স্কুল কলেজ মাদ্রাসা

তালাবদ্ধ পাঠাগার, বইয়ের দুনিয়ার দরজা থেকেই ফিরছেন শিক্ষার্থীরা

লাইব্রেরি
লাইব্রেরি  © ফাইল ছবি

শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি ভিন্নধর্মী পাঠে উদ্বুদ্ধ করতে দেশের সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠাগার স্থাপন করে সরকার। আর দেশের বেসরকারি শিক্ষালয়গুলোয় প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরি। মূলত, প্রাতিষ্ঠানিক ও পাঠ্য বইয়ের একঘেয়েমি কাটিয়ে শিক্ষার্থীদের চিন্তার বিকাশ ও আগামী দিনের জন্য সুনাগরিক হিসেবে গড়তে পাঠাগারের পক্ষে মত শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের।

তবে, দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় তালাবদ্ধই থাকছে গ্রন্থাগারগুলো। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা, অনাগ্রহ, লোকবল সংকটসহ নানা কারণে ধুঁকছে সহ-পাঠ্যক্রমিক এ পাঠ্য কর্মসূচিও। হিসেব বলছে, দেশে বর্তমানে ৭০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১২ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার রয়েছে। এছাড়াও মাদ্রাসা কেন্দ্রিক ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও গ্রন্থাগার রয়েছে।

রাজধানীর মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নামকরা মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের লাইব্রেরিতে বর্তমানে বইয়ের সংখ্যার ১০ হাজারের কাছাকাছি। পাঠাগারটি নিয়মিত তদারক ও পরিচালনা করেন একজন শিক্ষক এবং একজন গ্রন্থাগারিক।

এখানকার গ্রন্থাগারিক বলছেন, আগের মতো এখন আর শিক্ষার্থীরা নিয়মিত বই পড়তে আসে না লাইব্রেরিতে। এখন যারা আসে তারা হয় বাধ্য হয়ে, না হয়ে লাইব্রেরি দেখতে আসে। তিনি বলেন, এখন দিনে নিয়মিত ৫ থেকে ১০ জন শিক্ষার্থী এখানে বই পড়তে আসেন।

শিক্ষকরা বলছেন, আগের দিনে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি লাইব্রেরিতে এসে বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করতো। তারা লাইব্রেরিতে পড়ার পাশাপাশি এখান থেকে বিভিন্ন ধরনের বই বাসায়ও নিয়ে যেত। এতে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে জানাশোনা পরিধিও বাড়ার সুযোগ থাকতো।

আগের দিনে লাইব্রেরিগুলোতে এতো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। কিন্তু, শিক্ষার্থীদের শেখার আগ্রহ ছিল। এখন লাইব্রেরিগুলোয় অনেক সুযোগ-সুবিধা যুক্ত যুক্ত হয়েছে—কিন্তু শিক্ষার্থীদের শেখার আগ্রহও সুযোগ কমে যাচ্ছে। এছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ সুযোগও শিক্ষার্থীদের বই ও পাঠাগার বিমুখ করছে বলে মত শিক্ষকদের।

আমাদের লাইব্রেরিগুলো এখনো পুরোনো আদলে রয়েছে। এখনও আগের মতো করে বই খুঁজে বের করতে হয়; এটি বদলানো উচিত। পাশাপাশি লাইব্রেরিতে নতুন বই যুক্ত করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের পাঠাভ্যাস বাড়াতে নতুন কর্মসূচি নিতে হবেমো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন।

সমাধান হিসেবে শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের পাঠাগারমুখী করতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, অভিভাবকদের এগিয়ে আসতে হবে সমস্যার সমাধানে। আর শিক্ষাবিদরা বলছেন, পাঠ্যাভ্যাস বাড়াতে হবে অভিভাবকদেরও। শিশুরা দেখে শেখার বা অনুকরণে শেখার উদাহরণকে বাস্তবে রূপ দিতে কাজে দেবে বড়দের বইমুখী করার অভ্যাসকে।

ঢাকার বাইরের জেলা শহরের একটি নামকরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আদনান মাহতাব। বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নরত এই ক্ষুদে শিক্ষার্থী বলছেন, তিনি তাদের প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরি শেষ কবে খোলা হয়েছে—তা বলতে পারছেন না। এছাড়াও তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো লাইব্রেরিয়ান না থাকার বিষয়ে জানিয়ে তিনি বলছেন, মাঝে মধ্যে শিক্ষকরা তাদের মাঝে মধ্যে লাইব্রেরিতে নিয়ে যান দেখার জন্য।

