করোনাকালে বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেলের ৪০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা
- ইরফান এইচ সায়েম
- প্রকাশ: ৩০ মে ২০২১, ০৯:১১ PM , আপডেট: ৩১ মে ২০২১, ০৫:২৯ PM
অতিমারী করোনাভাইরাসের কারণে এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ এ ছুটিতে ঘরবন্দী জীবন, পারিবারিক সংকট, সম্পর্কের টানাপোড়েন ও একাকীত্বের মতো নানা মানসিক সমস্যায় ভুগছে অসংখ্য শিক্ষার্থী। অবসাদ-হতাশায় আত্নহননের মতো পথ বেছে নিচ্ছে অনেক শিক্ষার্থী।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের এক অনুসন্ধানের পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের মার্চ থেকে দেশে করোনা সংক্রমণের পর থেকে মেডিকেল ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ৪০ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এর মধ্যে ১২ জনই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। সবশেষ গত ১৫ মে এ মিছিলে যুক্ত হন বিশ্ববিদ্যালয়টির তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার বিভাগের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমান। এ ঘটনার আটদিন পর ২৩ মে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে হাফিজুরের ভাই তার লাশ শনাক্ত করেন।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেছেন, গত এক বছরের বেশি সময় শিক্ষার্থীরা গৃহবন্দী থেকেছে। এ সময় তাদের মধ্যে নানা কারণে বেড়েছে হতাশা ও বিষণ্নতা। যার নানামুখী প্রভাব পড়েছে মানসিক স্বাস্থ্যে। এসব কারণে কেউ কেউ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে আত্মহত্যা ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।
সম্প্রতি তরুণদের একটি সংগঠনের জরিপে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে বলে জানানো হয়েছে। আঁচল ফাউন্ডেশন নামে ওই সংগঠনটি বলছে, পারিবারিক, সম্পর্কজনিত, আর্থিক, পড়াশোনা এবং অন্যান্য বিভিন্ন কারণে মানুষ আত্মহত্যা করেছে। সর্বাপেক্ষা বেশি ৩৫ শতাংশ আত্মহত্যা করেছে বিভিন্ন পারিবারিক কারণে, এরপরেই ২৪ শতাংশ আত্মহত্যা করেছেন সম্পর্কজনিত কারণে, আর্থিক ও লেখাপড়াজনিত কারণে আত্মহত্যার পরিমাণ যথাক্রমে ৪ ও ১ শতাংশ এবং সর্বশেষ অজানা বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৩২ শতাংশ।
আত্মহত্যার মিছিলে সবচেয়ে বেশি ঢাবির
গত ১৫ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র হাফিজুর রহমানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় তার তিন বন্ধু এলএসডি সেবন করান। এর প্রতিক্রিয়া শুরু হলে তিনি শুধু একটি শর্টস পরে সেখান থেকে বেরিয়ে যান। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে এক ডাব বিক্রেতার ভ্যানে রাখা দা নিয়ে তিনি নিজের গলায় আঘাত করেন।
সুরতহাল প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঘটনার দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৯টা ৪০ মিনিটে অজ্ঞাতনামা হিসেবে তার মৃত্যু হয়। গত ২৩ মে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে হাফিজুরের ভাই তার লাশ শনাক্ত করেন।
গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর সকালে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তৌহিদুল ইসলাম সিয়াম আত্মহত্যা করেছেন। ঘটনার দিন সকালে ওই ছাত্রের বাসায় ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন।
এর আগে ২৫ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর আজিমপুর স্টাফ কোয়ার্টারের নিজ কক্ষে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন রুমানা ইয়াসমিন। তিনি পুষ্টিবিজ্ঞানের সাবেক ছাত্রী ছিলেন। এছাড়া ৩৭তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়ে আনসার বাহিনীর সহকারী পরিচালক হিসেবে ট্রেনিংরত ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি বগুড়ায়।
গত ১২ নভেম্বর আত্মহত্যা করেছেন অনিন্দ ইশরাক নামে ঢাবির আরেক শিক্ষার্থী। তিনি আইবিএ এর ২২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।
২৪ সেপ্টেম্বর রাতে পারিবারিক কলহের জেরে ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক ছাত্র জাকারিয়া বিন হক শুভ আত্মহত্যা করেছেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের বাসা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ।
২১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ফার্মগেটের একটি আবাসিক হোটেল থেকে কামরুল বাহার নামে ঢাবির ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংবিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি অমর একুশে হলের আবাসিক ছাত্র। তার বাড়ি ফেনীতে। কামরুল জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে সম্প্রতি নিয়োগ পেয়ে যোগদান করেন। এর আগে তিনি একটি চিরকুট লিখে রেখে গেছেন।
