দেশে গত ১ বছরে সড়কে ঝরেছে ৮ হাজার প্রাণ
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০১:২৮ PM , আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০৩:৪০ PM
বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন-২০২৩ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক বছরে ৬ হাজার ২৬১টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭ হাজার ৯০২জন জন। আহতের সংখ্যা ১০ হাজার ৩৭২ জন। এ ছাড়া ওই সময় রেলপথে ৫২০টি দুর্ঘটনায় ৫১২ জন নিহত, ৪৭৫ জন আহত হয়েছেন। নৌ-পথে ১৪৮টি দুর্ঘটনায় ৯১ জন নিহত হয়েছেন।
রোববার (১৪ জানুয়ারি) ডিআরইউ’তে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এ প্রতিবেদন তুলে ধরেন।
বিদায়ী ২০২৩ সালে দুর্ঘটনা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫০৫ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭ হাজার ৯০২ জন। ১০ হাজার ৩৭২ জন আহত হয়েছেন। একই সময় রেলপথে ৫২০টি দুর্ঘটনায় ৫১২ নিহত, ৪৭৫ জন আহত হন। নৌ-পথে ১৪৮টি দুর্ঘটনায় ৯১ জন নিহত, ১৫২ জন আহত ও ১০৯ জন নিখোঁজ রয়েছেন। একই সময়ে ২ হাজার ৩১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২ হাজার ১৫২ নিহত ও ১ হাজার ৩৩৯জন আহত হয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে ঢাকা বিভাগে ১ হাজার ৭৩৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৭১২ জন নিহত, ২ হাজার ৩৮১ জন আহত হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগে ১ হাজার ২৩৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ২০৫ জন নিহত, ২ হাজার ২৯৪ জন আহত হয়েছে। খুলনা বিভাগে ৭৬৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৬৪ জন নিহত,১ হাজার ৭৮ জন আহত হয়েছে।
বরিশাল বিভাগে ৩৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭৯ জন নিহত, ৯৯২ জন আহত হয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগে ৪১৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৬৪ জন নিখুঁত, ৬৬৫ জন আহত হয়েছে। সিলেট বিভাগে ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০৩ জন নিহত, ৯২৬ জন আহত হয়েছে। রংপুর বিভাগে ৫৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬২৬ জন নিহত, আহত ৩২১ হয়েছেন। রাজশাহী বিভাগে ৭৮৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৯৩ জন নিহত ও ১ হাজার ১৬৮ জন আহত হয়েছে।
আরও পড়ুন: আগামী সপ্তাহে শুরু হচ্ছে বাণিজ্যমেলা
এতে আরও বলা হয়, বিদায়ী বছরে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে ১৭ জানুয়ারি, এইদিনে ৩৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২০ জন নিহত ও ৩১ জন আহত হয়েছে। ২৬ মার্চ সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে, এইদিনে ৩৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ জন নিহত ও ১৪ জন আহত হয়েছে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলেছে, ২০২২ সালের চেয়ে বিদায়ী ২০২৩ সালে ছোট যানবাহনের সংখ্যা হঠাৎ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাওয়া ও এসব যানবাহন অবাধে চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা বেড়েছে। এতে ফিডার রোডে ৫৫ শতাংশ, জাতীয় মহাসড়কে ১৪ শতাংশ এবং রেলক্রসিংয়ে শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে। তবে এবার আঞ্চলিক মহাসড়কে ৪৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ দুর্ঘটনা কমেছে বলে জানিয়েছে এই সংগঠন।
দুর্ঘটনায় সবচেয়ে নিহত হয়েছে ৩৭ জুলাই, এইদিনে ৩০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১ জন নিহত ও ৯৮ জন আহত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছে ৪ মার্চ, এইদিনে ২৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৯ জন নিহত ও ১৪৮ জন আহত হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিগত ৯ বছরে নিবন্ধিত যানবাহনের পাশাপাশি ছোট যানবাহন বিশেষ করে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের সংখ্যা ৪ থেকে ৫ গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি ইজিবাইক, মোটরসাইকেল ও ত্রি-হুইলার সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে অবাধে চলাচলের কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে— বেপরোয়া গতি; বিপদজনক অভারটেকিং; রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রুটি; ফিটনেসবিহীন যানবাহনের অবাধে চলাচল; যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা; চালকের অদক্ষতা; যানবাহন চালক ও মালিকের বেপরোয়া