ক্যারিয়ার নিয়ে ইনসিকিউরিটি— কেউ সরকারি চাকরি খোঁজে, কেউ পাড়ি জমায় বিদেশে
ইশরাতের উচ্চশিক্ষার গল্প
থাইল্যান্ডের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সাবেক ছাত্রী ইশরাত জাহান খান চৌধুরী। প্রফেশনালি একজন গবেষক হলেও তার নেশা অ্যাডভেঞ্চার আর ফিল্ম মেকিংয়ে। ইউটিউবে ইতোমধ্যে তার নেপালের এভারেস্ট বেইজ-ক্যাম্পের উপর প্রকাশিত হওয়া ৫ পর্বের একটি সিরিজ দর্শক মহলে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। সম্প্রতি বিদেশে উচ্চশিক্ষাসহ নানা বিষয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে কথা বলেছেন এই তরুণ গবেষক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. আরিফুল ইসলাম—
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি কোন দেশে এবং কোন বিষয়ে পড়াশোনা করছেন?
ইশরাত জাহান খান চৌধুরী: আমি এখন থাইল্যান্ডে অবস্থান করছি। এখানকার মাহিদোল ইউনিভার্সিটি নামে শীর্ষস্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজি এন্ড ইমিউনোলজি বিভাগে ইনফেকশাস ডিজিজের উপর পিএইচডি করছি। এর আগে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: নিজের সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
ইশরাত জাহান খান চৌধুরী: প্রফেশনালি আমি একজন গবেষক হলেও অ্যাডভেঞ্চার, ফিল্ম মেকিং আমার নেশা। সম্প্রতি ইউটিউবে আমার নেপালের এভারেস্ট বেইজ-ক্যাম্পের উপর প্রকাশিত হওয়া ৫ পর্বের একটি সিরিজ দর্শকমহলে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। বাংলাতে অনেক অনেক ট্রাভেল ভ্লগ থাকলেও অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে খুব কম কাজ হয়। আমি নিজেও যেহেতু ট্রেকিং, হাইকিং, ক্যাম্পিং টাইপের অ্যাক্টিভিটিজ পছন্দ করি। তাই ভাবলাম কেন এই মুহূর্তগুলোকে আমি ক্যামেরাবন্দি করব না? জীবনের এই গোল্ডেন এজটাকে আর কখনোও ফিরে পাব না। তাই সামর্থ্য অনুযায়ী সেটার পূর্ণ স্বাদ নিতে চাই। বৃদ্ধ বয়সে দুজন ভিডিওগুলো দেখব আর ভাববো, ‘বাহ আমরা কত্ত কুল ছিলাম!’ পরবর্তীতে আমাদের প্ল্যান সেভেন সামিটের পথে যাত্রা শুরু করা।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ছোটবেলায় কি হওয়ার ইচ্ছে ছিল?
ইশরাত জাহান খান চৌধুরী: ছোটবেলায় কেউ ক্লাসে এই প্রশ্ন করলে আমার উত্তর শোনার পর একটা হাসির রোল পড়ে যেত! সবাই যেখানে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখত, আমি সেখানে মহাকাশ বিজ্ঞানী হওয়ার কথা বলতাম। মহাকাশে প্রাণের অস্তিত্বের ব্যাপারটা আমাকে বরাবরই খুব টানত। অনার্সের ৩য় বর্ষ থেকেই নিজেকে গবেষণায় ডুবিয়ে দিয়েছিলাম। বর্তমানেও সেই পথেই হাঁটছি এবং আমি স্বপ্ন দেখি যে একদিন মহাকাশে প্রাণের অস্তিত নিয়ে গবেষণা করব। যদি সে স্বপ্ন পূরণ নাও হয় তবুও মানবজাতির কল্যাণে আমার গবেষণার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিদেশে পড়তে যাওয়ার ইচ্ছে কেন?
ইশরাত জাহান খান চৌধুরী: এই প্রশ্নটা যতটা সহজ, গুছিয়ে উত্তর দেয়া ঠিক ততটাই কঠিন। কারণ উত্তরটা আমাদের কারোরই অজানা নয়। আমাদের দেশ গবেষণামুখী একটা প্রজন্ম তৈরিতে অনেকটাই ব্যর্থ। গবেষণায় ভালো সুযোগ এবং ক্যারিয়ারের সিকিউরিটি না থাকায় পাশ করেই ছাত্রদের কিছু অংশ লেগে পড়ে সরকারি চাকরির খোঁজে আর কিছু অংশ পাড়ি জমায় বিদেশে। দেশের বাইরে গবেষণার ভালো সুযোগ, প্রয়োজনীয় বাজেট, মোটা অঙ্কের স্কলারশিপ, ক্যারিয়ার সিকিউরিটি সব কিছুই আছে যেটা দেশে থেকে সম্ভব নয়। অথচ চাইলেই আমাদের দেশের পক্ষেও কিন্তু এমন পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব!
