ঢাবির দেড়শ শিক্ষার্থীর আবাসন ‘লাখ টাকা’ বেতন পাওয়া কর্মকর্তাদের দখলে

কবি জসীম উদদীন হল
কবি জসীম উদদীন হল  © ফাইল ফটো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীম উদদীন হলে সিট সংকটে দিশেহারা সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এই হলের কয়েকজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা বেতন পান লাখ টাকার মতো কিন্তু বাইরে থাকার সক্ষমতা নেই। ৪০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ টাকা বেতনের চাকরি করে বাইরে থাকার সক্ষমতা না থাকায় আড়াই হাজার টাকা ভাড়ায় হলেই থাকছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কবি জসীম উদদীন হলের কয়েকজন কর্মকর্তা। ভোগ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযোজ্য সরকারি সুযোগ সুবিধাও। এ জায়গায় প্রায় ১৫০ জন শিক্ষার্থীর আবাসনের ব্যবস্থা হত বলে জানা যায়।  

কবি জসীম উদদীন হলটি প্রায় ১৪০০ শিক্ষার্থীর আবাসস্থল। এখানে মোট ৮ টি গণরুমে প্রায় ১৪০ জন শিক্ষার্থী মানবেতর ভাবে থাকেন।  দুজনের রুম গুলোতেও চার জন করে থাকেন। পরিপূর্ণ আবাসিক হওয়ার পরেও অনেক শিক্ষার্থী থাকেন মেঝেতে। 

শিক্ষার্থীদের এই মানবেতর জীবন যাপনেও পরিবারসহ হলের একাংশ দখল করে আরামদায়ক জীবন যাপন করছেন হলেরই কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী।  হলের বিদ্যুৎ,  গ্যাস, রুমসহ সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন হলের অভ্যন্তরে ছাত্রদের জায়গা দখল করে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হলের দক্ষিণ ভবনের তৃতীয় তলার কিছু অংশসহ চতুর্থ ও পঞ্চম তালার অর্ধেকাংশে থাকেন কর্মকর্তারা।  আটটি পরিবার এখানে থাকেন। তাদের মধ্যে প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম, সিনিয়র প্রশাসনিক কর্মকর্তা রবিউল হক ভূঁইয়ার পরিবার, সিনিয়র ইমাম হাফেজ উসাইদ আহমেদ, প্রধান সহকারী আব্দুল জলিল, উচ্চমান সহকারী শহিদুল ইসলাম, সিনিয়র ইলেক্ট্রিশিয়ান আনোয়ার হোসেন, সিনিয়র অফিস অ্যাটেন্ডেন্ট মামুনুর রশীদ এবং বাগান মালি নজরুল ইসলামের পরিবারও আছেন। 

এখানে মোট ১০ টি ইউনিট আছে যেখানে তৃতীয় তলায় ২ ইউনিট, চতুর্থ তলায় ৪ ইউনিট এবং পঞ্চম তলায় চার ইউনিট। প্রতিটা ইউনিটে ২ টি করে রুম রয়েছে। এখানে তৃতীয় তলায় ২ ইউনিটে পরিবারসহ থাকেন ২ জন কর্মকর্তা। একজন সিনিয়র প্রশাসনিক কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম ভুঁইয়া যার বেতন প্রায় ৮০ হাজার টাকা। আরেকজন হলেন উচ্চমান সহকারী শহিদুল ইসলাম যার বেতন প্রায় ৪০ হাজার টাকা। চতুর্থ তলার ৪ ইউনিটে থাকেন দুইটি পরিবার যার মধ্যে একজন প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম যার বেতন প্রায় এক লক্ষ টাকা। আরেকজন হলেন মসজিদের ইমাম উসাইদ আহমেদ যার বেতন ৫০ হাজার টাকার উপরে। পঞ্চম তলায় চারটি ইউনিটে থাকেন চারটি পরিবার। সিনিয়র অফিস অ্যাটেন্ডেন্ট মামুনুর রশীদ, বাগান মালি নজরুল ইসলাম, সিনিয়র ইলেক্ট্রিশিয়ান আনোয়ার হোসেন ও প্রধান সহকারী আব্দুল জলিলের পরিবার। এদের প্রত্যেকের বেতন ৪০ থেকে ৫০ হাজারের ভেতরে।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ প্রচুর টাকা বেতন পেলেও বাইরে থাকার সাহস পায় না কর্মকর্তা কর্মচারীরা কারণ হলে সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে করতে তাদের বাইরে থাকার সদিচ্ছাটি মরে গেছে। কম খরচে সকল সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ফলে একটু বেশি টাকা ভাড়া দিয়ে বাইরে থাকার সদিচ্ছা নেই কর্মকর্তা কর্মচারীদের। যার ফলে শিক্ষার্থীদের প্রায় দেড়শ সিট আটকে আছে তাদের দখলে। 

