ঢাকার অপরাধচিত্র

সবচেয়ে বেশি চোর-ধর্ষক-ডাকাত তেজগাঁও-রমনা-মিরপুরে, কম লালবাগে

মহানগর দায়রা জজ আদালত
মহানগর দায়রা জজ আদালত  © সংগৃহীত

প্রায় দুই কোটি মানুষের চাপে নুয়ে পড়া এক শহরের নাম রাজধানী ঢাকা। এখানে দালান-কোঠার ছায়ায় যেমন বাস করেন নিরীহ মানুষ, তেমনি ছায়ার ভেতর ঘাপটি মেরে থাকে অসংখ্য অপরাধী। জনবহুল এই মহানগরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কতটা তৎপর, কত ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে আর কীভাবে সেগুলোর মোকাবিলা করছে পুলিশ—এসব প্রশ্নের উত্তর মেলে পুলিশের নথিপত্র ঘেঁটে।

পুলিশের বিশেষ শাখার (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) নথি বলছে, ঢাকা শহরের কিছু এলাকা অপেক্ষাকৃত কম অপরাধপ্রবণ হলেও কিছু এলাকায় অপরাধের মাত্রা অনেক বেশি। অপরাধীদের ধরার পাশাপাশি তাদের ‘প্রোফাইল’ তৈরি করছে পুলিশ। সেই তথ্যে দেখা যাচ্ছে, অনেক অপরাধী একের পর এক অপরাধ করে যাচ্ছে, গ্রেপ্তার হচ্ছে, আবার জামিনে বের হয়ে নতুন করে জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে। পুলিশের কাছে আপরাধের যে হিসাব পাওয়া যায় তা মূলত প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে তৈরি। তবে পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়ে সন্দেহজনকভাবে কাউকে গ্রেপ্তার করলে সেই তথ্যও থাকে হিসেবে।

‘বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলির শহর’ ঢাকায় মহানগর পুলিশ গত ২ মাসে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) ৭ হাজার ৪০৭ জনকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার করেছে। সে হিসেবে গড়ে প্রতি মাসে গ্রেপ্তার হয়েছেন সাড়ে তিন হাজারের বেশি। এই সময়ে মামলা হয়েছে ৩ হাজার ৩২০টি। গড়ে প্রতি মাসে মামলা হয় দেড় হাজারের বেশি। 

পুলিশের হিসেবে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি যে অপরাধের মামলা হয় তা হলো চুরি৷ গত ২ মাসে এ অপরাধের মামলা হয়েছে ২৩৭টি। এরপর ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতন- ২৩৭টি। এর বাইরে পুলিশ উদ্ধার অভিযানের পর যে মামলা করে তাতে শীর্ষে আছে মাদকদ্রব্য। এই সময়ে পুলিশ মাদকের মোট মামলা করেছে ১ হাজার ১২টি। এ সময় আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধে মামলা হয়েছে ২১৮টি।

অপরাধের তালিকায় হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, প্রতারণা- বলতে গেলে সব আছে৷ পুলিশ তাদের নিয়ম অনুযায়ী অপরাধের যে ধরন নির্ধারণ করে, তার মধ্যে আছে ডাকাতি, খুনসহ ডাকাতি, দস্যুতা, খুন, দাঙ্গা, আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার আইন), নারী ও শিশু নির্যাতন, অপহরণ, চুরি, ছিনতাই, অস্ত্র, মাদক, প্রতারণা, জালিয়াতি, দুদক, বিশেষ ক্ষমতা আইন, পুলিশের ওপর হামলা, দাঙ্গা, অপহরণ, চাঁদা, মুক্তিপণ, পাচার প্রভৃতি৷ এসব অপরাধের আবার নানা উপ-বিভাগ আছে।

পুলিশের হিসেবে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি যে অপরাধের মামলা হয় তা হলো চুরি ৷ গত ২ মাসে এ অপরাধের মামলা হয়েছে ২৩৭ টি। এরপর ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতন- ২৩৭টি। এর বাইরে পুলিশ উদ্ধার অভিযানের পর যে মামলা করে তাতে শীর্ষে আছে মাদকদ্রব্য। এই সময়ে পুলিশ মাদকের মোট মামলা করেছে ১ হাজার ১২টি৷ এ সময় আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধে মামলা হয়েছে ২১৮টি।

