পিএইচডি ডিগ্রি চালু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি মাইলফলক

ট্রাস্ট্রি ও উপাচার্যদের মত

ড. কামরুল আহসান, ড. আতিকুল ইসলাম, ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, ড. তানভীর হাসান ও  ড. এম লুৎফর রহমান (বা থেকে)
ড. কামরুল আহসান, ড. আতিকুল ইসলাম, ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, ড. তানভীর হাসান ও ড. এম লুৎফর রহমান (বা থেকে)  © টিডিসি ফটো

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সময়ে উচ্চশিক্ষায় নতুন জ্ঞানের উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণের জন্য গবেষণার বিকল্প নেই। গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধিকে উচ্চশিক্ষার মূল লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রায় তিন দশক পরেও পিএইচডি গবেষণার কোন ক্ষেত্র তৈরি হয়নি। এই খাতের নীতিনির্ধারকেরা বিভিন্ন সময়ে উচ্চশিক্ষা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) কাছে পিএইচডি প্রোগ্রাম পরিচালনা বিষয়ে দাবি জানালেও এ বিষয়ে কোন অগ্রগতির দেখা মিলেনি। 

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, একটি গবেষণার আউটপুট দেশের অর্থনীতিতে বৃহৎ পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। দেশের দক্ষ জনশক্তি তৈরিতেও গবেষণায় গুরুত্ব দেয়ার বিকল্প নেই। তারা মনে করেন, বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়কেই পিএইচডি করানোর অনুমতি না দিয়ে সরকার ক্রাইটেরিয়া ঠিক করে দিলে যে বিষয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষতা আছে, তাদেরকে সে বিষয়ে পিএইচডি চালুর অনুমতি দেওয়া উচিত।

আরও পড়ুন: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি চালু হচ্ছে

তবে দীর্ঘদিন এ বিষয়ে কোন অগ্রগতি দেখা না গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জোর দাবির প্রেক্ষিতে এসব উচ্চশিক্ষালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এ বিষয়ে কার্যক্রমে গতি আনতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দকে আহ্বায়ক করে সম্প্রতি একটি নীতিমালা প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা এবং সক্ষমতার বিষয়ে কথা হয় ট্রাস্ট্রি (বিশ্ববিদ্যালয় মালিক) ও উপাচার্যদের সাথে। তারা জানান, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর দাবিটি দীর্ঘদিনের। এটি দেশের বেসরকারি উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক ও বহুল প্রতীক্ষিত।

গত দুয়েক বছরে এ দাবি বেশ জোরদার হয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবির প্রেক্ষিতে সভা-সেমিনারে এ বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রীসহ সরকারের অন্যান্য নীতি নির্ধারকরাও। চলে আসা এ আলোচনার পথ ধরে একটি সিদ্ধান্তে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। সম্প্রতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে উচ্চশিক্ষার তদারক এ সংস্থা।

জানতে চাইলে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর সংবাদটি অত্যন্ত আনন্দের। আমি মনে করছি, এটি দেশের বেসরকারি উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক ও বহুল প্রতীক্ষিত। এর মাধ্যমে নতুন একটি ধাপে উন্নীত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলো। শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ গোটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খাত এর সুফল পাবে।

“দেশের কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা এখন যে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমানতালে চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা করছে। এছাড়া বিদেশে পড়ালেখার ব্যাপারেও প্রতিযোগিতা করছে। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রাইভেটলি পিএইচডি থিসিস গাইড করছেন বা পরামর্শ দিচ্ছেন। এখন এ স্বীকৃতিটা আনুষ্ঠানিকভাবে আসলে খুব ভালো হবে।”

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম বলেন, এ সিদ্ধান্ত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ গোটা বেসরকারি উচ্চশিক্ষা খাতের জন্য খুশির একটি খবর। ইউজিসির এ উদ্যোগ দেশের উচ্চশিক্ষার ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে।

আরও পড়ুন: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি চালু করতে ছয় সদস্যের কমিটি

তিনি বলেন, পিএইচডি ডিগ্রি চালু হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা কার্যক্রম কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। যা আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় সরাসরি ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। পাশাপাশি ইন্ড্রাস্ট্রি কোলাবরেশনের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করবে পিএইচডি প্রোগ্রাম।

