২৬তম সম্মেলন
‘আঞ্চলিকতা’ থেকে কি বের হতে পারবে রাবি ছাত্রলীগ!
- রাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২২, ১০:১০ PM , আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২২, ১০:৫৬ PM
আঞ্চলিকতায় আটকে পড়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রলীগের কমিটি। দেশের অন্যতম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে রাজশাহী মহানগরের বাসিন্দাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ রাজশাহী জেলা বা অঞ্চলের বাইরে থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই পদের নেতৃত্বে আসতে পারছেন না। পদ পেতে যেন অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘লোকাল বা স্থানীয়’ (রাজশাহী জেলা বা অঞ্চলের) হওয়া। ফলে সারাদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে পড়তে আসলেও ছাত্রলীগের নেতৃত্ব থাকছে শুধুই লোকালদের হাতে। এতে দেশের অন্য জেলা থেকে আসা সক্রিয় কর্মীরা হতাশা নিয়েই ছাত্রজীবন শেষ করছেন।
বাইরের জেলা বা অঞ্চল থেকে রাবি ছাত্রলীগের নেতৃত্বে কাউকে না আনায় এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গড়ে উঠছে না যোগ্য নেতাও। অন্যদিকে স্থানীয়রা নেতৃত্বে থাকায় ক্যাম্পাসে অছাত্র ও বহিরাগতদের প্রভাব বাড়ছে। মাদক কারবারি, চুরি, ছিনতাই, ইভটিজিংসহ নানান অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। অপকর্ম করে লোকাল বা স্থানীয় পরিচয় দিয়ে বীরদর্পে ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা।
জানা গেছে, আগামী ১২ নভেম্বর রাবি ছাত্রলীগের সম্মেলন। এ সম্মেলনের মাধ্যমে দীর্ঘ ছয় বছর পর নতুন নেতৃত্ব পেতে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। তবে এবারও শীর্ষ দুই পদে আলোচনায় রাজশাহীতে বাড়ি এমন নেতাদের নাম। বাইরের জেলা থেকে আসা কয়েকজন নেতৃত্বের দৌড়ে থাকলেও শীর্ষ দুই পদে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীর বাইরে থেকে যারা রাবি ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, এমন অনেকেই এখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন শফিক। তার বাড়ি বগুড়ায়। তিনি রাবি ছাত্রলীগের ১৯তম কমিটিতে (১৯৯৭-২০০২) সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বেও ছিলেন।
বর্তমান মাগুরা-১ আসনের সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর। তার বাড়ি মাগুরায়। তিনি রাবি ছাত্রলীগের ১৮তম কমিটিতে (১৯৯৪-৯৭) সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরে তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর এপিএসের দায়িত্ব পালন করেছেন। এমন আরও অনেকেই রাবি ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যারা রাজশাহীর বাইরের জেলার বাসিন্দা। পরবর্তীসময়ে জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
সর্বশেষ কমিটিতে সভাপতির দায়িত্ব পান গোলাম কিবরিয়া। তার বাড়ি রাজশাহী মহানগর সংলগ্ন বুধপাড়া এলাকায়। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক হন ফয়সাল আহমেদ রুনু। তার বাসা রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটাতে।
১৯৬২ সাল থেকে এ পর্যন্ত রাবি ছাত্রলীগের ২৫টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১৯৬২ সাল থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা নেতৃত্ব রাবি ছাত্রলীগের হাল ধরেছেন। কিন্তু ২০০০ সালের পর সেটা ক্রমান্বয়ে কমে উত্তরাঞ্চল তথা বৃহত্তর রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
এদিকে, ২০০৪ সালের পর থেকে রাজশাহী বিভাগে তথা আট জেলার ছাত্রলীগের কর্মীরা রাবি শাখার গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন। ২০১০ সালে পদগুলোর বণ্টন আরও সংকুচিত হয়ে রাজশাহী জেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
২০১৩ সালের পর থেকে বর্তমান ছাত্রলীগের কমিটিতে যারা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন, তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকার। সর্বশেষ ২০১৬ সালে ২৫তম কমিটির শীর্ষ দুই পদ রাজশাহী জেলা থেকে আরও সংকীর্ণ হয়ে মহানগরের অভ্যন্তরে চলে আসে।
লোকাল নয়, যোগ্য নেতৃত্ব চান কর্মীরা