গত ১১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কাঁঠালবাগানের একটি বাসার ৯ তলার বারান্দা থেকে পড়ে আসিফ ইমতিয়াজ খান জিসাদ নামে ঢাবির সাবেক এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তবে ঢাবির ওই শিক্ষার্থীর পরিবার এবং বন্ধুদের দাবি, তাকে বারান্দা থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আসিফ ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০০৫-২০০৬ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন।
১৭ আগস্ট নিজ বাড়িতে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ইমাম হোসাইন নামের এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। এর আগে ফেসবুকে তিনি ‘আল-বিদা’ লিখে স্ট্যাটাস দেন ওই শিক্ষার্থী। তার বন্ধুরা জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে ডিপ্রেশনে ছিলেন। জানা গেছে, ইমাম হোসাইনের বাড়ি বরিশাল জেলার উজিরপুর থানায়।
পছন্দের ছেলেকে বাদ দিয়ে অন্যের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নেয়ায় গত ২৬ অক্টোবর আত্মহত্যা করেন ঢাবির ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী ফারিহা তাবাসসুম রুম্পা। বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষে পড়ুয়া রুম্পার গ্রামের বাড়ি পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানাধীন দীঘায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলের আবাসিক ছাত্রী তিনি।
তীব্র বিষন্নতা ও মানসিক চাপ থেকেই আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেন ঢাবির দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শুভজ্যোতি মন্ডল (২২)। ১৪ অক্টোবর বিকেলে সংবাদ পেয়ে আদাবর মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির ৪ নম্বর রোডের ১৪১ নম্বর বাড়ি থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত শুভজ্যোতি ঢাবির চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী।
২২ জুন শ্বশুরবাড়ি থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়া খাতুনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সুমাইয়া নাটোর সদরের হরিশপুর বাগানবাড়ি এলাকার মোস্তাক হোসাইনের স্ত্রী। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের এ শিক্ষার্থী মাস্টার্স পরীক্ষা শেষে ফলাফলের অপেক্ষমান ছিলেন। এসময়ের মধ্যে তিনি বিসিএস ও সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বলে জানা গেছে।
গত বছরের ৮ এপ্রিল তরুণ সেন নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গ্র্যাজুয়েট আত্মহত্যা করেন। তিনি দর্শন বিভাগে ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিলেন। সরকারি চাকরি না পাওয়ায় এবং চাকরির বয়স শেষ হওয়ায় আত্মহত্যা করেন তরুণ সেন। জানা গেছে, করোনাকালে তরুণ সেন বেকারত্ব এবং পারিবারিক অভাব অনটনে নিয়ে হতাশায় ছিলেন। তিনি ঘুমের ঔষধ খেয়ে আত্মহত্ম্যা করেন। গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলায়।
আত্মহত্যার মিছিলে শাবিপ্রবির ৪ শিক্ষার্থী
গত ৬ মে মধ্যরাতে নিজ বাসার পাশে আমগাছের ডালের সঙ্গে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আলমগীর কবির। পরে তার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। আলমগীর কবির বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ২০১২-১৩ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাড়ি সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায়।
এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে তৌহিদুল আলম প্রত্যয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। ঘটনার দিন রাত সাড়ে ৮টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী নতুন বাজার এলাকায় নিজ মেসে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।
গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বগুড়ার নিজ গ্রামের বাসায় আছিয়া আক্তার নামে বিশ্ববিদ্যালয়টির এক ছাত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। রাতের কোন এক সময় তিনি গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফাঁসিতে ঝুলেন। নিহত আছিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
একই বছরের ৬ আগস্ট গলায় ফাঁস দিয়ে তোরাবি বিনতে হক নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেছেন। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০১৮-১৯ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাড়ি নেত্রকোনার চল্লিশা ইউনিয়নের মোগরাটিয়া গ্রামে।
