জন্মহারের পতনে এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে স্কুল
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ১৮ জুন ২০২৪, ০৩:৪০ PM , আপডেট: ১৮ জুন ২০২৪, ০৩:৪৫ PM
এশিয়ার অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশ তাইওয়ান। গত কয়েক দশকে অর্থনীতির মাপকাঠিতে প্রভূত উন্নতি হয়েছে সেখানে। কিন্তু তার সাথে পাল্লা দিয়ে কমেছে জন্মহার। ফলে শিক্ষার্থীর অভাবে বহু স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
দেশটির রাজধানী তাইপের চুং সিং বেসরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সব ডেস্ক, চেয়ার, বেঞ্চ জড়ো করে রাখা খেলার মাঠে। সেখান থেকে পিকআপে করে সেগুলো সরিয়ে নিচ্ছেন নির্মাণকর্মীরা। শিক্ষার্থী ভর্তির হার এতই কমতে শুরু করেছিল যে ২০১৯ সালে আর্থিক সংকটে স্কুলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিদ্যালয়ের জায়গাটি এক আবাসন কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। এখন স্কুলভবনটি ভেঙে ফেলবে ওই আবাসন কোম্পানি। তাইপের মধ্যাঞ্চলের একটি বেসরকারি স্কুলে এ পরিণতি আসলে পুরো তাইওয়ানের চিত্রেরই প্রতিচ্ছবি। জন্মহার কমার প্রভাব অন্যান্য খাতের মতো শিক্ষা খাতেও পড়ছে। শ্রেণিকক্ষগুলো শিক্ষার্থীপূর্ণ না থাকায় এমন অবস্থা হয়েছে।
এশিয়ার অন্যান্য অগ্রসর অর্থনীতির মতো, তাইওয়ানেও স্থিতিশীল জনসংখ্যা ধরে রাখার মতো প্রতিস্থাপন হার অর্জিত হচ্ছে না। গড় মৃত্যুহার যদি গড় প্রজনন হারের চেয়ে বেশি হয়– তাহলে জনসংখ্যার প্রতিস্থাপন হারে পতন হয়। আর এ দুটি সমান সমান থাকলে স্থিতিশীল থাকে জনসংখ্যা।
জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখতে তাইওয়ানের প্রজনন হার দরকার নারী প্রতি গড়ে ২.১। অর্থাৎ, তাইওয়ানিজ নারীরা যদি তাঁদের মোট প্রজনন বয়সকালে এই হারে শিশু জন্ম দেন– তাহলে জনসংখ্যার পতন রোধ করা যাবে। কিন্তু, ১৯৮০'র দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে এর ধারেকাছেও আর যেতে পারছে না তাইওয়ান। যেমন ২০২৩ সালে এই প্রজনন হার নেমে এসেছে শূন্য দশমিক ৮৬'তে।
জন্মহারের পতন যখন হয়, তখন তরুণদের চেয়ে বেড়ে যায় বয়স্ক জনসংখ্যা। অর্থাৎ, অর্থনীতিতে নবীন কর্মীদের ঘাটতি তৈরি হবে। যার হাত ধরে আসতে পারে অর্থনৈতিক সংকট। বয়স্করাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে তখন সীমিত সংখ্যক তরুণদের করের টাকায় বয়োবৃদ্ধদের দেখভাল করা বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদান সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠবে। এমনই আশঙ্কা, তাইওয়ানের সরকার ও জনসংখ্যাবিদদের।
তরুণ প্রজন্ম সংকোচনের প্রভাব এরমধ্যেই পড়েছে তাইওয়ানের সামরিক বাহিনীর ভর্তির কার্যক্রমে। এখন যা বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলের ভর্তির ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। যেমন ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে, তাইওয়ানের প্রাথমিক ও জুনিয়র হাই স্কুলগুলোয় ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৩ লাখ থেকে ১৮ লাখের নিচে নেমে এসেছে ।
তাইওয়ানে জীবনযাপনের মান উন্নত হলেও গত কয়েক দশকে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়েছে। তাইপে সিটির একজন বাসিন্দা মিসেস লাই। তাঁর ২২ বছর বয়সের এক সন্তান রয়েছে। তবে এরপরে আর সন্তান তিনি নিতে চান না। লাই বলেন, সন্তান লালনপালনের ব্যয় এখন খুব বেশি, সেটা অর্থ আর সময়– দুদিক থেকেই। বেতন বাড়ানো এবং কর্মঘণ্টা কমানো নাহলে দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার ভাবাই যায় না।
কচিকাচার ভিড় না থাকায় প্রথমেই বন্ধ হচ্ছে বেসরকারি স্কুলগুলো। বেসরকারির চেয়ে সরকারি বিদ্যালয়ে সন্তানকে পড়াতেই আগ্রহ বেশি অভিভাবকদের। ফলে আপাতত সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছে না। কিন্তু, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিজস্ব ব্যয়ভার বহন করতে হয়, শিক্ষার্থী এতটা কমে গেলে তা আর খোলা রাখা যায় না।
তাইওয়ানের গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলোর সূত্রে জানা যাচ্ছে, বর্তমানে কয়েক ডজন বেসরকারি স্কুল বন্ধের উপক্রম। অর্থ সহায়তা দিতে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি তালিকাও করেছে সরকার। বর্তমানে এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে ১৩টি বেসরকারি স্কুল ও কারিগরি উচ্চ বিদ্যালয়। এগুলো আগামী বছরের শুরুর দিকেই বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে গত মার্চে তাইপে টাইমসের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়।
তাইওয়ানের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে জানায়, ২০১৪ সাল থেকে ১৫টি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে। তাইওয়ানে মোট ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়- এরমধ্যে আর্থিক সংকটের কারণে চারটি প্রতিষ্ঠানকে বন্ধের আদেশ দেওয়া হয়েছে।
বেসরকারি শিক্ষাবিদদের প্রতিষ্ঠান– ইউনিয়ন অব প্রাইভেট স্কুল এডুকেটরস এর চেয়ারপার্সন উ চুন-চুং বলেন, ২০২৮ সালের মধ্যে আরো ৪০ থেকে ৫০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হবে বলে ধারণা করছেন তিনি।
তাইওয়ান হায়ার এডুকেশন ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট চু পিং বলেন, আমাদের শহরাঞ্চলের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অচিরেই বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে নেই আপাতত। তবে যেগুলো মফস্বল বা গ্রামীণ এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, যেখানে বিজ্ঞান বা কারিগরির চেয়ে মানবিক বিষয়গুলোর প্রাধান্য রয়েছে– সেগুলো উচ্চ ঝুঁকিতে আছে।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান