‌‘বাঁচাও, বাঁচাও’ চিৎকারেও কেউ এগিয়ে আসেনি, উল্লাস করছিল ধর্ষকরা

সিলেট এমসি কলেজে ধর্ষণ
সিলেট এমসি কলেজে ধর্ষণ

স্বামীকে আটকে রেখে গৃহবধূকে ধর্ষণের ঘটনায় প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে উত্তাল সিলেট এমসি কলেজ।  ধর্ষণের অভিযোগ ওঠা ছাত্রলীগের কর্মীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে ইতোমধ্যেই বিক্ষোভ হয়েছে। দাবি উঠেছে কঠোর শাস্তির।

জানা যায়, ধর্ষণের শিকার তরুণীর বাড়ি সিলেটের দক্ষিণ সুরমায়। তিনি শুক্রবার বিকেলে স্বামীসহ নিজেদের গাড়িতে করে শহরের টিলাগড় এলাকায় এমসি কলেজে বেড়াতে যান। গাড়ি চালাচ্ছিলেন তাঁর স্বামী। সন্ধ্যার পর কলেজের প্রধান ফটকের সামনে গাড়ি রেখে তাঁরা একটি দোকানে কেনাকাটা করেন। পরে গাড়িতে ফিরে তাঁরা গল্প করছিলেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে কয়েকজন যুবক তাঁদের গাড়ির কাছে আসে। তারা তরুণীকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে স্বামী বাধা দেন। তখন তাঁকে মারধর করে দুর্বৃত্তরা। এরপর অংশ নেন ধর্ষণে।

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, নিজেকে রক্ষা করতে ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে চিৎকার করেছিলেন ও গৃহবধূ। স্বামীও চিৎকার করছিলেন। এ সময় উল্লাস করছিল ছাত্রলীগ কর্মীরা। চিৎকারের আওয়াজ রোধ করতে তারাও করে চিৎকার। চিৎকার শুনলেও হোস্টেলে থাকা শিক্ষার্থীরা কেউ এগিয়ে আসেনি। গৃহবধূর স্বামী এক বর্ণনায় জানান, ধর্ষণের সময় কয়েকজন পাহারা দিচ্ছিলো। তখন ওই ভবনের ২য় তলা থেকে এক যুবক বারান্দায় বের হলে তাকে ধমক দিয়ে চলে যেতে বলে ছাত্রলীগের কর্মীরা। দূর থেকে আমি বিষয়টি দেখতে পাই। তবে তারা ফোন করে শাহপরান থানা পুলিশকে ঘটনাটি জানায়।

যদিও পুলিশ আসতে আসতেই গণধর্ষণের শিকার হন ওই বধূ। রাত ৯টার দিকে যখন পুলিশ এমসি কলেজের হোস্টেলে পৌঁছায় ততক্ষণে ধর্ষকরা সটকে পড়ে। হোস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন স্বামী-স্ত্রী। গণধর্ষণের কারণে স্ত্রী শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে স্বামী কাঁদছিলেন। পুলিশকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন স্বামী-স্ত্রী দু’জনই। এরপর পুলিশ তাদের হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে।

কলেজ সূত্রে জানা গেছে, মামলার আসামী সাইফুর, রনি ও মাহফুজুর ইংরেজি বিভাগের স্নাতক শ্রেণির অনিয়মিত শিক্ষার্থী। অর্জুন সাবেক শিক্ষার্থী। রবিউল বহিরাগত। ছয় ধর্ষকের কেউ সাবেক শিক্ষার্থী আবার কেউ বহিরাগত হলেও এমসি কলেজের ছাত্রাবাসই ছিল তাঁদের ঠাঁই।

এর আগে ২০১২ সালের ৮ জুলাই ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষের জেরে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে ছাত্রাবাসের ৪২টি কক্ষ ভস্মীভূত হলে নতুন করে তা নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়। প্রথমে কেউ শনাক্ত না হলেও আদালতের হস্তক্ষেপে ছাত্রলীগ-শিবিরের বেশ কয়েকজনকে অভিযুক্ত করা হয়। তবে অগ্নিসংযোগ মামলার কার্যক্রমও থমকে আছে। এরই ফাঁকে ছাত্রলীগ পরিচয়ে আবার ছাত্রাবাস নিয়ন্ত্রণ নেয় একটি পক্ষ। যদিও এমসি কলেজ ছাত্রলীগ তো বটেই, সিলেট জেলা ও মহানগর শাখায় ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই।

নেপথ্যে সেই রনজিত: ২০১২ সালে কলেজ ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন সময়ে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার নেপথ্যে দুই বন্ধু আজাদ ও রণজিতের নাম এসেছিল। যদিও জেলা আওয়ামী লীগ নেতা রণজিত ও মহানগর নেতা আজাদ সবসময় তা অস্বীকার করেছেন। রণজিত সরকার জেলা আওয়ামী লীগের আগের কমিটিতে যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন।

শুক্রবার রাতে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ধর্ষণের ঘটনার পরও আওয়ামী লীগ নেতা রণজিতের নাম এসেছে। ন্যক্কারজনক এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাই ছাত্রলীগের রণজিত গ্রুপের কর্মী হিসেবেই পরিচিত। জাহাঙ্গীর নামে যুবলীগের এক নেতা সরাসরি তাদের নিয়ন্ত্রণ করেন বলে পুলিশসহ সংশ্নিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এলাকার অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গণধর্ষণের ঘটনায় করা মামলায় যে ছয়জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তারা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত। নগরীর টিলাগড় এলাকায় সরকার দলের কর্মীর পরিচয়ে চাঁদাবাজি, জায়গা দখলসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে তাদের ব্যবহার করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে তারা এমসি কলেজ ছাত্রাবাসকে আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।

এ ক্ষেত্রে নিজেদের ব্যর্থতার দায় অবশ্য নিচ্ছেন এমসি কলেজের অধ্যক্ষ সালেহ আহমদ ও ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক জামাল উদ্দিন। ছাত্রাবাসের যে ব্লকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, সেই ব্লকের তত্ত্বাবধায়ক জামাল উদ্দিন বলেন, রাতের আঁধারে যদি কেউ ছাত্রাবাসে থাকে, তার দায় অবশ্যই নিতে হবে।

অন্যদিকে অধ্যক্ষ সালেহ আহমদ বলেন, ‘পুরো ঘটনায় আমরা বিব্রত, লজ্জিত ও মর্মাহত।’ তিনি আরো জানিয়েছেন- হোস্টেল থেকে ওদের বার বার তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ওরা বারণ মানেনি। সবার অগোচরে এসে আবার হোস্টেলেই বসবাস শুরু করে। তিনি জানান- ‘ধর্ষণের ঘটনার পর আমরা এখন ওই হোস্টেলটিকে সিলগালা করে দেবো। কাউকে সেখানে বসবাস করতে কিংবা ঢুকতে দেয়া হবে না।’

সিলেট মহানগর পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) জ্যোতির্ময় সরকার জানিয়েছেন- ‘ঘটনার সময় ধর্ষিত ও তার স্বামী সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিল। হোস্টেল থেকেই পুলিশকে ফোন করা হয়। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে তাদের উদ্ধার করে।’


সর্বশেষ সংবাদ