মেডিকেলের ৩ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা
অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে লুৎফর রহমান (২৭) নামে রাজশাহীতে এক চিকিৎসক আত্মহত্যা করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২২ মার্চ ভোর সাড়ে চারটার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ডা. লুৎফর রহমান জেলার দুর্গাপুর উপজেলার ভবানিপুর এলাকার বাসিন্দা। তিনি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের এমবিবিএস ৫৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে হেপাটোলজি বিষয়ে এমডি করছিলেন।
নিজ দেশে ফিরে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজে (সাবেক ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ) অধ্যয়নরত এক ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যা করা ওই শিক্ষার্থীর নাম মোওসা আবু জামি (২৩)। তিনি কলেজের ২৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। গত ১৩ এপ্রিল ফরিদপুর থেকে দেশে ফিরে যান আবু জামি। ২৩ এপ্রিল ফিলিস্তিনের দূতাবাস থেকে ফোন করে কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা.মোস্তাফিজুর রহমানকে ওই শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর নিশ্চিত করে ওই শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর নিশ্চিত করে।
২২ জানুয়ারি রাত রাজশাহীতে ইকবাল জাফর শরীফ (২৪) নামে এক ভারতীয় মেডিকেল শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ইকবাল জাফর শরীফ রাজশাহীর বেসরকারি বারিন্দ মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার রঘুনাথগঞ্জের শ্মশানঘাট এলাকার মোজাম্মেল হোসেন পিন্টুর ছেলে।
রাবির দুই শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা
চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ঘটনার দিনে রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী মির্জাপুর এলাকার একটি ছাত্রীনিবাস থেকে ওই ছাত্রীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। মারা যাওয়া ছাত্রীর নাম মোবাসসিরা তাহসিন ওরফে ইরা। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁর বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলায়। আত্মহত্যার আগে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসও দেন তিনি।
এর আগে ১৯ ডিসেম্বর দেবজ্যোতি বসাক পার্থ নামে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। পার্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
চবি দুই শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা
গত ৫ মার্চ রাত তিনটার দিকে নিজ বাড়িতে তিনি আত্মহত্যা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী নাইমুল হাসান। তিনি চবির রসায়ন বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের ছাত্র ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলার সোনাইপুর গ্রামে। মৃত্যুর আগে তিনি একটি সুইসাইড নোট লিখে গেছেন। চিরকুটে নাইমুল হাসান লিখেছেন, আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। আমার বেঁচে থাকার কোনো ইচ্ছা নেই। তাই আমি এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি। আমার জন্য যদি কেউ কখনো কষ্ট পেয়ে থাকেন, পারলে মাফ করে দিয়েন।
গত বছরের ২০ জুলাই চট্টগ্রাম মহানগরীর দেওয়ানবাজার এলাকায় নিজ বাসায় গলায় ওড়না পেঁচিয়ে নীলম ধর অর্পা (২৩) নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেন। অর্পা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী ছিলেন। তিনি ২০১৯ সালে লোকপ্রশাসন থেকে মাস্টার্স পাশ করে বের হন। বর্তমানে তিনি সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে খুবি দুই শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা
ওড়না দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং ডিসিপ্লিনের ২০ ব্যাচের শিক্ষার্থী আফসানা আফরিন সুমি (১৯)। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দুপুরে নিজ বাসায় গলায় ফাঁস দিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন। তিনি নগরীর ফুলবাড়ি গেট মিরেরডাঙ্গা এলাকার ইউনুচ আলীর মেয়ে।
চিরকুট লিখে আত্মহত্যা করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান ডিসিপ্লিনের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী আব্দুর রহিম। ৩ সেপ্টেম্বর মানিকগঞ্জ জেলা শহরের দক্ষিণ সেওতা এলাকায় নিজ বাড়িতে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেন তিনি। প্রেমঘটিত সম্পর্কে অবনতির কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। মৃত্যুর আগে এক চিরকুটে লিখে গেছেন, ‘আমার পরিচিত মানুষগুলোকে আমার মৃত্যুর খবরটা জানিয়ে দিও’।
