জন্মদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কিছু কথা

প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়ের আজ জন্মদিন। শতায়ুর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের আবেগ ও ভালোবাসার আরেক নাম। আজকের দিনে প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি অনুষদ, ১২টি বিভাগ, বিভিন্ন বিভাগে ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী এবং ৬০ জন শিক্ষক নিয়ে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে। যে বিশ্ববিদ্যালয় এনে দিয়েছিল মায়ের ভাষা। যার অঙ্গনে প্রথম পতপত করে উড়েছিল আমাদের অহঙ্কার লাল সবুজের পতাকা। যে দিয়েছিল এক খন্ড ভূখন্ড আলাদা মানচিত্র।

আজ জন্মদিনে মনে পড়ছে ঢাবির সেই অনন্য অবদান ও ব্যর্থতার কিছু ইতিহাস। একজন ক্ষুদ্র মানুষ হিসেবে এই বিশাল বট বৃক্ষের অবয়বে ছড়িয়ে পড়া মহীরূহের সমালোচনা করার যোগ্যতা ও সাধ্য আমার নেই। তারপরেও এ বিদ্যা কুঞ্জের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল অর্জনে যেমন পুলক অনুভব করি তেমনি কখনো কখনো ঢাবির নীরবতা ও এর পরিবারের সদস্যদের অনভিপ্রেত কার্যকলাপ ও বচনে চরমভাবে ব্যথিত হই। বিগত প্রায় এক শতাব্দী ঢাবির অর্জন কম নয় কিন্তু তারপরেও শতায়ুর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানের অর্জন আমার কাছে অপ্রতুল ও অপর্যাপ্ত মনে হয়েছে। সূচনালগ্নে ঢাবির যে গৌরব ও অর্জন ছিল তা অনেকটা ঈর্ষণীয়।

এ বিশ্ববিদ্যালয় জন্মলগ্ন থেকে শিক্ষা, গবেষণা ও জাতীয়ভাবে অবদানের ক্ষেত্রে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে। দেশের বহু জ্ঞানীগুণী, পণ্ডিত, শিল্পী-সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদের জন্ম হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি শিক্ষার্থী ছিলেন বোস-আইনস্টাইন সূত্রের জনক সত্যন্দ্রনাথ বোস, আধুনিক স্থাপত্য প্রকৌশলের প্রবক্তা ফজলুর রহমান খান,২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস,পিভি নাম্বারের যৌথ আবিষ্কারক বিজয়রাঘবান, সমাজকর্মী এবং অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান, জনপ্রিয় কবি বুদ্ধদেব বসু ,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। বিভিন্ন সময়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কবি ফাইজ আহমেদ ফাইজসহ বিভিন্ন মনীষীর সান্নিধ্যে ধন্য এ ক্যাম্পাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল একটি মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজ সৃষ্টি। এই মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজই পরবর্তীকালে পূর্ব বঙ্গের সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনে নেতৃত্ব দান করে। বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে পূর্ব বঙ্গে মুসলিম সমাজে যে নবজাগরণ শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তারই ফল। দেশবিভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সকল প্রগতিশীল এবং গনতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালনকারী হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্ররা কেন্দ্রীয় ভুমিকা পালন করেছেন।স্বাধীনতাযুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়। এতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ছাত্রছাত্রীসহ শহীদ হয়েছেন বহুজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে ১৯৬১ সালে স্বৈরাচার আইয়ুব খান প্রবর্তিত অর্ডিন্যান্স বাতিলের জন্য ষাটের দশক থেকে শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ওই অর্ডিন্যান্স বাতিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ-১৯৭৩ জারি করে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় এই অধ্যাদেশে দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ও অবদান হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের নেপথ্যে মূল কারিগর হিসেবে ।যেখানে একটি দেশের সরকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে বিশেষ অবদান রেখেছিল।

ডাকসু অন্যায় অবিচার ও সকল অপরাজনীতির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোর একটি প্লাটফর্ম । আমরা দেখতে পাই ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ‘৬২ এর শিক্ষানীতি, ৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলন, ‘৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এমনকি ১৯৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ডাকসু । বহুকাল ধরে ডাকসুই নতুন ও জাতীয় নেতৃত্ব তৈরিতে মূল ভূমিকা রেখেছে। এরপর দীর্ঘদিন ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় আমরা দক্ষ নেতৃত্ব হতে বঞ্চিত হচ্ছিলাম। ২৮ বছর পর একটু আশার আলো উদগিরিৎ হলেও এবারের ডাকসু নির্বাচন বিতর্কিত হওয়ায় আমরা আশাহত।

ঢাবির সেই অতীতের গৌরব এখন কিছুটা হলেও ম্লান। সর্বক্ষেত্রে দলীয় করণ,সহিংস ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষকদের সাদা হলুদ কালো বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্তি। শিক্ষক নিয়োগে চরম দলীয় করণ এক সময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাবিকে নিয়ে যাচ্ছে মানহীন শিক্ষার অতল গহ্বরে।

গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে জানা যায় উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সাড়ে ৮ বছরের মেয়াদে মোট ৯০৭ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শেষ তিন বছরে নিয়োগ পেয়েছেন ৩৫০ জন। শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করে এবং যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অন্তত ৭৮ জন এবং সীমাহীন দলীয়করণ তো আছেই। রাজনৈতিক প্রভাব, পর্যাপ্ত গবেষণা ও পরিমিত বাজেটের অভাবে ঢাবির শিক্ষার মান অধোগতির দিকে। তাই বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে ১০০ এর মধ্যে ঢাকা এখন বিশ্ববিদ্যালয়কে খুঁজে পাওয়া যায় না।

বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক জ্ঞান বিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি করছে কিন্তু আমাদের কি অবস্থা? আজ চা চামুছা সিংগারার থিওরি দিচ্ছি। আমাদের শিক্ষার্থীরা কত টাকা টিউশন ফি দেন তা নিয়ে শিক্ষক উদ্ধত ভাষায় কথা বলেন। অথচ তিনি ছাত্র জীবনে ঢাবিতে অধ্যয়নকালে কত পাউন্ড টিউশন দিয়েছেন তা কিন্তু বললেন না। ঢাবিতে যারা পড়াশোনা করেন তারা অধিকাংশ এদেশের কৃষকের সন্তান। দেশের কৃষক তো পাউন্ডের হিসাব জানেন না। তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যা উপার্জন করেন তা মাস শেষে ছেলেটি বা মেয়েটির জন্য পাঠিয়ে দেন। তাদের কাছে পাউন্ডের কথা বলা বড় বেমানান ও অসস্তির বটে। শিক্ষকদের কথা বার্তায় আরো সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।আবার পাউন্ড উৎকোচ না দেওয়ায় ঢাবি বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে নেই। এ ধরনের কথা খুবই হাস্যকর ও অর্বাচীনের মতো শোনায়। এ কথা গুলো জনগণের মধ্যে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেয়। শিক্ষক সমাজ জাতি বিনির্মাণে কারিগর ও জাতিকে আলোকিত করার বাতিঘর। তারা যদি দায়িত্বহীন ও দলীয় পরিচয়ে নিজেদের উপস্থাপন করেন তাহলে এ জাতি কিভাবে আলোকিত ও সঠিক দিশা প্রাপ্ত হবে?আপনাদের জন্য শেখ সাদীর কথায় যথেষ্ট "একজন ঘুমন্ত ব্যক্তি আরেকজন ঘুমন্ত ব্যক্তিকে জাগ্রত করতে পারে না। ”

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ লাভের পর ডঃ ফিলিপ জোসেফ হারটগ তাঁর ভাষণে বলেন -
“জ্ঞানবৃদ্ধির ক্ষমতা ছাড়াই একজন হয়তো প্রাথমিক বিষয়গুলোর খুব ভাল শিক্ষক হতে পারেন কিন্তু আমার মনে হয় আরও উচ্চতর পর্যায়ে কল্পনা এবং জটিল চিন্তাশক্তির সমষ্টি ব্যাতিত একজনের পক্ষে ভালভাবে পাঠদান করা সম্ভব নয়। কেননা কল্পনা এবং জটিল চিন্তাশক্তির সমন্বয়ে জ্ঞানের উদ্ভাবন হয়। আর এ কারনেই সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় হতে হলে এখানকার শিক্ষকদের নিজেদের জ্ঞান বৃদ্ধিতে সমর্থ হতে হবে”।

পরিশেষে বলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যুগেযুগে বিলিয়ে দিক জ্ঞানের আলো। সেই আলোয় আলোকিত হই আমরা। সমৃদ্ধ করি দেশ ও জাতিকে। জন্মদিনে এই হোক আমাদের মনের চাওয়া। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুর্লভ জন্ম কবিতা দিয়ে শেষ করছি।

যা পাই নি তাও থাক, যা পেয়েছি তাও—
তুচ্ছ ব’লে যা চাই নি তাই মোরে দাও।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক


সর্বশেষ সংবাদ