দেশের দক্ষিণের মেঘনার কোলঘেঁষা জনপদ লক্ষ্মীপুরের অন্যতম মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লক্ষ্মীপুর আদর্শ সামাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। লাইব্রেরিতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার হালচাল দেখতে লক্ষ্মীপুর জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গৌরবময় অংশীদার প্রতিষ্ঠানটির লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখা গেছে, এখানে সর্বশেষ নতুন বই কেনা হয়েছে গত ২০১৯ সালের দিকে। তখন প্রায় ১২ হাজার টাকার বই কেনা হয়েছে—এমন নথি পাওয়া গেছে প্রতিষ্ঠানটিতে।

অভিভাবকদের বই পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়ার ফলে শিক্ষার্থীরা বই পড়া থেকে বিমুখ হচ্ছে। এছাড়াও বর্তমানে পারিবারিক পাঠাগারের সংখ্যা একদমই নেই। আমরা তো শিক্ষার্থীদের জোর করে লাইব্রেরিতে নিয়ে আসতে পারবো না। আমাদের শিক্ষার্থীদের পরিবার থেকেই বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। শিক্ষার্থীদের বই পড়ার অভ্যাস তৈরির জন্য তাদের উৎসাহ দিতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের সকল সীমাবদ্ধতা দূর করতে হবে—অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর।

অর্থাৎ বিগত চার বছরে নতুন কোনো বই পায়নি এখানকার শিক্ষার্থীরা। তার আগে এখানে সর্বশেষ বই কেনা হয়েছিল ২০০৭ সালের দিকে। আরও অবাক করা বিষয় এখানে লাইব্রেরিটি পরিচালনা করার জন্য নেই কোনো লাইব্রেরিয়ান। ফলে, বছরের পর বছর তালাবদ্ধ জ্ঞানরাজ্যে কেবলই ধুলোর রাজত্ব; আর জ্ঞানপিপাসুদের রাজ্যের হতাশা।

লাইব্রেরি ও তার পাঠকদের এমন করুণ অবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে নাম না প্রকাশের শর্তে প্রতিষ্ঠানটির একজন শিক্ষক জানিয়েছেন, লাইব্রেরিতে কোনো নিয়মিত গ্রন্থাগারিক নেই। শিক্ষকদের আলাদা করে দায়িত্ব দিলেই তাদের পক্ষে ক্লাস পরীক্ষা-সামলে আলাদা করে সময় দেবার সুযোগ থাকে না। ফলে বছরের অধিকাংশ সময়ই লাইব্রেরি বন্ধ থাকে। শিক্ষার্থীদের আগ্রহ থাকলেও কোনো সুযোগ থাকে না বলেও জানান তিনি।

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর মনে করেন, অভিভাবকদের বই পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়ার ফলে শিক্ষার্থীরা বই পড়া থেকে বিমুখ হচ্ছে। এছাড়াও বর্তমানে পারিবারিক পাঠাগারের সংখ্যা একদমই নেই। আমরা তো শিক্ষার্থীদের জোর করে লাইব্রেরিতে নিয়ে আসতে পারবো না। আমাদের শিক্ষার্থীদের পরিবার থেকেই বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। শিক্ষার্থীদের বই পড়ার অভ্যাস তৈরির জন্য তাদের উৎসাহ দিতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের সকল সীমাবদ্ধতা দূর করতে হবে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইআর) সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে শিক্ষার্থীদের পাঠাগার মুখী করা এবং চলমান সমস্যার সমাধানে পুরো ব্যবস্থার আধুনিকায়ন জরুরি। আমাদের লাইব্রেরিগুলো এখনো পুরোনো আদলে রয়েছে। এখনও আগের মতো করে বই খুঁজে বের করতে হয়; এটি বদলানো উচিত। পাশাপাশি লাইব্রেরিতে নতুন বই যুক্ত করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের পাঠাভ্যাস বাড়াতে নতুন কর্মসূচি নিয়েও চিন্তার পরামর্শ তার।

আমাদের শিক্ষায় এখনো শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নির্ভর থাকতে হয়। ফিলে শিক্ষার্থীদের নতুন কিছু শেখার সুযোগ থাকে না। ফলে, শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এ ব্যবস্থা থেকে আমাদের বের হতে হবে—জানান শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের এই শিক্ষক।


সর্বশেষ সংবাদ