ড্যাফোডিলের দুই শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা
বিয়ের দাবিতে ঢাকার আশুলিয়ায় প্রেমিকার বাড়িতে এসে বিষ পান করে গত ২৪ এপ্রিল আসাদুজ্জামান জলিল (২৪) নামের এক ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ঘটনার দিন দুপুরে আশুলিয়ার ডেন্ডাবর এলাকায় প্রেমিকার বাড়িতে বিয়ের দাবিতে এসে বিষপান করেন। পরে বিকেলে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
এর আগে গত বছরের ১০ জুন বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলায় বিশ্ববিদ্যালয়টির কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের স্নাতকের শিক্ষার্থী রবীন্দ্র চন্দ্র বর্মণ (২২) ও তাঁর মা সরস্বতী বর্মণ (৪৭) বিষপানে আত্মহত্যা করেন। রবীন্দ্র চন্দ্রের বাবা নিতাই চন্দ্র বর্মণ বলেন, অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা দিতে না চাওয়ায় আমি আমার ছেলেকে একটু বকাঝকা করি; আর বিষয়টি নিয়ে আমার স্ত্রীর সাথেও রাতে আমার ঝগড়া হয়। এই ক্ষোভেই আমার ছেলে ও স্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন।
বিইউবিটির দুই শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা
গত ১৯ মে বিকেলে রাজধানীর মিরপুর ২ নম্বর সেকশনের একটি বাসা থেকে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউবিটি) এক শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তার নাম মাহমুদুল হক ওরফে রকি (২৫)। মিরপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সৈয়দ আখতার হোসেন বলেন, ঘটনাস্থল থেকে একটি ‘সুইসাইড নোট’ পাওয়া গেছে। সেখানে তিনি মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী করেননি। চিরকুটে লেখা রয়েছে, মানসিক যন্ত্রণা থেকেই আত্মহত্যা করেছেন তিনি। এর সূত্র ধরে ঘটনাটি আত্মহত্যা বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তিনি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
নির্মাণাধীন ৯ তলা ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে গত বছরের ১ ডিসেম্বর জান্নাতুল হাসিন নামে বিশ্ববিদ্যালয়টির এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেছেন। কুমিল্লা নগরীর ঝাউতলা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। তিনি বিইউবিটি থেকে স্নাতক শেষ করে একটি ব্যাংকে ইন্টার্নশিপ করছিলেন।
বশেমুরবিপ্রবি দুই ছাত্রীর আত্মহত্যা
১০ জুলাই পারিবারিক কলহের জেরে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) সাদিয়া কুতুব নামের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেন। তিনি সমাজবিজ্ঞান দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ওইদিন দুপুরে গোপালগঞ্জে তার নিজ বাড়িতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
১১ অক্টোবর মনীষা হিরা নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। হিরা ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ওইদিন সকালে গোপালগঞ্জের সবুজবাগে তাদের ভাড়া বাসার কক্ষে মনীষার ঝুলন্ত মৃতদেহ দেখতে পায় তার বাবা-মা।
আত্মহত্যার মিছিলে প্রেমিকযুগল
গত ১ আগস্ট সুপ্রিয়া দাস নামের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তিনি গণিত বিভাগের চতুর্থ ব্যাচের ছাত্রী ছিলেন। ওইদিন সন্ধ্যা ৬টায় ফারিদপুরের নিজ বাসায় তিনি আত্মহত্যা করেন।
এর আগে ১৫ জুন সুপ্রিয়ার প্রেমিক তপু মজুমদার আত্মহত্যা করে। তার সহপাঠীরা জানান, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) প্রাক্তন ছাত্র তপু মজুমদারের সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক থেকেই প্রেমের সম্পর্ক ছিল সুপ্রিয়ার। দুজনের বাসা একই এলাকায়।
অভিমানে গলায় ফাঁস ইবির দুই ছাত্রীর
গত ২ জানুয়ারি পারিবারিক কলহের জেরে অভিমান করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাবিহা সুহা আত্মহত্যা করেছেন। সন্ধ্যা ৭টার দিকে নিজ বাড়িতে গলায় ফাঁস দেন তিনি। সুহা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগে পড়তেন।
ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার শেখপাড়া গ্রামের নিজ বাড়িতে ২ অক্টোবর আত্মহত্যা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী উলফাত আরা তিন্নি। ওই শিক্ষার্থীর পরিবারের অভিযোগ, তার বড় বোনের সাবেক স্বামীর পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে অভিমান-লজ্জায় আত্মহত্যা করেছেন। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্রী ছিলেন।
শেকৃবি ছাত্রীর আত্মহত্যা
৯ নভেম্বর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) জুলহাস সিলভিয়া নামে এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেন। ওইদিন যশোরের নতুন খয়েরতলা এলাকার ভাড়া বাসায় তিনি আত্মহত্যা করেন। জানা যায়, জুলহাস সিলভিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী এবং কৃষকরত্ন শেখ হাসিনা হলের আবাসিক ছাত্রী ছিলেন।
নর্থ সাউথের ছাত্রীর আত্মহত্যা
১৩ নভেম্বর রাজধানীর উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের একটি বাসায় খন্দকার ফাকিহা নুর (২২) নামে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে বলে জানিয়েছেন স্বজনরা। ওইদিন বেলা ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
হাজী দানেশ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর আত্নহত্যা
গত ১৯ সেপ্টেম্বর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ১৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী সুমন রায় সিধু আত্মহত্যা করেন। জানা গেছে, পরিবারের অর্থনৈতিক দূরাবস্থার কারণে সুমন দীর্ঘদিন থেকেই মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। ঘটনার আগের দিন সুমন তার মার কাছে কিছু টাকা চায়। টাকা না পেয়ে অভিমান করে সে। পরিবারের ধারণা ওই ঘটনার জেরেই আত্মহত্যা করেছে সুমন।
‘হতাশায়’ জাবি ছাত্রীর আত্মহত্যা
গত বছরের ৩ নভেম্বর রাত ১২টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ফাতেমা এলিন ফুজি আত্মহত্যা করেন।রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার জাদুঘর মোড় এলাকায় ওই ছাত্রী তার এক বান্ধবীর মেসে গলায় রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন বলে জানা গেছে।
ফুজির গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলায়। ফুজির বান্ধবী জানান, ফুজির মা মারা গেলে তার বাবা আরেকটি বিয়ে করেছেন। সৎমা ও বাবার সঙ্গে পারিবারিক ঝামেলার কারণে খুবই হতাশায় ভুগছিল ফুজি।
মালয়শিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী মৌমিতার মৃত্যু: হত্যা নাকি আত্মহত্যা?
ভিকারুন্নেসা নুন স্কুল এন্ড কলেজের কলাবাগান শাখা থেকে মাধ্যমিক পাস করার পর শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে এশিয়ান প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির মালেশিয়া শাখায় পড়ালেখা করছিলেন তাজরিন মোস্তফা মৌমিতা। গতবছর করোনার কারণে দেশে আসেন। অনলাইনে নিয়মিত ক্লাস করছিলেন তিনি। থাকতেন পরিবারের সঙ্গে ধানমন্ডির ৮ নম্বর রোডের ২ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায়।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে সাততলা ভবনটির ছাদে ওঠেন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে পরিবার জানতে পারে, মৌমিতা ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছেন। তার মরদেহের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকেরা বলছেন, উঁচু ছাদ থেকে পড়ে মৌমিতার মৃত্যু হয়েছে। তবে মৌমিতার পরিবার তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ করেছেন।
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তানসেন রোজ বলেন, তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে আমি একজন তরুণ হিসেবে শঙ্কিত। যে হারে মানসিক সমস্যা বাড়ছে সে হারে বাড়ছে না সচেতনতা। যে কারো আত্মহত্যা করার পেছনে আমাদের পরিবার, সমাজ ও দেশেরও দায় রয়েছে। একটা মানুষ কেনো আত্মহত্যা করে তা নিয়ে নির্মোহ বিশ্লেষণ করা দরকার।
তিনি আরও বলেন, আত্মহত্যা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার আগেই দেশের নীতিনির্ধারকসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা যারা তরুণ আছি সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখার দায়িত্ব তাদেরই। আমাদের একটা কথা মাথায় রাখতে হবে আত্মহত্যার কারণগুলো আমাদের কাছে যত তুচ্ছই হোক না কেন, আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির কাছে তা অনেক বড় একটি ব্যাপার। তাই মানসিক স্বাস্থ্যকেও গুরুত্ব দিয়ে প্রত্যেকটা নাগরিকের বেঁচে থাকার পরিবেশ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রসহ প্রত্যেকেরই দায়িত্ব ও কর্তব্য।
“প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে আমাদের জোর দাবি, প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা হয়। পাশাপাশি পরিবার কীভাবে আত্মহত্যা কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে সে বিষয়ে রূপরেখা দাঁড় করানো দরকার। সবাইকে সচেতন না করতে পারলে ফলাফল অধরাই থেকে যাবে।”