ইউজিসির পদক্ষেপকে ইতিবাচক উল্লেখ করে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (আইইউবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. তানভীর হাসান বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর বিষয়ে ইউজিসির নীতিগত সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায় আমরা। পদক্ষেপটি অত্যন্ত ইতিবাচক এবং সময়োপযোগী।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পিএইচডি ডিগ্রি চালু করতে একটি কমিটি গঠন করেছে ইউজিসি। ইউজিসির ছয় সদস্যবিশিষ্ট এ নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে—কমিশনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউজিসির সদস্য ড. অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দকে। কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে কমিশনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক মো. শরিফুল ইসলামকে। এছাড়াও কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন, ইউজিসির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য অধ্যাপক ড. হাসিনা খান, উত্তরা ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. গৌর গোবিন্দ গোস্বামী, গ্রিন ইউনিভার্সিটির কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল্লাহ এবং ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পরিচালক মো. ওমর ফারুখ।

“বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা সক্ষমতা বাড়াতে এবং সামগ্রিক শিক্ষার মান উন্নয়নে এটি কার্যকর ভূমিকা রাখবে। দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আইইউবি পিএইচডি কার্যক্রম শুরুর জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের কাছ থেকে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা পেলেই আশা করি আমরা পিএইচডি কার্যক্রম শুরু করতে পারবো।”

পিএইচডি কার্যক্রম পরিচালনায় অগ্রগতির বিষয়ে জানিয়ে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের (ইউএপি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান জানান, আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে উচ্চশিক্ষার অগ্রগতি এবং মান নিশ্চিতে ইউজিসি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। 

“আমি মনে করি এই উদ্যোগ উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। কারণ এখন পর্যন্ত আমরা শিক্ষক সংকটে ভুগছি। পাশাপাশি যারা এখনও শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন, তারা মাস্টার্স পাস করেই জয়েন করতে পারছেন। পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু হলে আরও অভিজ্ঞ এবং গবেষণায় সমৃদ্ধ লোকবল নিয়োগ দিতে পারব।”

অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান বলেন, পিএইচডি চালু করার জন্য ইউএপির শর্টটার্ম এবং লংটার্ম স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান আছে। যারা গবেষণা করবে ইউএপি তাদের জন্য রেমুনারেশনের ব্যবস্থাও রাখবে। এছাড়াও ইতোমধ্যে আমরা বিশেষায়িত ল্যাব স্থাপন করেছি। যেখান থেকে মানসম্মত ডিগ্রি প্রদান করতে পারব বলে আমরা দৃঢ় বিশ্বাস রাখি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পিএইচডি ডিগ্রি চালু নিয়ে ইউজিসির গঠিত কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়েছে, কমিটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করতে একটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করবে; কমিটি প্রয়োজনে এক বা একাধিক সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবে এবং কমিটি প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক ডিসিপ্লিন ও ক্লাস্টারের উপযোগী পিএইচডি কোর্সওয়ার্ক বা রিসার্চ মেথডোলজি-সংক্রান্ত কারিকুলাম বা মডিউলগুলো প্রণয়ন করতে পারবে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু এবং সক্ষমতা নিয়ে কথা হয় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ডিআইইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম লুৎফর রহমানের সাথে। ইউজিসিকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর বিষয়ে ইউজিসির অগ্রগতি আমাদের জন্য সুখকর। একইসাথে আমরা ইউজিসির কাছে কৃতজ্ঞ। তারা উচ্চশিক্ষার মান বাড়াতে উদগ্রীব।

“দীর্ঘদিন থেকেই এ বিষয়ে কার্যক্রম চলমান ছিল, আমরাও বিভিন্ন সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ইউজিসিকে অনুরোধ জানিয়েছিলাম। কিন্তু ফাইনালি এই উদ্যোগ বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে। ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করতে আগে থেকেই প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছে।”

বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রস্ততি সম্পর্কে অবগত করে তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা কাঠামো তৈরির বিষয়ে কাজ করছি। আমরা বিশ্বাস করি, অত্যন্ত সফলতার সাথে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করতে পারব। আমরা চাই যত দ্রুত সম্ভব ইউজিসির নীতিমালা প্রণয়ন কমিটি তাদের কাজ আঞ্জাম দিবে। ইউজিসি যেদিন থেকে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবে, আমরা সেদিনই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারব। সে অনুযায়ী আমরা নিজেদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছি।

 

সর্বশেষ সংবাদ