স্বস্তির গুচ্ছ পরীক্ষায় ভোগান্তি বাড়ল কয়েকগুণ

ভর্তি পরীক্ষার্থী
ভর্তি পরীক্ষার্থী  © ফাইল ছবি

প্রতিবছর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য লাখ লাখ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। স্বপ্ন দেখে আকাশছোঁয়ার। তবে প্রতিযোগিতামূলক এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতেই যেতে হতো দূর-দূরান্তে। আজ ঢাকা তো কাল চট্টগ্রাম। দেশের নানা প্রান্তে ছুটতে হত পাবলিকিয়ান হওয়ার স্বপ্নে। তাতে ভোগান্তির শেষ ছিল না। যেমনি ছিল আর্থিক ব্যায় ঠিক তেমনি ছিল আবাসন সংকটসহ নানান সমস্যা।

ছাত্র-ছাত্রীদের দুর্ভোগ লাঘবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দীর্ঘদিন ধরেই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের তাগাদা দিচ্ছিল তদারকি সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ইউজিসির সেই আহবানে সাড়া দিয়ে ২০টি সাধারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমবারের মতো গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। বিষয়টি সর্ব মহলে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ালেও আবেদন ফি বৃদ্ধি, পরীক্ষার ফলে ভুল, মেরিট পজিশন না দেয়া এবং সবশেষ বিষয় পছন্দের জন্য বাড়তি ফি নির্ধারণ করায় এই পদ্ধতির পরীক্ষা আয়োজনের সফলতা ঢাকা পড়েছে ব্যর্থতায়।

যদিও শিক্ষার্থীদের এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলছে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আয়োজক কমিটি। তারা বলছেন, প্রথমবারের মতো এত বড় পরিসরে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে কিছু ভুল হতেই পারে। তবে সেগুলো বড় কোন ভুল নয়। পরীক্ষার ফলে কোনো অসঙ্গতি নেই। এছাড়া ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেব করলে আবেদন ফি অনেক কম ধরা হয়েছে। আগামী বছর এই ভুলগুলো সুধরে আরও স্বচ্ছতার সাথে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করার কথাও জানিয়েছেন তারা।

তথ্যমতে, গত ১৭ অক্টোবর ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের গুচ্ছ পরীক্ষা শুরু হয়। এই ইউনিটের ফল নিয়ে ভুলের অভিযোগ তোলেন ভর্তিচ্ছুরা। এরপর ২৭ অক্টোবর ‘বি’ ইউনিটের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এই ইউনিটের ফল নিয়ে অভিযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। বিষয়টি নিয়ে নানা মহলে ব্যাপক সমালোচনা হলেও ফলে কোনো ভুল হয়নি বলে তখন জানিয়েছিল গুচ্ছ কমিটি। আর গত ১ নভেম্বর ‘সি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার সমাপ্তি হয়। এই ইউনিটের ফল নিয়েও ভুলের অভিযোগ তুলেছিলেন শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রথমে ভর্তি পরীক্ষার আবেদন ফি ৬০০ টাকা বলা হলেও পরে সেটি নির্ধারণ করা হয় ১২০০ টাকা। যা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় কয়েকগুন বেশি। এরপর কেন্দ্র সিলেকশনের ঝামেলা। পাঁচটি কেন্দ্র সিলেকশন করেও পছন্দের কেন্দ্র পাননি শিক্ষার্থীরা। যেতে হয়েছে বহুদূর। যা গুচ্ছ পদ্ধতির মূল লক্ষ্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগীয় শহরে পরীক্ষা নিলেও তা ছিল শিক্ষার্থীবান্ধব।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, আবেদনের ক্ষেত্রে জনপ্রতি রেকর্ড পরিমাণ ফি নিয়েও একঘন্টার জন্য কেন্দ্রগুলোতে ঘড়ির ব‍্যবস্থা করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এমনকি ঘড়ি না থাকা সত্ত্বেও এনালগ ঘড়ি ব‍্যবহার করতে দেয়া হয়নি। এতসব ত্রুটির পর ফল প্রকাশ করা হয়। সেখানেও ভুল করে গুচ্ছ কমিটি। যেভাবে ওএমআর শিটে বৃত্ত ভরাট করা হয়েছে সে অনুযায়ী নম্বর দেয়া হয়নি। এমনকি কোন বিষয়ে কতটি বৃত্ত ভরাট করা হয়েছে সেখানেও ভুল করা হয়। সবশেষ যুক্ত হয়েছে পরীক্ষা পরবর্তী বিষয় পছন্দের আবেদন ফি। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনিট প্রতি আবেদনের জন‍্য ৬৫০ টাকা করে নির্ধারণ করা হয়েছে। এ যেন কাটা গায়ে নুনের ছিটা।

