ড. ইউনূস ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে 'আদিবাসী' সম্বোধন করায় ঢাবিতে প্রতিবাদ 

‘সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শিক্ষার্থী সমাজ’ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে এ প্রতিবাদ সমাবেশ
‘সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শিক্ষার্থী সমাজ’ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে এ প্রতিবাদ সমাবেশ  © টিডিসি ফটো

জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদেরকে 'আদিবাসী' বলে সম্বোধন করার প্রতিবাদে এবং 'আদিবাসী' শব্দটি প্রত্যাহারের দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। 

বুধবার (২৮ আগস্ট) দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্যের সামনে ‘সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শিক্ষার্থী সমাজ’ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে এ প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। 

গত ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদেরকে আদিবাসী’ বলে সম্বোধন করেন। প্রধান উপদেষ্টার ওই সম্বোধনের প্রতিবাদে ও আদিবাসী শব্দটি প্রত্যাহারের দাবীতে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এ প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। প্রতিবাদ সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বলেন, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ বললে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

আরও পড়ুন : এক সপ্তাহের মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম চালু হবে: ঢাবি উপাচার্য

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদেরকে 'আদিবাসী' বলে সম্বোধন করার প্রতিবাদে কেন এ প্রতিবাদ তা সমাবেশে ব্যাখ্যা করেন সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শিক্ষার্থী সমাজের আহ্বায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মুহম্মদ জিয়াউল হক। তিনি বলেন, আদিবাসী বলতে বুঝায় কোনো দেশ বা স্থানের আদিম অধিবাসী বা অতিপ্রাচীনকাল থেকে বসবাসরত জনগোষ্ঠীই ওই অঞ্চলের আদিবাসী। সেই অর্থে বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে বসবাসরত বাঙালিরাই এ দেশের আদিবাসী। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন যেসব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা উপজাতি আছে তাদের আদিনিবাস কারো বাংলাদেশ নয়, বরং ভারত, মায়ানমার বা তার আশেপাশের এলাকাগুলো। মারমা নৃগোষ্ঠীর আদিনিবাস মায়ানমা বা মায়ানমার, লুসাই নৃ-গোষ্ঠীর আদিনিবাস ভারতের লুসাই পাহাড়, চাকমা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আদিনিবাস ত্রিপুরার কাছাকাছি চম্পক নগর, ত্রিপুরা (তিপ্রা) ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আদিনিবাস ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, মণিপুরীদের আদিনিবাস ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্য, ম্রো বা মুরং-দের আদি নিবাস মায়ানমারের আরাকান, রাখাইনদেরও আদিনিবাস মায়ানমার। অর্থাৎ এসব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আদিনিবাস বাংলাদেশ নয়, বরং ভারত বা মিয়ানমার।  তাহলে কোন যুক্তিতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের বাংলাদেশের আদিবাসী বলা যেতে পারে, সমাবেশে প্রশ্ন জুড়ে দেন তিনি।  

আরও পড়ুন : ঢাবির দুই প্রো-ভিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন কেন আটকা?

মুহম্মদ জিয়াউল হক আরো বলেন, ঐতিহাসিকভাবেই এটি মীমাংসিত যে, স্মরণাতীতকাল থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম বাঙালিদের বসবাস স্থান ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন যেসব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা উপজাতি আছে তাদের মধ্যে দুই রকম লোক রয়েছে। এদের মধ্যে কেউ দখলদার বা সেটেলার, আবার কেউ অভিবাসী বা আশ্রয়গ্রহীতা। ১৭-১৮'শ সাল থেকে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র-মিয়ানমার, ভারত ও তিব্বতসহ আশপাশের অন্যান্য অঞ্চলের বিভিন্ন দস্যু ও সন্ত্রাসী সম্প্রদায় বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে বাঙালিদের বাড়িঘর লুটপাট, হত্যাকাণ্ড এবং ব্যাপক দখলদারিত্ব চালায়।  নিজ ভূমি থেকে জোরপূর্বক বাঙালিদেরকে বের করে পার্বত্য চট্টগ্রাম দখলে নিয়ে নেয়। এরা হচ্ছে স্যাটেলার দখলদার।  আপনারা দেখে থাকবেন যে, এদের দখলদারিত্ব, লুটপাট, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসীপনা কিন্তু এখনো বিদ্যমান। বিগত বছরগুলো যাবত এদের পেশাটাই এরকম চলে এসেছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের মধ্যে আরেকটা শ্রেণি আশপাশের অঞ্চলে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী দ্বারা নিপীড়নের শিকার হয়ে আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। এরা হচ্ছে অভিবাসী বা আশ্রয়গ্রহীতা। পরবর্তীতে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ভূমিচ্যুত সামান্য কিছু বাঙালিকে ওখানে তাদের ভূমি ফিরিয়ে দেন। এখনো লক্ষ লক্ষ ভূমিচ্যুত বাঙালি তাদের আদিনিবাস পার্বত্য চট্টগ্রামে ফিরতে পারছেন না নানা রকম বাধা বিঘ্নতার কারণে। গত ২-৩'শ বছরের ওইসব ভূমিদস্যু সন্ত্রাসী, তাদের সঙ্গে কিছু অভিবাসীরাও এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিপুত্র অর্থাৎ আদিবাসী দাবি করে বসছে। অনেকটা ফিলিস্তিনিদের ভূমিতে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের মত।  ইতিহাসের জ্ঞান যাদের শূন্যের কোঠায় তাদের কেউ কেউ না বুঝেই সেসব পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র থেকে আসা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কিংবা উপজাতিদেরকে আদিবাসী বলে সম্বোধন করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং সংবিধানের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।  এটা আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না।  

