অনিয়ম-দুর্নীতিতেও সেরা উপজেলার শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ

কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ নির্মল ইন্দু সরকার ও প্রতিষ্ঠানটির লোগো
কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ নির্মল ইন্দু সরকার ও প্রতিষ্ঠানটির লোগো  © সম্পাদিত

মাত্র ১০ টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা- আর্থিক অনিয়মের ক্ষেত্রে কোন অঙ্ককেই ছোট করে দেখেন না তিনি। জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তাকে উপহার দিতে কেনা টাইয়ের ভাউচারে জালিয়াতি করে ৫৯০ টাকাকে ৬০০ টাকা করেছেন তিনি। আবার কলেজের প্রজেক্টর সেটিং ও মনিহারি বাবদ ৬ হাজার ১৬৮ টাকা ব্যয় হলেও ভাউচার করেছেন ১৩ হাজার ৯৬৮ টাকার। একইভাবে প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাকালেও বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটারে ২ হাজার টাকা ব্যয়ের ভুতুড়ে ভাউচারও জমা দেওয়ার মতো অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমন অসংখ্য অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং স্বেচ্ছাচারিতায় জড়িয়ে পড়েছেন লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসনের অধীন পরিচালিত কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ নির্মল ইন্দু সরকার। 

এমন সব অনিয়মের বিষয়ে স্ববিস্তারে জানিয়ে গত ১৩ আগস্ট লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন শিক্ষালয়টির শিক্ষকরা। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির ৩৭ জন শিক্ষকের মধ্যে ৩৫জনই তার অধীন কাজ করতে অনাস্থা জ্ঞাপন করে স্বাক্ষর প্রদান করেন। তাদের দাবি—অধ্যক্ষ নির্মল ইন্দু সরকারকে অনতিবিলম্বে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে তাকে উত্থাপিত অভিযোগের অধীন বিচার ও শাস্তির আওতায় আনার বিষয়ে।

আমরা দু’পক্ষের বক্তব্য গ্রহণ করেছি। তদন্তের কাজ চলমান রয়েছে। আমরা অচিরেই জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সাথে আলোচনা করে এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবোসম্রাট খীসা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি, উন্নয়ন ও মানবসম্পদ), লক্ষ্মীপুর।

এর আগে চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হিসেবে যোগ দেন অভিযুক্ত অধ্যক্ষ নির্মল ইন্দু সরকার। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকদের অভিযোগ— তিনি অধ্যক্ষ যোগদানের পর থেকেই প্রকাশ্যে শুরু করেন ভাউচার কেলেঙ্কারি। শিক্ষকদের কাছ থেকে বিভিন্ন কাজের খরচের ভাউচার নিয়ে সবার সামনে ছিঁড়ে নিজের মন গড়া ভাউচার তৈরি করেন এবং প্রতিটি ছোট ভাউচার থেকে ন্যূনতম ১০ টাকা পর্যন্ত তিনি নিজের পকেটে ঢুকিয়েছেন।

এছাড়াও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে—ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্টেরও। গত ২৫ শে মার্চ রাতের মোমবাতি প্রজ্বলন অনুষ্ঠানে তিনি জেলা শিক্ষা অফিসারকে অর্থের বিনিময়ে দাওয়াত করে এনে, বক্তৃতা, গান ইত্যাদির মাধ্যমে  বাড়াবাড়ি করে কালক্ষেপণ করার শিক্ষকদের পবিত্র রমজান মাসে জামাতে এশা ও তারাবি পড়তে না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানে ইফতার মাহফিল করার সরকারি প্রজ্ঞাপন থাকার পরেও তিনি ইফতার মাহফিল করার অনুমতি না দেয়া হলেও স্বরস্বতি পূজা আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালনে ১৮০০০ টাকা প্রতিষ্ঠান থেকে বরাদ্দের অভিযোগ আনা হয়েছে।

আরও পড়ুন: প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ৩০ কোটিরও বেশি অর্থ আত্মসাৎ বহিষ্কৃতদের

এছাড়াও ভাউচার কেলেঙ্কারি, ক্যান্টিন ভাড়া, ল্যাব ভাড়া, প্রশংসাপত্রের টাকা নিজের পকেটে রাখা, পুরোনো বই বিক্রির টাকা নিজের কাছে রাখা, প্রতিষ্ঠানের সম্পদ নিজের বাসায় নিয়ে ব্যবহার করা সহ, নামে বেনামে অসংখ্য কমিটি করে প্রজেক্ট তৈরি করে অর্থ আত্মসাৎ সহ নানা অনিয়মের সুস্পষ্ট প্রমাণ তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে। 

এছাড়াও সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মেহের নিগারের উপস্থিতিতে অধ্যক্ষ নিজের অপরাধ স্বীকার করার পর তাকে এ বিষয়ে সতর্ক করা হলেও কোন ধরনের পরিবর্তন আসেনি এই অধ্যক্ষের। শিক্ষালয়টির শিক্ষকদের অনাস্থার কারণে স্বেচ্ছাচারী এ অধ্যক্ষ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন তিনি নিজের পছন্দের দু-তিন জন শিক্ষক দিয়ে। একই সাথে বিদ্যালয়ের ফান্ড খালি হওয়ায়  শিক্ষকদের জুলাইয়ের বেতন দেওয়া হয়েছে চলতি মাসে।

কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজ, লক্ষ্মীপুর। ছবি: সামাজিক মাধ্যম থেকে সংগৃহীত।

নির্মল ইন্দু সরকারের আগেও দেশের নামকরা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন—যেখানে নারী কেলেঙ্কারি, অর্থ কেলেঙ্কারির মত ঘটনা প্রমাণিত হয়ে তিনি চাকরি হারিয়েছেন। কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজে যেখানে একজন পিয়ন নিয়োগে ও  ভেরিফিকেশন করা হয়ে থাকে,  সেখানে এত এত যোগ্য প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও কীভাবে এমন একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে কোন প্রকার ভেরিফিকেশন ছাড়াই তড়িঘড়ি করে জেলা প্রশাসক নিয়োগ প্রদান করেছেন, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন লক্ষ্মীপুরবাসী। 

বর্তমানে বাধ্যতামূলক ছুটিতে আছেন এই অধ্যক্ষ। তাঁকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর আগেও যখন শিক্ষকরা অনাস্থা দিয়েছিল,  তখনও বিতর্কিত  উপজেলা শিক্ষা অফিসার আবু তালেব প্রায়ই অধ্যক্ষের কক্ষে এসে গোপন আলোচনা করতেন এবং নানাভাবে বিষয়টি অন্যদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করতেন। 

আরও পড়ুন: মতিঝিল মডেলে শিক্ষার্থী নেমেছে অর্ধেকে, নেপথ্যে সিন্ডিকেট-অনিয়ম

এলাকার সচেতন মহলের দাবি—তদন্তের নামে কালক্ষেপণ করে বিষয়টি যেন ভিন্ন দিকে প্রবাহিত না হয় সে ব্যাপারে তারা জেলা প্রশাসকের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার অপেক্ষায় আছেন। পাশাপাশি যারা এমন ঘৃণ্য অধ্যক্ষকে সুবিধা দিয়ে তাকে প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছেন—তাদেরও বিচার দাবি করছেন তারা।

এর বাইরেও অনিয়ম করে শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ খেতাব বাগিয়ে নিয়েছেন তিনি। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি যোগদানের পর ২৯ শে এপ্রিল তিনি উপজেলার শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। অভিযোগ রয়েছে—অধস্তন কর্মকর্তাদের উপহার-উপটৌকন দিয়ে বিধিবহির্ভূত-ভাবে এ খেতাব পান তিনি। 

যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তার কোনো ভিত্তি নেই। আমি তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছি। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে—তারা যে সিদ্ধান্ত নেবে আমি তা মাথা পেতে নিবোনির্মল ইন্দু সরকার, অধ্যক্ষ, কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজ, লক্ষ্মীপুর।

বিষয়টি নিয়ে বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, অধ্যক্ষ নির্মল ইন্দু সরকার ২০০২ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৩.১৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। যার জন্য স্বাভাবিকভাবেই তিনি অ্যাকাডেমিক ফলাফল ক্যাটাগরিতে পূর্ণ নাম্বার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার কথা। অথচ এ ফলাফলকে প্রথম শ্রেণির ফলাফল করে দেখানোর জন্য তিনি দায়িত্বে থাকা শিক্ষককে চাপ দিতে থাকেন এবং বাছাইয়ের বিষয় তিনি বুঝবেন মর্মে জানান। 

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে তিনি বিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক জানান, শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ হওয়ার জন্য ন্যূনতম ৬ মাস একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে হয়, উনার অধীনে দু’একটা সেন্ট্রাল পরীক্ষার সন্তোষজনক ফলাফল থাকতে হয়, প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে অবদান রাখতে হয়। অথচ উনি আসার দুমাসের মাথায় শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ হয়ে গেলেন। যেখানে প্রায় ১ মাস রমজানের বন্ধ ছিল। উপজেলা ও জেলা শিক্ষা অফিসারকে ম্যানেজ করে তিনি এ কাজ করেছেন।

আরও পড়ুন: ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হতে খরচ কোটি টাকা!

কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের প্রতিটি অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে জেলা প্রশাসনে সম্মানিত জেলা প্রশাসক কিংবা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) অথবা দায়িত্বপ্রাপ্ত যেকোনো সহকারী কমিশনার এসে থাকেন। অথচ তিনি প্রায়ই উপজেলা শিক্ষা অফিসার এবং জেলা শিক্ষা অফিসারকে মোটা অঙ্কের টাকা উপঢৌকন দিয়ে প্রতিষ্ঠানে দাওয়াত দিয়ে এনে নিজের হীন-স্বার্থ চরিতার্থ করেছেন, হয়েছেন শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ—জানিয়েছেন শিক্ষকরা

সামগ্রিক অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় লক্ষ্মীপুর কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ নির্মল ইন্দু সরকারের সাথে। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তার কোনো ভিত্তি নেই। আমি তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছি। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে—তারা যে সিদ্ধান্ত নেবে আমি তা মাথা পেতে নিবো।

আর বিষয়টি নিয়ে জানতে কথা হয় লক্ষ্মীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি, উন্নয়ন ও মানবসম্পদ) এবং তদন্ত কমিটির প্রধান সম্রাট খীসা’র সঙ্গে। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা দু’পক্ষের বক্তব্য গ্রহণ করেছি। তদন্তের কাজ চলমান রয়েছে। আমরা অচিরেই জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সাথে আলোচনা করে এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবো।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence