সংকটে পোশাক শিল্প, ক্রয়াদেশ যাচ্ছে ভারত পাকিস্তান শ্রীলঙ্কায়

নানা ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের তৈরি পোশাক খাত
নানা ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের তৈরি পোশাক খাত  © সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ঢাকার আশুলিয়া ও গাজীপুরসহ বেশ কিছু স্থান পোশাক শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবি আদায়ে বিক্ষোভ করেছেন। এর পাশাপাশি নানা ধরনের সংকট ও অসন্তোষের কারণে বহু বড় কোম্পানি বিপাকে পড়ে গেছে। আন্দোলন, কর্মবিরতি এবং কারখানা বন্ধের ঘটনায় নানামুখী উদ্বেগ তৈরি হয়েছে এ খাতে। এতে উৎপাদন কমার পাশাপাশি কার্যাদেশ পাশের কয়েকটি দেশে চলে যাচ্ছে। বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে কয়েকটি বড় কোম্পানির। ‘আস্থার সংকট’ কাটাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দেখে রপ্তানি আয়ে প্রায় ৮৫ শতাংশ অবদান পোশাক খাতের। প্রায় ২ হাজার ৮০০ কারখানা সরাসরি রপ্তানির সঙ্গে জড়িত। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি থেকে আয় হয় ৫ হাজার ৫৫৫ কোটি ডলার। পোশাক রপ্তানি থেকেই আসে ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলার, যা মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। তবে শ্রমিক অসন্তোষ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে অনেক কারখানা বন্ধ ও দফায় দফায় ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। এতে প্রায়ই পোশাকের কার্যাদেশ বাতিল হয়ে যাচ্ছে।

পোশাক খাতের রমরমা সময় জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস। এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপসহ পশ্চিমা দেশগুলোয় ছুটি ও ভ্রমণের আমেজ থাকে। তখন বাংলাদেশ তৈরি পোশাকের বিক্রি বাড়ে। সে কার্যাদেশ পেতে নমুনা পাঠাতে হয় আগস্টের আগে। তবে দেশে জুলাই থেকে শুরু হওয়া অস্থিরতায় কারণে অনেকেই নমুনা পাঠাতে সমস্যায় পড়েছেন। কেউ কেউ দেরিতে পাঠিয়েছেন। সব মিলিয়ে জানুয়ারি-মার্চ মাস মেয়াদে ৬ বিলিয়ন ডলারের পর্যন্ত রপ্তানি কমতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

২ হাজার ৮০০ কারখানা সরাসরি রপ্তানির সঙ্গে জড়িত। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি থেকে আয় হয় ৫ হাজার ৫৫৫ কোটি ডলার। পোশাক রপ্তানি থেকেই আসে ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলার, যা মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী স্কয়ার গ্রুপের সিইও ব্যবসায়ী তপন চৌধুরী বলেছেন, রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাত চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ শিল্পে অস্থিতিশীল অবস্থার কারণে ইতিমধ্যে কিছু ক্রয়াদেশ অন্য দেশে গেছে। এটা হাইটেক ইন্ডাস্ট্রি না হওয়ায় ব্যবসা সরতে বেশি সময় লাগে না। শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধের কারণে এই ব্যবসাটি বাংলাদেশে এসেছিলেন। এখন বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হওয়ায় ক্রেতারা শ্রীলঙ্কায় নজর দিচ্ছে।

সম্প্রতি ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) আয়োজনে ‘ইআরএফ সদস্যদের সঙ্গে কথোপকথন’ অনুষ্ঠানে তপন চৌধুরী আরো বলেন, ধীরে ধীরে ব্যবসায়ীদের আস্থা ফিরে আসছে। ৫ আগস্টের পর যে ভাঙচুর ও অসন্তোষ শুরু হয়েছিল, সে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। সরকারের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংলাপ হওয়া দরকার। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তরণের সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়া প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশর একটি শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক কর্মকর্তা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, অস্থিরতার কারণে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে তাদের কর্মীদের বেতন দিতে বেগ পেতে হয়েছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বেতন হয়েছে দেরিতে। এভাবে চলতে থাকলে সামনে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। সমস্যা সমাধানে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।

শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেছেন, কিছু কারখানা বকেয়া বেতন দিচ্ছিল না। তাদের আন্দোলন যৌক্তিক। তবে এর বাইরে যা হচ্ছে, তার পেছনে আগের সরকারের সঙ্গে মালিকের সংশ্লিষ্টতাও কারণ হতে পারে। বিক্ষোভ বেশি হচ্ছে তাদের কারখানায়। এ খাত অস্থিতিশীল থাকলে ক্ষতি হবে সবার। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তারা চেষ্টা করছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে।

পোশাক তৈরির আরেক প্রতিষ্ঠান এসরোটেক্স গ্রুপের এক সপ্তাহে লক্ষ্যমাত্রার ১৯ শতাংশ উৎপাদন হয়েছে। ফলে তিন মাসের যে ক্রয়াদেশ আছে, শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে তা উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে কারখানা বন্ধের কথা ভাবতে হবে। শ্রমিকদের কথায় চলতে হচ্ছে।

তার ভাষ্য, ২১ হাজার শ্রমিক নিয়ে কাজ চালিয়ে আসা কোম্পানির পাঁচ কারখানা থেকে মাসে দেড় থেকে এক কোটি ৬০ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করে। শ্রমিকরা সেপ্টেম্বরে ২৬ কর্মদিবসের মধ্যে কাজ করেছেন ১৬ দিন। আর সরকারি তথ্য অনুযায়ী, শ্রমিক অসন্তোষে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কার্যাদেশ বাতিল হয়েছে। গত ১২ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলনে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এ তথ্য জানান।