ঢাকায় অনেক দালান-কোঠা থাকলেও চুরির মধ্যে সিধেল চুরিই বেশি ছিল। তবে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের এই দু’মাসে এই অপরাধের প্রবণতা অনেকটা কমেছে। সিধেল চুরি হলো শাবল দিয়ে সিঁদ কেটে চুরি৷ ওই ২ মাসে এই ধরনের চুরির মামলা হয়েছে মাত্র ৭৯টি। এছাড়া আছে গ্রিল কেটে চুরি, তালা ভেঙে চুরি, গাড়ি চুরি, তার চুরিসহ আরো অনেক ধরনের চুরি। রাজধানী শহরে গবাদি পশু চুরির ঘটনাও ঘটেছে ৫টি।

সবচেয়ে বেশি চুরি হয় তেজগাঁও এলাকায়। তারপরে রয়েছে রমনা ও মিরপুর। সবচেয়ে কম চুরি হয় লালবাগ এলাকায়। উত্তরা এবং গুলশানেও চোরদের উৎপাত কম নয়। ছিনতাইয়েও সবচেয়ে এগিয়ে আছে আছে তেজগাঁও এলাকা। তারপরে উত্তরা, মিরপুর ও ওয়ারির অবস্থান। গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চে খুনের ঘটনা থানায় রিপোর্ট করা হয়েছে ৬৮টি। এই তালিকায় গণপিটুনিতে ২০২৪ সালে ১২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ৯৬ জন। অন্যদিকে এই সময়ে সবচেয়ে বেশি ডাকাতি হয়েছে মিরপুর ও ওয়ারিতে; সবচেয়ে কম গুলশানে।

বর্তমানে ডিএমপির অধীনে প্রায় ৩২ হাজার পুলিশ সদস্য রাজধানীর নাগরিকদের সুরক্ষা ও সেবা নিশ্চিত করতে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। আমরা অপরাধীদের ধরতে অত্যন্ত সচেষ্ট এবং প্রতিটি ঘটনায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করছি।- মুহাম্মদ তালেবুর রহমান, উপ-পুলিশ কমিশনার, ডিএমপি

বিগত বছর আগে যেমন ছিল ঢাকা
২০২৩ সালের একই সময়ে ৩৯৬টি ডাকাতি, ১৬০টি অপহরণ এবং ৮৫৯টি চুরির অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল। একই সালের একই সময়ের খুনের ঘটনায় মামলা ছিল ৯৫৬টি। এছাড়াও ২০২৪ সালে নারী নির্যাতন ১০১টি, অপহরণ ৭টি, ১৬৩টি, অন্যান্য কারণে রুজুকৃত মামলা ৬৬৭টি এবং উদ্ধারজনিত কারণে মামলা ৮৬৬টি অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে।

বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় বিভিন্ন অপরাধে জড়িতদের ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে৷ আটকের সময়ের তথ্যের ভিত্তিতে এই ডাটাবেজ তৈরির কাজ করছে তারা। তবে এখন পর্যন্ত চোর আর ছিনতাইকারীর ডাটাবেজ তৈরিতেই জোর দেয়া হয়েছে বেশি ৷ ঢাকার ৫০টি থানা এলাকায় ৫৪৪ জায়গা চিহ্নিত হয়েছে। ওইসব জায়গায় ছিনতাইকারীরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয়৷ প্রায় পাঁচশ'র মতো ছিনতাইকারীর ডাটাবেজ তৈরি হয়েছে। তবে তাদের সংখ্যা আরো বেশি বলে জানায় পুলিশ। সে হিসেবে ডাটাবেজে তাদের সংখ্যা বাড়বে বলে মত পুলিশের। সংস্থাটি এ-ও বলছে, অন্যদিকে চার হাজার চোরের একটি ডাটাবেজ তৈরির কাজ চলছে। চোরদের নাম-পরিচয় ছাড়াও কোন চোর কোন ধরনের চুরিতে দক্ষ, কতগুলি চুরি করেছে, কতবার গ্রেপ্তার হয়ে ছাড়া পেয়েছে- তা-ও থাকছে ওই ডাটাবেজে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, সাম্প্রতিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে পুলিশের মনোবল কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও বর্তমানে তা কাটিয়ে উঠে পুলিশ আরও দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে নাগরিক সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন, আন্দোলনের পর পুলিশের মনোভঙ্গ কিছুটা হয়েছিল। তবে এখন তা কাটিয়ে উঠে পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালনে আরও সচেষ্ট। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা, পবিত্র রমজান মাস এবং মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরের সময় মানুষের নিরাপত্তা ও সেবা নিশ্চিত করতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

