বেতনটা এই ঈদেও হলো না, নতুন শঙ্কায় এমপিও প্রত্যাশীরা

টানা এক দশক পর এমপিওভুক্ত হতে যাওয়া প্রায় তিন হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণার প্রতীক্ষায় দিন কাটছে- এ দাবিতে আন্দোলন করা শিক্ষকদের। তবে নানা নাটকীয়তার কারণে এ নিয়ে তাদের মধ্যে প্রত্যাশার পাশাপাশি নানা শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। শিক্ষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে সর্বশেষ মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে তাই শিক্ষকরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণা ও তা কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন।

গত ১৩ জুন ঈদুল ফিতরের ঠিক পর যখন বাজেট ঘোষণা হয় তখন এমপিওভুক্তিকে সরকারের তরফ থেকে শিক্ষকদের জন্য ঈদের পুরস্কার বলে বর্ণনা করা হয়। তবে এরপর আরও দু’মাস গড়ালেও এ বিষয়ে এখনো কোনো ঘোষণা আসেনি। ঈদুল ফিতরের পর ঈদুল আজাহাও চলে এলো। কিন্তু এখনও ঘোষণা ঘোষণা না আসায় কবে নাগাদ এই ইস্যু সমাধান হবে, তা নিয়ে নতুন শঙ্কায় পড়েছেন শিক্ষকরা। তাদের ধারণা- বিষয়টি নিয়ে আরও কালক্ষেপণ হতে পারে।

এছাড়া এর আগে বছরের পর বছর ধরে আশ্বাস দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি না করার অভিযোগেও ক্ষোভ রয়েছে শিক্ষকদের মধ্যে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। এবং তখনও ঘোষণা করা হয়েছিল শিগগিরই ওই অর্থে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হবে। তবে সে ঘোষণার পর আরেকটি বাজেট পার হলেও এখনও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে শিক্ষকরা একদিকে ২ হাজার ৭৪৩টি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এমপিওভুক্তির যে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া হয়েছে তাকে ইতিবাচকভাবে দেখলেও ঘোষণা ও তার বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত নিজেদের শঙ্কার কথাও জানাচ্ছেন শিক্ষকরা।

গত বছর শিক্ষকদের তুমুল আন্দোলনের মুখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের প্রণীত নতুন এমপিও নীতিমালার আওতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্রুততম সময়ে এমপিওভুক্তির কথা জানায়। তবে আন্দোলনরত শিক্ষকরা মন্ত্রণালয়ের ওই সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করেন। তাদের ভাষায়, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে দেশের সেবা দিয়ে আসছে। এবং পুরাতন নীতিমালার আওতায় এগুলো প্রতিষ্ঠিত। ফলে পুরাতন নীতিমালার আওতায় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হোক। তারপরও যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদ যাবে সে বিষয়ে তাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। তবে সরকার তাদের সে পরামর্শ গ্রহণ করেনি। বরং নতুন নীতিমালার আওতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করতে বলা হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় নয় হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওর জন্য আবেদন করে। নীতিমালার আওতায় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সরকার তিন ভাগের এক ভাগেরও কম অর্থাৎ ২ হাজার ৭৪৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তির জন্য মনোনীত করেছে বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় এই এমপিও ঘোষিত হলে বাকি দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের আন্দোলনে নামার ঝুঁকিও রয়েছে।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যেসব ব্যক্তি এমপিওভুক্তির আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের অধিকাংশেরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির তালিকায় রয়েছে। এতে করে নেতারা আন্দোলন থেকে সরে গেলে শিক্ষক আন্দোলন মাথাচাড়া দিতে পারবে না বলে সরকারের ধারণা।

এ বিষয়ে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদন্নবী বলেন, ‘এমপিওভুক্তির জন্য দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। আমাদেরকে বারবার আশ্বাস দেয়া হলেও এখনও আন্দোলনের কোনো সুফল পাইনি। পত্রপত্রিকা মারফত সংবাদ পাচ্ছি শিগগিরই নতুন নীতিমালার আওতায় ২৭শর মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিও করা হবে। শিগগিরই এর ঘোষণা দেয়ার কথাও শুনছি। তবে আশ্বাস অনেক পেয়েছি। এখন বাস্তবতায় দেখতে চাই।’

এমপিওভুক্তির জন্য শিক্ষক আন্দোলনের প্রধান এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের দিন কাটছে এমপিও ঘোষণার অপেক্ষাতে। কখন এ ঘোষণা আসবে। আমার প্রতিষ্ঠানের নাম থাকবে কি না? এসবই এখন আমাদের চিন্তার বিষয়। আমরা সরকারকে বারবার বলেছি, যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে এমপিওভুক্ত হয়নি, তাই আবেদন করা নয় হাজার প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশকে এমপিওভুক্ত করা হোক। এসব প্রতিষ্ঠান অযোগ্য হলে সরকার তো এর স্বীকৃতি দিত না। যোগ্য বলেই স্বীকৃতি পেয়েছে। ফলে আমরা দাবি জানাই পুরাতন নীতিমালার আওতায় অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হোক।’

এ বিষয়ে আন্দোলনকারী আরেকজন শিক্ষক আশুতোষ মন্ডল বলেন, ‘বেতন ছাড়া কতদিন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান ধরে রাখা যায়? সরকার মানের কথা বলছে। কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠান ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত কোনো ধরনের সরকারি সহায়তা ছাড়া পরিচালিত হচ্ছে তাদের পক্ষে মান ধরে রাখা কতটা সম্ভব। সরকারের উচিত পুরাতন নীতিমালার আওতায় যারা যোগ্য সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবগুলোকেই এমপিওভুক্ত করা। নতুন নীতিমালা অনেক কঠোর করে প্রণীত হয়েছে। ফলে এটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের দাবি, পুরাতন নীতিমালার আওতায় সরকারিভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হোক।’

এমপি প্রত্যাশী সিরাজগঞ্জবাসী হাসানুর রহমান বলেন, জীবনটা যে কীভাবে চলে, সেটা আমি আর আমার পরিবারই। ধারণা ছিল, গত ঈদেই এমপিও পাব। কিন্তু সেটা তো হয়নি, এই ঈদেও (ঈদুল আজহা) হলো না। এটা তো আমাদের জীবন নিয়ে খেলার মত হয়ে যাচ্ছে।

সরকারি সূত্র অবশ্য জানাচ্ছে শিগগিরই ২ হাজার ৭৪৩টি স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসার এমপিওভুক্তির ঘোষণা আসবে। একই সময়ে আরও ১ হাজার ৫১৯টি এবতেদায়ি মাদ্রাসাকেও এমপিওভুক্ত করা হবে। তবে ঠিক কতদিনের মধ্যে এ ঘোষণা করা হবে তা স্পষ্ট করে বলতে পারেননি কোনো সরকারি কর্মকর্তা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব সোহরাব হোসাইন এ বিষয়ে বলেন, ‘এমপিওভুক্তি ঘোষণার জন্য আমাদের প্রস্তুতি একেবারে শেষ পর্যায়ে রয়েছে।’ তবে এর বেশি কিছু জানাননি সচিব। এতে করে কবে এ ধরনের ঘোষণা করা হবে তা নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে সংশয়ও তৈরি হয়েছে। তবে মন্ত্রণালয়ের অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভর করছে। প্রধানমন্ত্রী চাইলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এমপিওভুক্তির ঘোষণার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রস্তুত রয়েছে।


সর্বশেষ সংবাদ