এভারেস্টের চূড়ায় গাজীপুরের শাকিল, আবেগাপ্লুত কিষানি মা ও এলাকাবাসী
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ২০ মে ২০২৫, ১১:২৬ AM , আপডেট: ২৩ মে ২০২৫, ১২:৩৪ PM
কক্সবাজার থেকে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি হেঁটে রওনা দেন ইকরামুল হাসান শাকিল। গত ১৯ মে নেপালের স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৬টার দিকে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছান তিনি। পরে গত সোমবার বেলা ২টা ১০ মিনিটে তার ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাসে তার অভিযানের সমন্বয়করা বলেন, ‘এইমাত্র খবর পেলাম, শাকিল সামিট করেছে এবং সুস্থ আছে। ক্যাম্প-৪-এ নেমে এসেছে। নেটওয়ার্ক না থাকায় বিস্তারিত তথ্য এখন দেওয়া যাচ্ছে না।’
পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টে বাংলাদেশের হয়ে আবারও পতাকা ওড়ালেন ইকরামুল হাসান শাকিল। তার এই কীর্তির খবরে খবরে আনন্দের বন্যা বইছে তার বাড়িতে। পাড়া-প্রতিবেশী, দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ভিড় করছে তার বাড়িতে। শাকিলের এই কীর্তিতে গর্বিত এলাকার মানুষ। লোকজন বাড়িতে এসে তার মাকে ঘিরে ধরছেন। অনেকেই তাকে জড়িয়ে ধরে উল্লাস করছেন।
শাকিলের বাড়ি গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের বাগচালা গ্রামে। তার বাবা খবির উদ্দিন একজন কৃষক ছিলেন। ২০১৯ সালে অসুস্থ হয়ে মারা যান। সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে তার কাঁধে। শাকিল তখন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন। ছোট দুই ভাই সজীব আহম্মেদ (২৮) ও সাকিব আহম্মেদকে (২২) নিয়ে শুরু হয় সংগ্রামী জীবন। সংসার ও পড়াশোনার খরচ চালাতে সুপারশপে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। শেষে আর পড়াশোনা এগোয়নি। বেরিয়ে পড়েন অভিযানের নেশায়। তার কিষানি মা সব সময় তাকে অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন।
শাকিলের এভারেস্ট জয়ের গল্প সবার মুখে মুখে। তারা শাকিলের বাড়িতে এসে উচ্ছ্বাস-আনন্দ প্রকাশ করছেন। পথে-ঘাটে, হাটবাজারে সবাই তার সুনাম করছেন। সন্তানের এমন প্রশংসা পেয়ে আবেগাপ্লুত ও গর্বিত শাকিলের মা শিরিনা বেগম।

দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে আলাপকালে শাকিলের মা শিরিনা বেগম বলেন, আমার শাকিল গত ১৯ আমাকে সর্বশেষ ফোন করে বলেছে, ‘মা, আমি এভারেস্টের চূড়ায় উঠতেছি, ভালো আছি, তোমরা চিন্তা কোরো না।’ এরপর থেকে শাকিলের সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারিনি। খুব চিন্তায় ছিলাম এত উঁচু পাহাড়ে উঠবে। পরে সোমবার ২টার দিকে খবর পাই সে পাহাড় জয় করেছে। এতে আমি খুবই আনন্দিত ও গর্বিত হয়েছি। তার এই কাজের জন্য দেশের মুখ উজ্জল হয়েছে, সারা দেশের মানুষ আমার ছেলেকে চিনেছে, এলাকার আশপাশের মানুষ আমার বাড়িতে আসছে।
তিনি আরও বলেন, আমার ছেলে ছোটবেলা থেকে অনেক পরিশ্রমী ছিল। সে লেখাপড়ায় ভালো ছিল। লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেত। শাকিল বাংলাদেশ ও ভারতে আরও তিনটি প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়েছে। তার বাবা অসুস্থ থাকার সময় যত চিকিৎসা খরচ তাকে করতে হয়েছে। তিনি মারা যাওয়ার পর শাকিলের বলল সংসার দেখতে হবে। আর পড়ালেখা করা সম্ভব নয়। আমি তাকে সাহস দিয়েছি। একদিন বলল পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ে উঠবে। আমি বললাম বাবা, সেখানে যেতে তো অনেক টাকা লাগে। ছেলে বলল, আমার সব খরচ বহন করবে এজেন্টরা। তারপর আমি অপেক্ষায় ছিলাম কবে আমার শাকিল জয় করে সবার মুখ উজ্জল করে। আজ তার নাম-ডাক দেশে-বিদেশে। মা হয়ে এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কী হতে পারে? সবাই আমার শাকিলের জন্য দোয়া করবেন।
ইকরামুলের ছোট ভাই সাকিব আহম্মেদ বলেন, আমার ভাইয়ের অর্জনে আমরা গর্বিত। ভাই তার পরিশ্রমের ফল হাতে পেয়েছেন। আমরা সুস্থভাবে তার ফিরে আসার অপেক্ষায় রয়েছি।
ইকরামুল হাসান তার এই অভিযানের নাম দেন ‘সি টু সামিট’, অর্থাৎ সমুদ্র থেকে শৃঙ্গ। সে লক্ষ্যেই গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে কক্সবাজারের ইনানী সমুদ্রসৈকত থেকে এভারেস্টচূড়ার উদ্দেশে হাঁটা শুরু করেন। চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা ও মুন্সীগঞ্জ হয়ে ১২ দিন পর ঢাকায় পৌঁছান তিনি।

কয়েক দিন বিরতি দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করেন শাকিল। গাজীপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ হয়ে ২৮ মার্চ পৌঁছান উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে। পরদিন বাংলাদেশ থেকে প্রবেশ করেন ভারতে। দেশটির জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং হয়ে ৩১ মার্চ পা রাখেন নেপালে। এভাবে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার পথ হেঁটে গত ২৯ এপ্রিল এভারেস্ট বেজক্যাম্পে পৌঁছান ইকরামুল হাসান শাকিল।
শাকিলের এমন অর্জনে উচ্ছ্বসিত এলাকার লোকজন বলেন, শাকিল একজন সংগ্রামী ছেলে। ছোট থেকেই সে পরিশ্রমী। ইচ্ছাশক্তির কারণে তিনি লক্ষ্যে পৌঁছেছেন। তার এই সফলতায় শুধু এলাকাবাসী নয়, পুরো বাংলাদেশ আজ গর্বিত। বিশ্ব পর্বতারোহণের ইতিহাসেও শাকিলও আজ উদাহরণ, এটা ভাবতেই আমাদের কাছে ভালো লাগে। তার এই প্রচেষ্টা ভবিষ্যৎ তরুণদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
ফুলবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. মফিজ উদ্দিন মোল্লা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি এই মুহূর্তে ইকরামুল হাসান শাকিলের বাড়িতেই অবস্থান করছি। ছোটবেলা থেকেই সে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়াত, অভিযান পছন্দ করত বেশি। আজ তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তার এই বিশাল কীর্তিতে আমাদের এলাকার সুনাম অনেক বেড়ে গেছে। আমরা খুবই আনন্দিত ও গর্বিত। শাকিলের পর্বত জয়ের পর আমাদের উপজেলা ইউএনও মহোদয় সার্বিক খোঁজ রাখছেন। তিনি সব ধরনের সহায়তার জন্য বলেছেন।