সারদা পুলিশ একাডেমিতে আওয়ামীপন্থি ৫ শিক্ষক নিয়োগ, অসন্তোষ দুই মহলে
- রাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২৫, ০২:৫৬ PM , আপডেট: ২৪ জুন ২০২৫, ০৩:৫৮ PM
রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমিতে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত পাঁচজন শিক্ষককে ঘিরে শুরু হয়েছে বিতর্ক। অভিযোগ উঠেছে, সদ্য নিয়োগ পাওয়া ১১ জন শিক্ষকের ৫ জনই আওয়ামীপন্থি। এ নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে বিএনপি ও জামায়াতপন্থি শিক্ষক মহলে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর বাংলাদেশ পুলিশের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (সারদা পুলিশ একাডেমি) একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের। তখন আওয়ামী শিক্ষকদের বাইরের কোনো শিক্ষক সেখানে ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার দায়িত্ব পাননি।
এদিকে গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ফ্যাসিবাদের অবসান দখলদারত্ব থেকে মুক্ত হবে পুলিশ একাডেমি, এমনটাই ভেবেছিলেন সবাই। কিন্তু পুলিশ একাডেমির এমপিএস কোর্সের ৪১ ও ৪৩ ব্যাচের জন্য দায়িত্ব পাওয়া ১১ জনের পাঁচজনই হলেন আওয়ামীপন্থী শিক্ষক। এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষকরা। পুলিশ একাডেমি এভাবে চললে পুলিশকে ফ্যাসিবাদের প্রভাবমুক্ত করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন তারা।
বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির এমপিএস (মাস্টার্স অব পুলিশ সায়েন্স) কোর্সটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) আইন অনুষদের অধীনে পরিচালিত হয়। আর অনুষদের ডিন এই প্রোগ্রামের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
গত ৮ এপ্রিল রাবির আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আ ন ম ওয়াহিদ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে এমপিএস কোর্সের ৪১ ও ৪৩ ব্যাচের জন্য প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ১১ জন শিক্ষক। এর মধ্যে পাঁচজনই আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের সদস্য। বাকি তিনজন বিএনপি ও তিনজন জামায়াতপন্থি সংগঠন সাদা দলের।
নিয়োগ পাওয়া পাঁচজন আওয়ামীপন্থি শিক্ষক হলেন অধ্যাপক আ ন ম ওয়াহিদ, অধ্যাপক আনিসুর রহমান, অধ্যাপক হাসিবুল আলম প্রধান, অধ্যাপক আহসান কবির এবং সহযোগী অধ্যাপক মমতাজ খাতুন।
এই পাঁচজন শিক্ষকের মধ্যে অধ্যাপক ওয়াহিদ ও অধ্যাপক প্রধান জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিপক্ষে আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষকদের ব্যানারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বাকি তিনজন আন্দোলনের বিপক্ষে সরাসরি অবস্থান না নিলেও আন্দোলনের পক্ষেও ছিলেন না কোনোভাবে।
অধ্যাপক ওয়াহিদ আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষকদের প্যানেল থেকে নির্বাচন করে বর্তমানে আইন অনুষদের ডিনের দায়িত্বে আছেন। পাশাপাশি একই প্যানেল থেকে নির্বাচন করে সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবেও দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পরে তার পদত্যাগের দাবিতে কয়েক দফায় আন্দোলন করেছিল আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
এ ছাড়া এর আগে অধ্যাপক আহসান কবির এবং অধ্যাপক আনিসুর রহমান আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষকদের প্যানেল থেকে নির্বাচন করে ডিন হয়েছিলেন। অধ্যাপক আনিসুর রহমান জুলাই গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে ১৬ জুলাই হলগুলোতে ছাত্রলীগের নেতাদের রুম ভাঙচুরের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির সদস্যও ছিলেন। অধ্যাপক হাসিবুল আলম প্রধান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একটি উপ-কমিটির সদস্য হিসেবে রয়েছেন। সহযোগী অধ্যাপক মমতাজ খাতুনের পরিবার আওয়ামী লীগপন্থি। তার স্বামী রুয়েটের আওয়ামী লীগপন্থি প্রভাবশালী একজন শিক্ষক। তার ভাসুর আওয়ামী লীগের সময় রাজশাহী কোর্টে পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।
এ বিষয়ে আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোর্শেদুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগের সময়ে আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষক ছাড়া অন্য কাউকে পুলিশ একাডেমিতে ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। কেন আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় না, সে বিষয়ে আমরা আওয়ামী লীগের শিক্ষকদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলতেন, উপরের নির্দেশনা আছে। বিএনপি-জামায়াতপন্থি কোনো শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। তারা যেকোনোভাবে পুলিশকে প্রভাবিত করতে পারে।
প্রশ্ন রেখে এই অধ্যাপক আরও বলেন, বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষকরা পুলিশকে প্রভবিত করতে পারে, এই সন্দেহে আমাদের ক্লাস-পরীক্ষা নিতে দেওয়া হয়নি। তাহলে আওয়ামী লীগের শিক্ষকদের এই দায়িত্ব দিচ্ছেন কারা? আবার তারাই বা কোন লজ্জায় এখন পুলিশ একাডেমিতে ক্লাস-পরীক্ষা নিতে যাচ্ছে? আমরা আশঙ্কা করছি, আওয়ামী লীগপন্থি ফ্যাসিবাদী শিক্ষকরা পুলিশ একাডেমিতে ক্লাস-পরীক্ষা নিলে পুলিশকে ফ্যাসিবাদের প্রভাবমুক্ত রাখা সম্ভব হবে না।
তিনি আরও বলেন, সাধারণত কোন কোন শিক্ষক পুলিশ একাডেমিতে ক্লাস-পরীক্ষা নেবে, সেটা নির্ধারণ করেন আইন অনুষদের ডিন। কিন্তু আওয়ামী লীগের সময়ে যখন জামায়াতপন্থি অধ্যাপক আব্দুল হান্নান ডিন ছিলেন, তখন তাকে শিক্ষক নির্ধারণ করা তো দূরের কথা তাকে পুলিশ একাডেমিতে ক্লাসই নিতে দেওয়া হয়নি। সেই দায়িত্ব তখন জোর করে পালন করতো বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার। তখন কারণ জানতে চাইলে বলা হতো, 'ডিনের থেকে ভিসি বড়। ভিসি চান রেজিস্ট্রার দায়িত্ব পালন করুক।' আর এখন নিয়ম মানার কথা বলে ফ্যাসিবাদপন্থি ডিনই নির্ধারণ করছে, কে কে ক্লাস নেবে। আবার ফ্যাসিবাদপন্থি শিক্ষকদেরই ক্লাস নেওয়ার জন্য বাছাই করছেন তিনি।
পুলিশ একাডেমিতে ক্লাস নেওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক আ ন ম ওয়াহিদ বলেন, মূলত এ দায়িত্ব আইন অনুষদের ডিন হিসেবে আমার ওপরই বর্তায়। সাধারণত এ ধরনের কোর্সগুলো যারা নিয়মিত পড়ান, তাদেরই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তবে শিক্ষকদের মধ্যে ভারসাম্য আনতে কিছু নতুন শিক্ষকদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
কিন্তু আগে জামাতপন্থি শিক্ষকও থাকা অবস্থায় এই নিয়ম মানা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এবারে আমি এককভাবে সিদ্ধান্ত নেইনি। প্রফেসর আব্দুল হান্নান, প্রফেসর আসমা সিদ্দিকা এবং আমি—এই তিনজনে একাধিকবার মিটিং করে শিক্ষকদের নাম প্রস্তাব করেছি। প্রফেসর আসমা সিদ্দিকা, প্রফেসর আব্দুল হান্নান, প্রফেসর আব্দুর রহিম মিয়া, সাঈদা আঞ্জু, মোর্শেদুল ইসলাম এবং সালমা আক্তার খানম—এই ছয়জনকে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তারা আগে কখনো এই দায়িত্বে ছিলেন না।
এ বিষয়ে জানতে পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষ ব্যারিস্টার মো. জিল্লুর রহমানকে একাধিকবার কল দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।