অপরাধ দমন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে ডিএমপির অধীনে প্রায় ৩২ হাজার পুলিশ সদস্য রাজধানীর নাগরিকদের সুরক্ষা ও সেবা নিশ্চিত করতে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। আমরা অপরাধীদের ধরতে অত্যন্ত সচেষ্ট এবং প্রতিটি ঘটনায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করছি।

তিনি আরও বলেন, ডিএমপির বিভিন্ন ইউনিট—যেমন অপরাধ তদন্ত বিভাগ (ডিবি), ট্রাফিক বিভাগ, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও পেট্রোল টিম—সমন্বিতভাবে কাজ করছে যেন নগরবাসী নিরাপদ ও স্বস্তির সঙ্গে জীবনযাপন করতে পারে। আমাদের সদস্যরা মাঠপর্যায়ে শুধু টহলই দিচ্ছে না, বরং গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে অপরাধ সংগঠিত হওয়ার আগেই তা প্রতিহত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

নাগরিকদের সহযোগিতা পেলে আমরা আরও কার্যকরভাবে অপরাধ দমন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা শুধু পুলিশের একার দায়িত্ব নয়, এটি একটি সমন্বিত প্রয়াস—যেখানে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রশাসন সবাইকে সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

‘আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি—অপরাধ কমাতে হলে রিয়েলটাইম ডাটা আমাদের জানা প্রয়োজন। কখন, কোথায়, কী ধরনের অপরাধ ঘটছে, তাৎক্ষণিকভাবে সে তথ্য আমাদের হাতে থাকা উচিত। অপরাধীদের জন্য পরিস্থিতি কঠিন করে তুলতে হবে, যাতে কেউ সহজে অপরাধ করে পার পেয়ে না যায়।’- নাজমুস সাকিব, সহকারী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ বি এম নাজমুস সাকিব দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি—অপরাধ কমাতে হলে রিয়েলটাইম ডাটা আমাদের জানা প্রয়োজন। কখন, কোথায়, কী ধরনের অপরাধ ঘটছে, তাৎক্ষণিকভাবে সে তথ্য আমাদের হাতে থাকা উচিত। অপরাধীদের জন্য পরিস্থিতি কঠিন করে তুলতে হবে, যাতে কেউ সহজে অপরাধ করে পার পেয়ে না যায়। তিনি বলেন, অপরাধ দমন কার্যক্রমে প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বিস্তৃত ও আধুনিক করতে হবে। পর্যাপ্ত লাইটিং, কার্যকর সিসিটিভি মনিটরিং এবং অন্যান্য নজরদারি ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ছাড়া টেকসই সমাধান সম্ভব নয়।  

এ বি এম নাজমুস সাকিব মনে করেন, পুলিশের একার পক্ষে পুরো ঢাকা শহরে কার্যকর নজরদারি চালানো বাস্তবিক অর্থেই কঠিন। তাই আমাদের সামগ্রিকভাবে আরও দক্ষ হতে হবে, বলেন তিনি। 

সম্প্রতি কিশোর অপরাধ ও মাদক সংক্রান্ত অপরাধ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আজকে কেউ অপরাধ করছে, কয়েকদিন পরই সে বের হয়ে আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কারণ তার মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে—আমি আইনকে ফাঁকি দিতে পারব। তাই আমি মনে করি, আমাদের আইন ব্যবস্থায় সংস্কার প্রয়োজন।

অপরাধ দমন ব্যবস্থার কার্যকারিতা বাড়াতে পুলিশ সদস্যদের স্মার্ট ও প্রযুক্তিসম্পন্ন করে তোলার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।পুলিশকে আরও স্মার্ট হতে হবে, তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়াতে হবে, বলেন এই অপরাধবিজ্ঞানী।


সর্বশেষ সংবাদ