আবার এখানে পড়াশোনা শেষ করে ছাত্ররা দেশে ফিরে যাবে কিনা এটা নিয়েও কিন্তু কনফিউশনে ভোগে। থাইল্যান্ডে আমি দেখেছি এখানকার স্টুডেন্টরা যখন দেশের বাইরে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে যায়, দেশে ফেরার আগেই বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি অথবা গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাদেরকে নিজেদের দলে ভেড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। দেশেই যেহেতু ভালো সুযোগ হয়ে যায় তাই তারা পড়াশোনা শেষ করা মাত্রই দেশে ফিরে এসে দেশ কে সার্ভ করে। এভাবে তারা দেশের রত্ন দেশে ফিরিয়ে আনতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে আমরা এরকম লোভনীয় সুযোগ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি। যে কারণে দেশ থেকে একবার বের হলে কেউ আর দেশে ফিরে আসে না! এটা দেশের উন্নতির জন্য হতাশাজনক!
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিবাহিত হওয়ার পরও এমন চ্যালেঞ্জিং সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ কী ও পারিবারিক সাপোর্ট কতটুকু রয়েছে?
ইশরাত জাহান খান চৌধুরী: আসলে বিয়ে কোন চ্যালেঞ্জ না; বরং বন্ধুত্বের অপর নাম। বিয়ের মধ্য দিয়ে ক্যারিয়ারে বাধা নয় বরং নতুন একজন মানুষকে পাওয়া যায় যে আপনাকে সাপোর্ট করবে, আপনার পাশে থাকবে। কিন্তু আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। এখানে এটা একটা রুলসে পরিণত হয়ে গেছে যে বিয়ে করলে একটা মেয়ের ক্যারিয়ার শেষ! এমনটা কাম্য নয়। আমাদের উভয়পক্ষেররই দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
আমি মনে করি, আমি যেভাবে আমার পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারছি, পাশাপাশি ইউটিউবে শখের বশে মাউন্টেনিয়ারিং এর উপর যে ভিডিওগুলি আপলোড করতে পারছি এমন করে যে কোন ছেলে-মেয়েই তার স্বপ্ন নিয়ে কাজ করতে পারে, এটা কোন ব্যাপার না!
কিন্তু এটা সবার ক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে ওঠে না। কারণ এখানে উভয় পক্ষই দায়ী। একটু বুঝিয়ে বলি, যেমন ধরেন, আমার যেমন একটা অদম্য ইচ্ছা আছে, তেমন আমার পরিবার এবং আমার হাজবেন্ড আমাকে একটা সুন্দর পরিবেশ দিয়েছে যেন আমি আমার ইচ্ছের ডানা মেলে ধরতে পারি।
এখন এই গল্পে যদি যেকোনো এক পক্ষকে আমরা বাদ দিয়ে দেই তাহলে গল্পটা কেমন হবে? উত্তরটা কিন্তু এখানেই নিহিত। বিয়ের মাধ্যমে আমরা একে অন্যের সহযোগী হই, প্রতিদ্বন্দ্বী নই। বরং আমি বলতে চাই বিয়ে করে এই মানুষটা কে যদি আমার জীবনে না পেতাম তাহলে হয়ত আমাকে মানসিক সাপোর্ট দেওয়ার মত কাউকে পেতাম না!
আমার স্কলারশিপ হওয়ার পর আমার হাজবেন্ড দেশের একটা লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল। আমাকে এক বারও বলেননি যে তুমি স্কলারশিপ ছেড়ে দাও। চাকরি ছাড়ার সময় কিন্তু সে জানত না যে তার ভবিষ্যৎ কি! সে শুধু আমাকে ভালোবেসে এই ত্যাগ স্বীকার করেছিল। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তাকেও নিরাশ করেননি। এখন সে দেশের চাইতেও ভালো একটা চাকরি করছে। আপনি যদি আমার হাজবেন্ডকে জিজ্ঞাসা করেন সেও আমার সম্পর্কে একই উত্তর দেবে, কারণ তার জীবনের কোনো না কোনো স্টেজে আমিও তাকে সাপোর্ট দিয়েছি! আমরা একে অন্যের সহযোগী এবং বিশ্বস্ত বন্ধু! এবং আমরা এটাও বিশ্বাস করি যে ভালোবাসার প্রতিদান সৃষ্টিকর্তা আরও বড় আকারে ফিরিয়ে দেন, শুধু তার প্রতি আস্থা রাখতে হবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: মেয়ে হিসেবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে আপনার চ্যালেঞ্জ কেমন ছিল?