এ প্রসঙ্গে সুরাইয়া সুমি নামে এক ভর্তিচ্ছু জানান, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা ভোগান্তি কমানোর পরিবর্তে কয়েকগুন বাড়িয়েছে। রেজাল্ট দিয়েছে কিন্তু কোন মেরিট পজিশন দেয়া হয়নি। একজন শিক্ষার্থী মেরিট পজিশন না পেলে নিজের অবস্থান কিভাবে বুঝবে আর না বুঝে আবেদনই বা কিভাবে করবে। এই অবস্থায় যাবিপ্রবিতে ভর্তি আবেদনের সার্কুলার প্রকাশ হয়েছে। সার্কুলারে বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিটি অনুষদে আবেদন ফি ৬৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এইভাবে ৪টি অনুষদে আবেদন করতে ২৬০০ টাকা লাগবে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি ২৬০০ টাকা লাগে তাহলে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩/৪/৫ অনুষদে আবেদন‌ করতে অনেক টাকা লেগে‌ যাবে ।‌ যা একজন মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য একেবারেই সম্ভব নয়।

তিনি আরও বলেন, অনেকেই বলতে পারে একজন শিক্ষার্থী এতোগুলো ভার্সিটিতে আবেদন করবে না। কিন্তু যেহেতু আমাদের কোন মেরিট পজিশন দেয়নি তাই কারো বোঝার কোন উপায় নেই যে কে কোথায় চান্স পেতে পারে। তাই বাধ্য হয়ে সবাইকেই আবেদন করতে হবে। এক্ষেত্রে ক্ষতি হবে শুধু মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের। ৫০ পেয়েও হয়তো একজন গরীব মেধাবী আবেদন করতে পারবে না। আবার যে ৪০ পাবে তার ভালো আর্থিক সাপোর্ট থাকলে সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে পারবে। আগে প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা ভাবে পরীক্ষা নিত। একজন পরীক্ষার্থী হয়তো ২/১ টা ভার্সিটিতে ‌চান্স পেত। এবং সে তখন ১/২ টাতেই আবেদন করতো। এতে করে এখনকার মতো এতো অর্থ খরচ হতো না তার।‌

মো. শরিফুল ইসলাম নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, গুচ্ছ পরীক্ষা পরবর্তী ভর্তি আবেদনের নির্দেশিকায় যবিপ্রবিতে প্রত্যেক ডিপার্ট্মেন্টের জন্য ৬৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যদি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে এত টাকা লাগে তাহলে ২০টা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন করতে কত টাকা লাগবে সেটি বোঝাই যাচ্ছে। মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে এত টাকা দিয়ে আবেদন করা সম্ভব হবে না। পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়েও অনেকে আবেদন করতে পারবেন না। এতে করে আমাদের স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে। ভোগান্তি কমানোর কথা থাকলেও গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আমাদের ভোগান্তি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আয়োজক কমিটির সদস্য ও যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শিক্ষার্থীরা যখন যেমন অভিযোগ করেছেন আমরা তখনই তা সমাধান করেছি। যাদের ফল নিয়ে সমস্যা ছিল তাদেরটা তখনই সমাধান করে দিয়েছি। এরপরও যাদের সমস্যা রয়েছে তাদের আমরা পুনর্নিরীক্ষার আবেদন করার সুযোগ দিয়েছি।

পুনর্নিরীক্ষার আবেদন ফি অনেক বেশি রাখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অন্যান্য জায়গায় ফল পুনর্নিরীক্ষার আবেদন ফি কম রাখা হলেও তারা সেটি ফেরত দেয়না। কিন্তু আমরা আবেদন ফি ফেরত দেব। পুনর্নিরীক্ষার পর যাদের ফল পরিবর্তন হবে তাদের আবেদন ফি ফেরত দেয়া হবে। সেজন্য আমাদের আবেদন ফি বেশি রাখা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার নির্দেশিকায় স্পষ্ট করে বলা ছিল আমরা একটি পরীক্ষা নেব। যেখানে কোনো পাশ-ফেল থাকবে না। শিক্ষার্থীদের কেবল একটা নম্বর দেয়া হবে। সেই নম্বর অনুযায়ী পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের আইন অনুযায়ী ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে। আমরা সেভাবেই আগাচ্ছি। যবিপ্রবির সকলের সাথে আলোচনা করেই বিষয় পছন্দের আবেদন ফি ৬৫০ টাকা করে নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বাইরে আমার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব না।


সর্বশেষ সংবাদ