শিক্ষার্থী শাকিল বলেন, আমার হল অধিকারও আমার কিন্তু অধিকার ভোগ করছে কর্মকর্তা কর্মচারীরা। প্রতিবার নতুন প্রাধ্যক্ষ আসার পর শিক্ষার্থীরা তাকে সমস্যার ব্যাপারে জানালেও কোনো প্রাধ্যক্ষই জায়গাটিকে দখলমুক্ত করতে পারেনি। আমরা দ্বিতীয় বর্ষের শেষের দিকে এসেও অনেকে গণরুমে গাদাগাদি করে থাকি। আমরাই যেন হলের কর্মকর্তা কর্মচারী। তাই কোনোভাবে বেঁচে আছি। আর যারা আমাদের সেবায় নিয়োজিত তারা আছে মহানন্দে। এত মানবিক হল আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই।  

আরেক শিক্ষার্থী জাহিদ বলেন, দ্বিতীয় বর্ষে আমরা প্রায় ৮০ জন শিক্ষার্থীর গণরুমে গাদাগাদি করে থাকি। অথচ আমাদের ঠিক পাশেই ১০০ জন শিক্ষার্থীর জায়গা দখল করে আছেন কর্মকর্তা কর্মচারীরা।  মাত্র ৮টি পরিবার সেখানে হয়তো ২০ জন সদস্য রয়েছে। কিন্তু সেখানে আমরা ১০০ জন শিক্ষার্থী থাকতে পারতাম আমাদেরকে সেই সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। আমাদের অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে।  মাননীয় প্রাধ্যক্ষের কাছে আমাদের আবেদন থাকবে তিনি যেন আমাদের অধিকার আমাদেরকে ফিরিয়ে দেন। 

হলের সিনিয়র প্রশাসনিক কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন,  বাইরে থাকা সক্ষমতা আমাদের রয়েছে কিন্তু হলের কাজের স্বার্থে আমাদেরকে সার্বক্ষণিক হলের আশেপাশেই থাকতে হয়। যার কারণে শিক্ষকদের জন্য তৈরি কোয়ার্টারে আমরা থাকি। প্রশাসন আমাদেরকে চলে যেতে বললে আমাদেরকে অবশ্যই চলে যেতে হবে আমাদেরকে এখনো সে ধরনের কোন নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তবে বর্তমান প্রাধ্যক্ষ স্যার আমাদেরকে অন্য কোথাও বাসা দেখার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রশাসন যদি আমাদেরকে চলে যেতে বলে তাহলে আমাদেরকে অবশ্যই চলে যেতে হবে।  