ইশরাত জাহান খান চৌধুরী: আমি বিশ্বাস করি যারা একবার স্থির করে যে তারা পড়াশোনা কন্টিনিউ করবে তাদের জন্য কোন কিছুই চ্যালেঞ্জিং না। হ্যাঁ এটা ঠিক, অনেক সময় পরিবার সাপোর্টে থাকে না, বুঝতে চায় না। আমি যে সহযোগিতাপূর্ণ পরিবেশ পেয়েছি সেটা হয়ত অনেকেই পায় না। দেখুন আমি উপরে শুধু আমার পজিটিভ গল্পগুলোই বলেছি। আমার জার্নির খারাপ সময়গুলো নিয়ে কিন্তু বলিনি। বলতে চাইও না।
কারণ এখন আমি এমন একটা সময়ে চলে এসেছি যে খারাপ সময়গুলো আমার আর মনেই নেই! খারাপ সময়ে আমি সর্বদা একটা বিষয়ই মাথায় রাখতাম যে, “এখন যারা আমাকে বুঝতে পারছেনা, সাপোর্ট করছেনা, একটা সময় তারাই আমাকে নিয়ে গর্ব করবে। কিন্তু আমি যদি থেমে যাই তাহলে এই মুহূর্তটা আমি কখনই দেখতে পাব না!” এবং সত্যি সত্যি হয়েছেও তাই! সেই মানুষগুলো এখন আমাকে নিয়ে গর্ব৷ করে! আমি যা কিছু পেয়েছি তা আমি সঠিক উপায়ে অর্জন করে নিয়েছি। তাই আমি বলব সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মনের জোরকে টিকিয়ে রাখা এবং একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে অটল থাকা।
এর বাইরে বলতে গেলে বলতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে মেয়েদের নিজেদের এবং তাদের কাজের নিরাপত্তা নিয়ে। ডিপার্টমেন্টে অথবা ডিপার্টমেন্টের বাইরে নিরাপত্তার অভাবে অনেক মেয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে গবেষণামুখী হতে চায় না। আমি এখানে রাত ১২টা-১টা পর্যন্ত নির্দ্বিধায় কাজ করি। সেইফলি বাড়ি ফেরা নিয়ে আমাকে ভাবতে হয় না। কারণ এখানে আমার সেই নিরাপত্তা আছে, যেটা দেশে কল্পনাই করতে পারতাম না!
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সর্বোপরি অন্যান্য মেয়েদের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলতে চান....
ইশরাত জাহান খান চৌধুরী: বলা মানে তো শেষ হয়ে যাওয়া, কিন্তু না বলা মানে অনেক কিছু বলা। শুধু মেয়েরা না, আমার বিশ্বাস ছেলে-মেয়ে উভয়েই আজকে আমার লেখাগুলো পড়ে অনেক হিডেন এবং ডিপ বিষয় অনুধাবন করতে পেরেছে। আমি এটাই তাদের ম্যাসেজ হিসেবে বলতে চেয়েছি যে, প্রত্যেকটা মানুষের জীবন আলাদা, তাদের প্ল্যান আলাদা, স্বপ্ন আলাদা। কিন্তু এক্সিকিউশনের প্রসেস সেইম। জীবন কে যদি আমরা টেস্ট ক্রিকেট খেলার সাথে তুলনা করি তাহলে তুমি হলে ব্যাটসম্যান আর বোলারের প্রতিটা বল তোমার সামনে একেকটা প্রবলেম। তোমাকে প্রতিটা বলে ছক্কা হাকাতে হবে না। কিন্তু যদি তুমি নিজের উইকেটটা বাঁচিয়ে খেলতে পারো, তাহলে দিন শেষে তোমার ঝুলিতে একটা ডাবল সেঞ্চুরি আশ্চর্যজনক কোন বিষয় নয়। আর যদি হাল ছেড়ে দাও- জীবনের খেলায় তুমি ‘আউট’!