গত ১২ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, এটি সিজনাল বিজনেস। মার্কেটে যে প্রোডাক্ট যাবে, তা তিন মাস আগেই প্রস্তুত হয়। সে অর্ডার বাতিল হয়ে যাচ্ছে। কিছু নির্দিষ্ট দেশের ব্যবসায়ীরা অর্ডার নিতে লবিং করছে।

স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ ২০টি দেশের ৪০টি প্রতিষ্ঠানের কাছ পোশাক রপ্তানি করে। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেছেন, শ্রমিকদের ১৮ দফা মেনে নিলেও দিন দিন দফা বেড়েছে। এতে ‘অস্তিত্ব সংকট’ তৈরি হবে। ক্রেতারাও নতুন করে কথা বলছেন না এসব বিষয়ে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকায় তার সময়ে পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা আশা দেখছিলেন। তবে অসন্তোষের জেরে তাও সে আশাও কমেছে। কারখানায় হামলা, ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজি নিয়ে অস্থিরতা তৈরি হয়। শ্রমিক অসন্তোষ সমস্য আরও বাড়িয়েছে। বিজিএমইএ সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলছেন, ৩০ শতাংশের মত কার্যাদেশ ন্য দেশে চলে গেছে। প্রতিযোগী দেশ ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় চলে যাচ্ছে কার্যাদেশ।

ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, আশুলিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা ‘রিস্কি জোন’ বলে চিহ্নিত করেছেন। এতে একটি কোম্পানিই ৯০০ কোটি টাকার ক্ষতির কথা জানিয়েছে। অনন্ত গার্মেন্টস ১০ লাখ পোশাক আটকে যাওয়ার কথা জানিয়েছিল। ফলে আকাশপথে বেশি ব্যয়ে এসব পাঠানোর কথা জানায় তারা। আন্দোলনের সময় ইন্টারনেট ও যোগাযোগ বন্ধ থাকায় ক্রেতাদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছিল। এর পাশাপাশি শ্রমিক অসন্তোষের কারণে সংকট আরো বেড়েছে।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর বিশেষ সাধারণ সভায় বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রেদওয়ান আহমেদ বলেন, পোশাক খাতে নাসা গ্রুপ থেকে সমস্যার শুরু হয়েছিল। এর চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার আওয়ামী লীগ সময়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন, এমন অভিযোগ রয়েছে। শ্রমিকদের বেতন না দিয়ে অসন্তোষ তৈরি করে তারা। এখন তারা কোটি কোটি টাকা ঢালছেন ভাঙচুর ও কারখানা বন্ধ করতে। সরকার ও শিল্পকে ধ্বংস করতে চাচ্ছেন।

আর বিজিএমইএ সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেছেন, বিভিন্ন ফেডারেশন ও আন্তর্জাতিক চক্র ১৮ দফা দাবি তুলেছে। স্প্যারো গ্রুপের শোভন ইসলামের ভাষ্য, ‘চাকরি চাই’ নামে একটি গ্রুপের মাধ্যমে হাজারো মানুষ একসঙ্গে জড়ো হচ্ছে। ভেতরে অনেকে ঢুকে চাকরি চাচ্ছে, অন্যরা ঢিল ছুড়ছে।‘চাকরি চাই’ দল কারা, এমন প্রশ্ন তোলেন তিনি।

যদিও গার্মেন্টস শ্রমিক নেত্রী নাজমা আক্তারের ভাষ্য, বর্তমান উচ্চমূল্যের বাজারে জীবন-জীবিকা চলছে না শ্রমিকদের। তবে সাম্প্রতিক বিক্ষোভে ‘উসকানিও’ আছে। আগের সরকারের সময়ে রাজনীতি ঢুকে গেছিল, দুর্নীতি আছে। শ্রমিকরাও রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছেন। মালিকরা ঘুষ দিয়ে তাদের ম্যানেজ করেন। 

আরো পড়ুন: চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৩, অবসরের কত?

শ্রমিকদের দাবির মধ্যে রয়েছে, মজুরি বোর্ড পুনর্গঠন ও ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ; ২০২৩ সালে ঘোষিত ন্যূনতম মজুরির দ্রুত বাস্তবায়ন; শ্রম আইন সংশোধন; ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর অব্যাহতি বা চাকরিচ্যুত করলে বেসিকের সমান অর্থ দেওয়া; শ্রম আইনের সংশোধন। বকেয়া মজুরি পরিশোধ; হাজিরা বোনাস, টিফিন বিল, নাইট বিল সমান হারে বাড়ানো; প্রভিডেন্ড ফান্ড চালু; ইনক্রিমেন্ট ১০ শতাংশ করা; রেশনের ব্যবস্থা; বায়োমেট্রিক ব্ল্যাকলিস্টিং বন্ধ করা; হয়রানিমূলক ও রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার; ঝুট ব্যবসার আধিপত্য বন্ধে ব্যবস্থা; মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ ১২০ দিন নির্ধারণসহ আরও নানান বিষয়।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ নাঈমুল ওয়াদুদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও মধ্যপ্রাচ্য সংকটসহ নানা কারণে ক্রেতাদের আস্থার সংকট বেড়েছে। আস্থা ফেরাতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে সংলাপ বা আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। এতে শ্রমিকদের অংশগ্রহণও বাড়াতে হবে। সরকার বিশেষ করে শিল্প উপদেষ্টা বেশি উদ্যোগী হলে এবং সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এ সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence