সরকারির চেয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশী
- সাইফ ইসলাম
- প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০১৮, ০৫:৪০ PM , আপডেট: ২২ আগস্ট ২০১৮, ০৫:৪২ PM
দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। তবে যে হারে বেসরকারি বিদ্যায়তন বাড়ছে তার চেয়ে কম হারে বাড়ছে সরকারি শিক্ষায়তন। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়- সব ধরণের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ওই একই ব্যাপার। সিংহভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি নিয়ন্ত্রণে।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সূত্র জানায়, মাদ্রাসার প্রায় শতভাগই চলছে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়েও ৯০ শতাংশের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ৭০ শতাংশ গড়ে উঠেছে বেসরকারি উদ্যোগে। কিছুটা ব্যতিক্রম প্রাথমিকে। শিক্ষার এ স্তরে বেসরকারির চেয়ে সরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যা কিছুটা বেশি।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারের তদারকি ও নজরদারির ঘাটতি রয়েছে। অর্থাভাবে পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষকও নিয়োগ দিতে পারছে না বেসরকারি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নাজুক অবস্থায় থাকছে অবকাঠামোও। অনেক ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই পাঠদান করে যাচ্ছেন শিক্ষকরা। এছাড়া শিক্ষার ব্যয় তুলনামূলক বেশি হওয়ায় স্বল্প আয়ের পরিবারের সন্তানদের সুযোগ হয়ে উঠছে না বেসরকারি এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ নেয়ার। সার্বিকভাবে শিক্ষাব্যয়ও বাড়াচ্ছে বেসরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
ব্যানবেইসের ‘বাংলাদেশ এডুকেশন স্ট্যাটিস্টিকস ২০১৬’ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় গত বছেরের ডিসেম্বরে। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১ লাখ ২৬ হাজার। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৬৪ হাজার ১২৩টি। আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে ৬২ হাজার ৪৯২টি বিদ্যালয়। এ হিসাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চলছে ৪৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
মাধ্যমিক পর্যায়ে বিদ্যালয় রয়েছে ২০ হাজার ৪৪৯টি। এর মধ্যে বেসরকারি পর্যায়ে পরিচালিত হচ্ছে ১৯ হাজার ৫০৮টি। অর্থাৎ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৯৫ দশমিক ৩৯ শতাংশই বেসরকারি। একই অবস্থা কলেজের ক্ষেত্রেও। সারা দেশে ৪ হাজার ৫৫৭টি কলেজের মধ্যে ৪ হাজার ২৩৮টিই পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। সে হিসাবে মোট কলেজের প্রায় ৯৩ শতাংশই বেসরকারি। তবে এরপর বেশকিছু কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছে।
বিপুলসংখ্যক এ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারের নজরদারির বাইরে থেকে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে নিয়মিত নজরদারির অভাব। সরকারের যে জনবল, তা দিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেই নিয়মিত পরিদর্শন চালানো সম্ভব হয় না। এছাড়া বেতন বরাদ্দ কম থাকায় পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেয়াটাও সম্ভব হয় না। আর নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনার কোনো ব্যবস্থা নেই। সব মিলিয়ে সরকারের অর্থ ব্যয় হলেও নিয়মিত নজরদারির অভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার মান নিশ্চিত সম্ভব হচ্ছে না।
দেশে সরকারিভাবে পরিচালিত কোনো মাদ্রাসা নেই বললেই চলে। ব্যানবেইসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা দেশে ৯ হাজার ৩১৪টি মাদ্রাসার মধ্যে সরকারি মাত্র তিনটি। বাকি সবই বেসরকারি।
দেশে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন অনেক দিনের। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশই শিক্ষার মান ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। তার পরও প্রতি বছরই অনুমোদন পাচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ব্যানবেইসের ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ৩৮টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৯২। এ হিসাবে মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০ দশমিক ৭৬ শতাংশই বেসরকারি। এরপর আরো ছয়টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত হয়েছে।
গত বছর পর্যন্ত সারা দেশে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল মোট ৫ হাজার ৮৯৭টি। এর সিংহভাগ অর্থাৎ ৫ হাজার ৬০৯টিই রয়েছে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। সরকারি ব্যবস্থানায় রয়েছে মাত্র ২৮৮টি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ হিসাবে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও ৯৫ শতাংশই চলছে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেসরকারি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই এমপিওভুক্ত। এর মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও সরকারের কাছ থেকে বিনামূল্যের বই পায়। তবে পূর্ণাঙ্গ সুযোগ-সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে আমরা বিভিন্ন সময় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও সরকারীকরণ করে থাকি। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
ধারাবাহিকভাবে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লেও বাড়ছে না শিক্ষার গুণগত মান। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) তথ্য বলছে, উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার মানের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিচে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। আর বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে উচ্চশিক্ষার মানের দিক দিয়ে ১৩৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষার বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬তম, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানের দিক থেকেও বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকেই। এ সূচকে বাংলাদেশ ১০৯তম। এক্ষেত্রে পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে ছয় ধাপ পিছিয়ে (১১৫তম) থাকলেও দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো এগিয়ে রয়েছে।