মনোভাব; চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেড ফোন ব্যবহার; মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো; রেলক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা; রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা; ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ; ট্রাফিক আইন অমান্য করা; ছোট যানবাহনের ব্যাপক বৃদ্ধি; সড়কে চাঁদাবাজি; রাস্তার উপর হাট-বাজার; ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চালানো; মালিকের অতিরিক্ত মুনাফার মানসিকতা; চালকের নিয়োগ ও কর্মঘণ্টা সুনির্দিষ্ট না থাকা; সড়কে আলোকসজ্জা না থাকা; রোড ডিভাইডার পর্যাপ্ত উচু না থাকা; সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর দায়িত্বরত প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহি না থাকা এবং দেশব্যাপী নিরাপদ, আধুনিক, স্মার্ট গণপরিবহন ব্যবস্থার পরিবর্তে টুকটুকি-ইজিবাইক-ব্যাটারিচালিত রিকশা, মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশা নির্ভর গণপরিবহন।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সুপারিশমালা :
১. করোনার চেয়ে ভয়াবহ মহামারি বিবেচনায় সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার প্রকল্পে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি অর্šÍভুক্ত করা।
২. নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দ্রুত সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা।
৩. সড়ক নিরাপত্তায় বাজেট বরাদ্ধ বাড়ানো, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে গঠিত সড়ক নিরাপত্তা ইউনিট শক্তিশালী করা।
৪. সড়ক নিরাপত্তায় ইতিমধ্যে প্রণীত যাবতীয় সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করা।
৫. দেশের সড়ক-মহাসড়কে রোড সাইন, রোড মার্কিন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন করা। জেব্রা ক্রসিং অংকন ও আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা।
৬. গণপরিবহন চালকদের যুগউপযোগী পেশাদার ট্রেনিং ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
৭. সড়ক পরিবহন সেক্টরে সুশাসন প্রতিষ্টা করা। অনিয়ম-দুর্নীতি ও চাদাঁবাজি বন্ধ করা।
৮. গাড়ির নিবন্ধন, ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স প্রদানের পদ্ধতি উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়ন করা।
৯. সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক সহায়তা তহবিলে আবেদনের সময়সীমা ৬ মাস নির্ধারণ করা।
১০. স্মার্ট গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে দেশব্যাপী পর্যাপ্ত মানসম্মত নতুন বাস সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নেয়া।
১১. ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য ট্রাফিক ট্রেনিং একাডেমী গড়ে তোলা।
১২. উল্টো পথের আলো এবং পথচারীর পারাপার রোধে মহাসড়কের রোড ডিভাইডার পর্যাপ্ত উচু করা।
১৩. গণপরিবহনে সেবা ও নিরাপত্তার মান পর্যবেক্ষণের জন্য মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য, সচিব, জেলা প্রশাসকদের প্রতিমাসে একদিন পরিচয় গোপন রেখে গণপরিবহন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।
১৪. পরিবহনের প্রধানতম স্টেকহোল্ডার ১.মালিক ২.শ্রমিক ৩. যাত্রী ৪.সরকার হলেও দীর্ঘদিন যাবত এই সেক্টরে ভাড়া নির্ধারণ, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণসহ যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মালিক-শ্রমিক-সরকার মিলেমিশে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারনে যাত্রী হয়রানী, ভাড়া নৈরাজ্য ও সড়কে দুর্ঘটনা বেপরোয়া হারে বাড়ছে। খেসারত দিচ্ছে দেশের সাধারন মানুষ।
যাত্রী সাধারনের মতামত ও অংশগ্রহন ব্যতিরেখে সিদ্ধান্ত গ্রহনের ফলে এই সেক্টরে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকার নানাভাবে চেষ্টা করেও বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। কোন কোন সময় সরকার অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে। ফলে কতিপয় মালিক শ্রমিক নেতাদের হাতে এই সেক্টর দীর্ঘদিন যাবৎ জিম্মি দশায় রয়েছে। এখান থেকে নতুন সরকার মুক্তি দেবেন এমনটি জনসাধারণের প্রত্যশা।
এই সময় উপস্থিত ছিলেন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আবু জাফর সূর্য, যাত্রী কল্যাণ সমিতির সহ-সভাপতি তাওহিদুল হক লিটন, যুগ্ম মহাসচিব এম. মনিরুল হক, প্রচার সম্পাদক মাহমুদুল হাসান রাসেল, কেন্দ্রীয় নেতা মোঃ মহসিন, বাংলাদেশ মানবাধিকার সমিতির সভাপতি মনজুর হোসেন ইসা প্রমুখ।