সিনিয়র ইমান উসাইদ আহমেদ বলেন, আমরা যেখানে থাকি সেটি মূলত তৈরি করা হয়েছিল শিক্ষকদের জন্য। পরবর্তীতে শিক্ষকরা চলে গেলে আমাদেরকে সেখানে থাকার জন্য বলা হয়। তবে এটি শিক্ষার্থীদের জন্য বাসযোগ্য করতে হলে এখানে নতুন করে দেয়াল ভাঙতে হবে এবং নতুন করে কাঠামো তৈরি করতে হবে যেটি এখন সম্ভব নয়। কারণ এর আগে একবার ইঞ্জিনিয়ার এনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরে জানা যায় দেয়াল ভাঙতে গেলে হলটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে। যার ফলে এটি ভাঙা সম্ভব নয় তবুও প্রশাসন যদি আমাদেরকে চলে যেতে বলে আমাদেরকে অবশ্যই চলে যেতে হবে। মসজিদের ইমাম হিসেবে আমাকে সার্বক্ষণিক এখানে থাকতে হয় সুতরাং মসজিদের আশেপাশে থাকাটা আমার জন্য অত্যন্ত জরুরি। 

এ সময় তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, অনেকে আছে যাদের বেতন লাখ টাকা তারা না থেকে কম বেতনভুক্ত কিন্তু সার্বক্ষণিক যাদের প্রয়োজন তারা এখানে থাকতে পারেন। কিন্তু যাদের এখানে সার্বক্ষণিক প্রয়োজন নেই তাদের এখানে থাকা উচিত নয় বলে আমি মনে করি। 

হলটির প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহীন খান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি ধীরে ধীরে কাজটি সম্পন্ন করার চেষ্টা করছি। আমি ইতোমধ্যে আমার হাউস টিউটরদের নিয়ে পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। কে কোথায় কয়টি ফ্লোর নিয়ে থাকছে সবকিছু আমি দেখে এসেছি। পাশাপাশি এটাও অনুধাবন করেছি যে দীর্ঘদিনের একটি সমস্যা অল্প সময়ে সমাধান সম্ভব নয়। তাই আমি ধীরে ধীরে ব্যাপারটাকে সমাধান করার চেষ্টা করছি। আমি  কয়েকজনকে জানিয়েও দিয়েছি তারা যেন বাইরে বাসা দেখে। সুতরাং শিক্ষার্থীদের সহায়তায় শিক্ষার্থীদের জন্য সকল ধরনের উন্নয়নমূলক কাজের জন্য আমি সবসময় প্রস্তুত আছি। 

উল্লেখ্য, ১৯৭৬ সালরে ১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের নামে “কবি জসীম উদ্দীন হল” প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ম আবাসকি হল ছিল। এই হলটিতে সর্বমোট ১২০টি কক্ষ রয়েছে। সেখানে ৪ সিটের ৭৬টি কক্ষ , ৩ সিটের কক্ষ ৫টি এবং ২ সিটের কক্ষ ৩৯টি। হলটিতে দুটি ভবন রয়েছে। একটি দক্ষিণ ভবন অন্যটি উত্তর ভবন। দক্ষিণ ভবনের নিচতলায় শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য মাত্র চারটি কক্ষ রয়েছে। তবে ২য় তলা পুরোটাতেই শিক্ষার্থীরা থাকছেন। ৩য় তলায় অর্ধেক শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ বাকি অর্ধেকে একটি রিডিং রুম। বাকি জায়গায় থাকেন দুজন কর্মকর্তার পরিবার। চতুর্থ এবং পঞ্চম তলায় শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক এবং বাকি অর্ধেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের পরিবারসহ থাকছেন।এছাড়াও হলটি যখন তৈরি হয় তখন আবাসিক শিক্ষকদের জন্য কোনো আবাসস্থল ছিলো না। ফলে ব্যাচেলর আবাসিক শিক্ষকদের জন্য ভবনটির একাংশ এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে করে শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের সংযোগ না থাকে। এজন্য আলাদা সিড়িও তৈরি করা হয়েছে। তবে আবাসিক শিক্ষকদের জন্য আলাদা কোয়ার্টার হলেও জায়গাটা শিক্ষার্থীদেরকে না দিয়ে  কর্মকর্তাদের দখলে দেয় হল প্রশাসন।


সর্বশেষ সংবাদ