর্মচারী হিসাবে মূল্যায়ন করা হবে।
৩. কোনো কর্মচারীর মোট প্রাপ্ত নম্বর ন্যূনতম ৮০ না হলে তিনি শুদ্ধাচার পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবেন না।
৪. সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্ত কর্মচারী শুদ্ধাচার পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবেন।
৫. মূল্যায়নের পর একাধিক কর্মচারী একই নম্বর পেলে লটারির ভিত্তিতে সেরা কর্মচারী নির্বাচন করতে হবে।
৬. কোনো কর্মচারী যে কোনো অর্থবছরে একবার শুদ্ধাচার পুরস্কার পেলে তিনি পরবর্তী তিন অর্থবছরের মধ্যে পুনরায় পুরস্কার পাওয়ার জন্য বিবেচিত হবেন না।

ড. ইফতেখারুজ্জামানের মতে, মাপকাঠি ঠিক করা হলেও বাছাই করার ক্ষেত্রে যোগ্যদের সাথে বৈষম্য করা হয়েছে। তিনি বলেন, "যারা সত্যিকার অর্থে শুদ্ধাচার চর্চা করেন তাদের সাথে বৈষম্য করা হয়েছে। এতে এমন বার্তা গেছে, যে শুদ্ধাচার চর্চা না করেও পুরস্কার পাওয়া যায়, কাজেই আর শুদ্ধাচার চর্চার প্রয়োজন নেই।" এ কারণেই ইতিবাচক ফল মেলেনি বলে মন্তব্য তার।

সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, মৌলিক জায়গায় পরিবর্তন না এনে, উপরি কাঠামোর পরিবর্তন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। তিনি বলেন, ফান্ডামেন্টাল চেঞ্জ না করে কসমেটিক চেঞ্জ করলে কোনো লাভ হয় না। মুখ দেখে করা হয়েছে। এখানে দলীয়করণ, রাজনীতি এবং বিবেচনা গুরুত্ব পেয়েছে শুধু। পুরস্কার হিসেবে একটি সার্টিফিকেট এবং এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ দেয়া হয়। এতে পুরস্কারের ক্ষেত্রে অর্থের চেয়ে স্বীকৃতিটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, শুদ্ধাচার কৌশল ও শুদ্ধাচার পুরস্কার নিয়ে সরকারের নতুন করে ভাবা উচিত।

 

সর্বশেষ সংবাদ