‘আদিবাসী শব্দটি শ্রুতিমধুর শোনালেও, আদিবাসী শব্দটি তীব্র বিষযুক্ত। কোন জাতিকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে জাতিসংঘ চার্টার অনুযায়ী ওই জাতি জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ বা স্বায়ত্বশাসন চাইতে পারে। গণভোট করে পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তুলতে পারে। নৃ-গোষ্ঠীদের আদিবাসী বললে, এ সুযোগ নিয়ে পার্বত্য জেলাগুলোকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে কথিত জুম্মল্যান্ড বা গ্রেটার কুকিচিনের অংশ বানানোর ষড়যন্ত্র জোরদার হতে পারে, পাহাড়ে শুরু হতে পারে ভয়াবহ বাঙালি গণহত্যা।’

আরও পড়ুন : ঢাবি উপাচার্যের ইমামমিতে নামাজ আদায় শিক্ষার্থীদের

সংগঠনটির যুগ্ম আহ্বায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মুহম্মদ তরীকুল ইসলাম বলেন, আদিবাসী শব্দটি শ্রুতিমধুর শোনালেও, আদিবাসী শব্দটি তীব্র বিষযুক্ত।  কোন জাতিকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে জাতিসংঘ চার্টার অনুযায়ী ওই জাতি জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ বা স্বায়ত্বশাসন চাইতে পারে। গণভোট করে পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তুলতে পারে। নৃ-গোষ্ঠীদের আদিবাসী বললে, এ সুযোগ নিয়ে পার্বত্য জেলাগুলোকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে কথিত জুম্মল্যান্ড বা গ্রেটার কুকিচিনের অংশ বানানোর ষড়যন্ত্র জোরদার হতে পারে, পাহাড়ে শুরু হতে পারে ভয়াবহ বাঙালি গণহত্যা। ঠিক যে প্রক্রিয়ায় সুদান থেকে বিচ্ছিন্ন করে দক্ষিণ সুদান কিংবা ইন্দোনেশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে পূর্ব তীমুর তৈরি করা হয়েছিলো, ঠিক একই প্রক্রিয়ায়। আমরা দেখেছি মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা জাতিকে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর ভিত্তিতে ভাগ করতে চাইছেন না।  কিন্তু এ ভাষণে তিনি আদিবাসী শব্দ উচ্চারণ করে জাতিকে আদিবাসী-অভিবাসী দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেললেন, এটা কেমন কথা?

আরও পড়ুন : সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ঢাবিতে মানববন্ধন

প্রতিবাদ সমাবেশে সংহতি জানিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার শাহাদাৎ ফরাজী সাকিব বলেন, সবার আগে দেশ এবং আমাদের এই দেশ পরিচালিত হয় আমাদের সংবিধানের দ্বারা। দেশের সংবিধান যেখানে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে দেশে কোন আদিবাসী নেই, কিন্তু আমরা দেখছি একটি মহল অতি উৎসাহী হয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদেরকে আদিবাসী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।  আমি মনে করি এর পিছনে গভীর একটি পরিকল্পনা রয়েছে, যে পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে দেশভাগের মতো ভয়ংকর ষড়যন্ত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে।  

সমাবেশে বক্তারা প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য থেকে আদিবাসী শব্দের প্রত্যাহার চান এবং দেশের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল পদ থেকে এমন ‘দায়িত্বহীন বক্তব্য’ পুনরায় ঘটবে না এমন নিশ্চয়তা দাবি করেন।  তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থিতিশীলতা রক্ষায় সেনা ক্যাম্প বৃদ্ধিরও দাবি জানান।  সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শতাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।


সর্বশেষ সংবাদ