উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ‘খাতা দেখা’

উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষিত হলো। এক দল খুশি। জিপিএ ফাইভ! আরেক দল অল্প থেকে মারাত্মক ধরণের মন-মরা। এই সব নিয়ে কতো কথাই তো হয়। কিন্তু এসব নয়, আমি একটা খুব সাধারণ প্রসঙ্গ নিয়ে নিজের ভাবনা-চিন্তা তুলে ধরতে চাইছি- সেটি হচ্ছে পরীক্ষাগুলোর খাতা মূল্যায়ন বা খাতা-দেখা।

লাখ লাখ পরীক্ষার্থীর খাতা অল্প সময়ে মূল্যায়ন করে দ্রুত ফলাফল দেওয়া একটা অতি বড় উন্নয়নের বিষয়। সম্ভবত এ কারণেই এই ফলাফল প্রকাশের সময় আমাদের রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহীর হস্তস্পর্শ অতি আবশ্যক হয়ে উঠেছে। সে যাই হোক, যে প্রসঙ্গে বলতে চাইছিলাম তা হলো- খাতা মূল্যায়ন।

বাংলা-ইংরেজির মতো বিষয়গুলোতে একজন পরীক্ষক কম পক্ষে পাঁচশ-ছয়শ খাতা মূল্যায়নের জন্য পান। তাদের সময় দেওয়া হয় সর্বোচ্চ ২১ দিন। ৫০০ খাতা দেখে শেষ করতে হয় ২১ দিনে। তার মানে, যারা ৫শ’ খাতা পান তাদের ২১ দিন কোনো রকম শৈথিল্য ছাড়া প্রতিদিন গড়ে ২৩/২৪টি খাতা দেখতে হয়। আর যারা ৬শ’ খাতা পান (যেটা ইংরেজির ক্ষেত্রে নূন্যতম সংখ্যা) তাদের গড়ে প্রতিদিন ২৮/২৯টি খাতা দেখতে হয়। অন্যান্য বিষয়ের খাতা-মূল্যায়নের সময়ও কমবেশি একই রকম। এই ব্যাপারটিই আমাকে ভাবায়।

একজন শিক্ষক যখন খাতা দেখেন তখন তিনি কলেজ থেকে ছুটি পান না, তাকে আর সব কাজের পাশাপাশি এই খাতাগুলো ‘কাটতে’ হয়। এমন কি ক্লাস-টেস্ট বা সিটি খাতা দেখা থেকেও তার মুক্তি মেলে না। সাধারণভাবে ৭/৮ ঘণ্টা সময় তাকে প্রতিদিন কলেজে দিতেই হয়। কলেজে যাওয়া আসা মিলে নিশ্চয়ই আরও কিছু সময় তাকে ব্যয় করতে হয়। তাকে ঘুমুতে হয়, খেতে হয়, স্নানাদি করতে হয়, তার জন্যও সময় যায় নূন্যতম আট ঘণ্টা। মোট ১৬ ঘণ্টার নিত্যদিন তার কলেজ-আর একান্ত নিজের ব্যবস্থাপনায় ব্যয় করতে হয়ই। থাকলো আর আধঘণ্টা। এই আধঘণ্টা করে টানা ২১ দিন যদি উনি খাতা দেখেন তাহলে প্রতি খাতার জন্য সময় পান খুব বেশি হলে ১৫/১৬ মিনিট।

প্রতিটি খাতা দেখে নম্বর দিলেই চলে না, সেসবে আবার সিরিয়াল নম্বর দিতে হয়, বেশ কিছু তথ্য দু’বার করে ওএমআর-শিটে অঙ্কে লিখে বৃত্তভরাট করতে হয়। প্রতি প্রশ্নের উত্তরের নম্বর লিখতে হয়, বৃত্তভরাট করতে হয়, নম্বর যোগ করে মোট নম্বর লিখতে হয়। এই কাজে ৯/১০ মিনিট লাগেই। এছাড়া বোর্ড থেকে খাতা নিয়ে আসা, প্রধান পরীক্ষকের বাসায় তা পৌঁছে দেওয়ায় ব্যয় হয় তিন/চার দিনের প্রায় সিংহভাগ অংশ। এই কাজে ২১ দিন সময় কেউ পান না, পান আসলে ১৭/১৮ দিন। মোদ্দা কথা হচ্ছে, একজন পরীক্ষক খাতা মূল্যায়নে যদি ২১ দিন টানা আট ঘণ্টা করে সময়ও দেন (যা বাস্তবে প্রায় অসম্ভব) তাহলে খাতা প্রতি উনি ১২ থেকে ১৫ মিনিট সময় দিতে পারেন।

এবার চিন্তা করেন, খাতা মূল্যায়নের কাজটি কতোটা যথাযথভাবে করা সম্ভব? সকল কাজ করার পাশাপাশি ২১ দিন টানা আট ঘণ্টা করে খাতা দেখলে একটা খাতা মূল্যায়নে যেখানে ১৫ মিনিট দেওয়া সম্ভব সেখানে বাস্তবতা হচ্ছে, প্রতিদিন "খাতা কাটার" জন্য একজন পরীক্ষক দিনে ২/৩ ঘণ্টাও সময় বের করতে পারেন না। ২১ দিনের মধ্যে নিশ্চয়ই তাকে বাজার করতে হয়, ছেলেমেয়ে-মাবাবা'র অসুস্থতা বা আমোদেও কিছু সময় যায়। এছাড়া টিউশনি করে সংসার চালাতে হয় বিপুল সংখ্যককে। এরই মাঝে তারা শত শত "খাতা-কাটেন", নম্বর ফর্দ তৈরি করেন। ভুল হওয়া তাই স্বাভাবিক।

প্রথম পরীক্ষকরা যদি ভুলটুল কিছু করেন তা প্রতিরোধে ব্যবস্থা রাখা আছে। প্রধান পরীক্ষক বলে একজন থাকেন, তিনি নিজে অন্তত হাজার/বারশ' খাতা দেখেন, পাশাপাশি তিনি অন্তত চার হাজার খাতার নিরীক্ষা কাজটি সারেন। যে লোকবল ও সময় কাজটির জন্য বরাদ্দ থাকে সে বিবেচনায় এটি যে হাস্যকর রকমের অসম্ভব কাজ তা প্রধান পরীক্ষকরাও স্বীকার করবেন বলে আমার বিশ্বাস।

এবার ভেবে দেখেন, যে ফলাফল নিয়ে এতো মাতামাতি তা তৈরি হয়েছে খাতা প্রতি ৫/৬ মিনিটেরও স্বল্প সময়ে। ৫ মিনিটের এই মূল্যায়ন আসলেই কি কোনো গুরুত্ব বহন করে? এই অবাস্তব প্রক্রিয়ার ওপরই নির্ভর করে আমাদের এক একজন ছাত্র/ছাত্রীর উচ্চ-শিক্ষা। এক কথায় পুরো জীবন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

(লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)


সর্বশেষ সংবাদ