চন্দ্র কুমার দে: বাংলা লোকজ সাহিত্যে কালজয়ী এক নাম

চন্দ্র কুমার দে
চন্দ্র কুমার দে  © ফাইল ফটো

বাংলা লোকসাহিত্যের অন্যতম প্রধান একজন সংগ্রাহক ছিলেন চন্দ্রকুমার দে। যেসব লোকগল্প, লোকগীতি পূর্ব বাংলায়, বিশেষত ময়মনসিংহ অঞ্চলে বহুকাল ধরে প্রচলিত রয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে সেসব সংগ্রহ করেছেন চন্দ্রকুমার দে। একই সাথে তিনি একজন দক্ষ লেখক হিসেবেও নাম করেছিলেন।  

লোকসাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ সংগ্রাহক ১৮৮৯ সালে ময়মনসিংহ জেলার ( বর্তমানে নেত্রকোনা  জেলা)কেন্দুয়া উপজেলার  আইথর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রামকুমার দে। তাঁদের পূর্বপুরুষদের নিবাস ছিল ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোণা মহকুমার (বর্তমানে জেলা) রাঘবপুর গ্রামে।

অতি অল্পবয়সেই তিনি পিতা-মাতা উভয়কেই হারান। যার দরুণ ছোটবেলা থেকেই তাঁকে উপার্জনের পথ খুঁজতে হয়েছিল। সংস্কৃত সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান লাভ ছাড়া তিনি কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। তিনি যেসব লোকসাহিত্য সংগ্রহ করেছেন সেগুলো পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কতৃক “মৈমনসিংহ গীতিকা (১৯২৩)” এবং “পূর্ববঙ্গ-গীতিকা (১৯২৩-১৯৩২)” নামে প্রকাশিত হয়েছে, যা পরবর্তীতে ইংরেজিতে ‘Eastern Bengal Ballads’ নামে প্রকাশিত হয়েছে।

কর্মজীবনের প্রথমে তিনি একটি মুদি দোকানে মাসপ্রতি এক রুপি বেতনে চাকরী নেন। কাজের প্রতি মনোযোগ না থাকায় তাঁর এক টাকা বেতনের চাকরিটি চলে যায়। পরবর্তীতে তারানাথ তালুকদার মাস প্রতি ২ রুপী বেতনে তাঁকে কর আদায় সম্পর্কিত কাজে নিজুক্ত করেন।

১৯১২ সালে তিনি ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত ‘সৌরভ’ পত্রিকায় লোকসাহিত্যের উপর কিছু নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এই পত্রিকার সম্পাদক কেদারনাথ মজুমদার চন্দ্রকুমার দে’র প্রতিভা আবিষ্কার করেন এবং এই প্রবন্ধগুলোর মাধ্যমে সুধীসমাজের কাছে তাঁর পরিচিতি ঘটে। এছাড়া তিনি চন্দ্রকুমারকে গৌরীপুরের জমিদারীতে মাসপ্রতি ৮ রুপী বেতনে গোমস্তার কাজ পাইয়ে দিয়েছিলেন। কর আদায়ের জন্য বিভিন্ন গ্রাম ভ্রমণের সুবাদে তিনি কবিগান ও পালাগান শ্রবণের সুযোগ পেয়েছিলেন এবং লিপিবদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু খাজনা প্রায় কিছুই আদায় করেননি।১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে (১৩২০ বঙ্গাব্দে) ‘সৌরভ’ পত্রিকার ফাল্গুন সংখ্যায় চন্দ্রকুমার দে’র ‘মহিলা কবি চন্দ্রাবতী’ নামক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। দীনেশচন্দ্র সেন এই প্রবন্ধটি পরে অভিভূত হন এবং আরও তিনজন লোকসাহিত্য সংগ্রাহকের সাথে চন্দ্রকুমার দে -কে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালাগান সংগ্রাহকের পদে নিযুক্ত করেন। এসময় তাঁর মাসপ্রতি বেতন ছিল ৭০ রুপী

তাঁর সংগৃহীত লোকসাহিত্য গুলোই দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদনা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “মৈমনসিংহ গীতিকা (১৯২৩)” এবং “পূর্ববঙ্গ-গীতিকা (১৯২৩ – ১৯৩২)” নামে প্রকাশিত করেন। মৈমনসিংহ গীতিকায় তাঁর দ্বারা অন্তর্ভুক্ত পালা গুলো হচ্ছে : মহুয়া (রচয়িতা দ্বিজ কানাই), চন্দ্রাবতী (রচয়িতা নয়নচাঁদ ঘোষ), ‘কমলা (রচয়িতা দ্বিজ ঈশান), দেওয়ানা মদিনা (রচয়িতা মনসুর বয়াতী), ‘দস্যু কেনারামের পালা (রচয়িতা চন্দ্রাবতী), কঙ্ক ও লীলা, মলুয়া, দেওয়ান ভাবনা, কাজলরেখা, রূপবতী।

তাঁর সংগৃহীত যে সমস্ত পালা পূর্ববঙ্গ গীতিকায় প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর কয়েকটির নাম হল : ধোপার পাট, মইষাল বন্ধু, কমলা রাণীর গান, দেওয়ান ঈশা খাঁ, ভেলুয়া, আয়না বিবি, গোপিনী কীর্তন। এই পালাগুলোর অধিকাংশই ময়মনসিংহ ও সিলেট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

মৌখিক ধারার এসব গান ও সাহিত্য মাঠপর্যায় থেকে সংগ্রহ করে জনসম্মুখে তুলে ধরার মৌলিক কৃতিত্ব চন্দ্রকুমারের। পালা সংগ্রহ ছাড়া চন্দ্রকুমার নিজে বেশ কিছু কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। ১৯৪৬ সালে এই মহান ব্যাক্তিত্বের জীবনাবসান ঘটে।

চন্দ্র কুমার দে স্মৃতি রক্ষার্থে তার নিজ গ্রাম আইথর গ্রামে 'চন্দ্র কুমার দে স্মৃতি পরিষদ'  গঠন করা হয়েছে। এছাড়া, তার স্মৃতি রক্ষার্থে সাবেক জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রশান্ত কুমার রায় ৫ মার্চ -২০২২ দুপুরে ম্যুরাল নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন।

কেন্দুয়া উপজেলার আইথর গ্রামে চন্দ্র কুমার দের বাড়িতে আয়োজিত এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন কেন্দুয়া পৌরসভার মেয়র আসাদুল হক ভূঁইয়া, চন্দ্র কুমার দে স্মৃতি পরিষদের সভাপতি কামরুল হাসান ভূঁইয়া, সাধারণ সম্পাদক আল মামুন কোকিল, লোকসাহিত্য গবেষক সঞ্জয় সরকারসহ অনেকে।

চন্দ্র কুমার দে স্মৃতি পরিষদের সভাপতি কামরুল হাসান ভূঞা  বলেন, চন্দ্র কুমার দে ছিলেন আমাদের তথা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ লোকজ ধারা। এই লোকজ সংস্কৃতির চর্চা ও প্রসারে জেলার কেন্দুয়া উপজেলার আইথর গ্রামের নিজের বাড়িতে চন্দ্র কুমার দের নামে লোক সংস্কৃতি কেন্দ্র গড়তে হবে। এই কেন্দ্র স্থাপন এলাকাবাসীর প্রাণের দাবি।


সর্বশেষ সংবাদ