১২ নভেম্বরের সম্মেলনের মাধ্যমে শুধু লোকাল বা স্থানীয় বিবেচনায় নয়, যোগ্য ও ত্যাগীদের নেতৃত্বে দেখতে চান বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
তবে খুব বেশি আশাবাদী নয় রাজশাহীর বাইরে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে রাজনীতিতে জড়ানো ছাত্রলীগকর্মীরা। তারা বলছেন, ক্যাম্পাসে ভালো অবস্থান থাকলেও স্থানীয় বাসিন্দা না হওয়ায় নেতৃত্বের দৌড়ে পিছিয়ে তারা। স্থানীয়ভাবে প্রভাব রয়েছে- এমন প্রার্থীদের শীর্ষ পদগুলোতে রাখা হয়।
পদের দৌড়ে এবারও এগিয়ে স্থানীয়রা
১২ নভেম্বরের সম্মেলনে পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে আলোচনায় রয়েছেন শাহিনুল সরকার ডন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বুধপাড়ার বাসিন্দা। রাজু, সাজ্জাদ ও গালিবের বাসাও মহানগরীর ভদ্রা এলাকায়। অনিক মাহমুদ বনির বাড়ি ক্যাম্পাসঘেঁষা বিনোদপুরে। আর মেহেদী হাসান মিশুর বাড়ি রাজশাহীর কাটাখালী পৌর এলাকায়। দুর্গাপুর উপজেলার বাসিন্দা ইমতিয়াজও শীর্ষ পদের দৌড়ে রয়েছেন। সম্মেলনে ৯৪ জন প্রার্থীর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকার স্থানীয় আরও অন্তত পাঁচজন পদপ্রত্যাশী রয়েছেন।
রাবি ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মেজবাহুল ইসলাম বলেন, যারা ক্যাম্পাসে রাজনীতি করছি, তাদের বয়সের চেয়ে লিটন ভাইয়ের (এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন) রাজনৈতিক বয়স অনেক বেশি। ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অত্যন্ত বিচক্ষণ। অর্ণা আপুও (খায়রুজ্জামান লিটনের মেয়ে) রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ব। আগামী নির্বাচনে যারা শিবির ও ছাত্রদলের মারমুখী রাজনীতির বিপক্ষে যেই নেতৃত্ব বুদ্ধিদীপ্ততার সঙ্গে ক্ষিপ্রতা নিয়ে তাদের প্রতিহত করবে- এমনই নেতৃত্ব তারা আনবে বলে বিশ্বাস করি। এক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা আনা উচিত নয় বলে মনে করি।
রাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, রাজশাহীর বাইরের ছেলেরা যদি যোগ্য থাকে, তাহলে সমতার ভিত্তিতে অবশ্যই তাদের নেতৃত্বে আনা উচিত। অর্থের বিনিময়ে নয়, যোগ্যদের নেতৃত্বে আনতে হবে। সামনে জাতীয় নির্বাচন, এ মুহূর্তে যদি ভালো নেতৃত্ব না আসে এবং ছাত্রলীগকর্মীদের মধ্যে হতাশা কাজ করে, তাহলে নির্বাচনে প্রভাব পড়তে পারে।
ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছেন অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াছ হোসাইন। বর্তমানে তিনি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন। এর আগে জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
অধ্যাপক ইলিয়াছ হোসাইন বলেন, ‘ছাত্রলীগের কমিটি এখন ছাত্রলীগের হাতে নেই। এখন তা আওয়ামী লীগের হাতে। এখন আর যোগ্যতার ভিত্তিতে পদ বণ্টন করা হয় না। ফলে অনেকেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। আমরা চাই, যোগ্যতার ভিত্তিতে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব আসুক।’
তিনি বলেন, ‘স্থানীয় নেতাকর্মীরা দায়িত্বে আসলে তারা অধিকাংশ সময় বাড়িতে সময় কাটান। বাইরে থেকে নেতৃত্ব আসলে তারা সবসময়ই ক্যাম্পাসে অবস্থান করে শিক্ষার্থীদের সব বিষয়ে খেয়াল রাখবেন।’
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি, আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য এবং রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ডা. আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা বলেন, ‘নেতৃত্ব বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমাদের চাওয়া থাকে, যারা আদর্শিক রাজনীতি করে তাদের সুযোগ দেওয়া। সেটা যদি রাজশাহীর বাইরের জেলারও হয় তবুও তারা আসতে পারেন।’
তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও দেখেছি, গত কমিটিগুলো কিছুটা সীমাবদ্ধতার মধ্যে চলে আসছে। যদি বাইরের এমন কোনো ছেলে-মেয়ে থাকে, যারা ছাত্রলীগকে আরও গতিশীল ও শক্তিশালী করতে পারবেন তাহলে অবশ্যই তাদেরকে সুযোগ দেওয়া হবে। আশা করি, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আছেন, বিচক্ষণ আওয়ামী লীগের নেতারা আছেন তারা অবশ্যই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেবেন।