বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা: গবেষণা বনাম ডিগ্রি নির্ভরতা
- মো. মাহমুদুল হাসান
- প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:৩৭ PM , আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:৪০ PM
ডিগ্রি না জ্ঞান-বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার বাস্তবতা
বাংলাদেশের ৫৬টি সরকারি ও ১১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করছে। ক্যাম্পাসগুলোতে সমাবর্তন, সনদপ্রাপ্তি ও চাকরির প্রত্যাশা চোখে পড়ে। কিন্তু এর আড়ালে একটি প্রশ্ন চাপা পড়ে যায়- এই শিক্ষার্থীরা কি জ্ঞান সৃষ্টি ও গবেষণার দক্ষতা অর্জন করছে, নাকি কেবল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য যদি জ্ঞান সৃষ্টিই হয়, তবে আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সেই লক্ষ্য কতটা পূরণ করছে- এটি এখন সময়োপযোগী প্রশ্ন।
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার বর্তমান পরিস্থিতি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডিগ্রি-কেন্দ্রিক। শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয় ভালো ফল, দ্রুত সেশন শেষ করা, সনদ এবং চাকরির জন্য। এতে দেখা যায়, গবেষণার চর্চা প্রায়ই এক ধরনের আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকে। পাঠ্যক্রমের বড় অংশ পরীক্ষা প্রস্তুতি, নোট মুখস্থ করা এবং ক্লাস রেকর্ড পূরণের মধ্য দিয়ে চলে, যেখানে নতুন ধারণা বা সমস্যার সমাধানের জন্য সময় বের করা হয় না।
গবেষণার প্রতি অনাগ্রহের বাস্তব কারণ
শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে গবেষণার প্রতি অনাগ্রহের পেছনে অনেক কারণ কাজ করছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হল-
*চাকরিমুখী মানসিকতা: শিক্ষার্থীরা মনে করে গবেষণা নয়- সিজিপিএ এবং সনদই চাকরির প্রধান চাবিকাঠি। ফলে গবেষণা সময়সাপেক্ষ এবং ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়। সত্যিকার অর্থেই প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে গবেষণা বিষয়ক কোনো শর্তই পূরণ করতে হয় না।
*প্রকাশনার সংস্কৃতি: অনেক সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার মানের চেয়ে প্রকাশনার সংখ্যা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, শিক্ষকেরা কেবলমাত্র পদোন্নতির জন্য শর্ত পূরণে মনোযোগী, জার্নালের প্রকাশনা কেবলমাত্র প্রোফাইলে দেখানোর জন্য। আর শিক্ষার্থীরাও দেখে যে, গবেষণা মূলত ফর্মালিটি। এতে গভীর অনুসন্ধান, বাস্তব সমস্যা সমাধানের মানসিকতা, এবং গবেষণা ও প্রকাশনা সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
*অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা: পর্যাপ্ত গবেষণা তহবিল, ল্যাব সুবিধা, ডেটাবেস এবং আন্তর্জাতিক জার্নাল অ্যাক্সেস এখনও সীমিত। উদাহরণস্বরূপ, দেশের অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও গবেষণা প্রকল্পের বাজেট বছরের শুরুতেই সীমিত এবং ছাত্র-শিক্ষকরা প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে প্রকল্প পরিচালনায় হিমশিম খায়। হাতে গোনা ২/৪টা ছাড়া বাকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও একই চিত্র।
*নীতিগত দুর্বলতা: গবেষণা নৈতিকতা, প্রশিক্ষণ এবং আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সহযোগিতার অভাব গবেষণার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যদিও বর্তমানে কিছু সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন অ্যালায়েন্স গঠন করে নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ- ‘অ্যালায়েন্স অব ইউনিভার্সিটিজ ইন আশুলিয়া’, যা আশুলিয়া অঞ্চলের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সমন্বয়ে গঠিত। এর অন্তর্ভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হল- ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ও সিটি ইউনিভার্সিটি।
এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের অতিরিক্ত ক্লাস ও বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব গবেষণার জন্য সময় কমিয়ে দেয়।
ডিগ্রি-কেন্দ্রিক শিক্ষার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব
ডিগ্রি-নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাব কেবল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়; এটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নেও প্রভাব ফেলে। আমরা এমন মানবসম্পদ তৈরি করছি, যারা পরীক্ষায় দক্ষ, কিন্তু সমস্যা বিশ্লেষণ, সমাধান, গবেষণা বা উদ্ভাবনে পিছিয়ে।
উদ্ভাবন, প্রযুক্তি উন্নয়ন, সামাজিক গবেষণা এবং নীতি প্রণয়নেও দেশীয় গবেষণার অবদান সীমিত। উদাহরণস্বরূপ, কৃষিক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তি ও জাতের উদ্ভাবনে স্থানীয় গবেষণার অংশগ্রহণ কম। ফলে আমরা বিদেশি প্রযুক্তি ও গবেষণার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ি, যা জাতীয় স্বাতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর।
বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার দিক থেকেও সমস্যা স্পষ্ট। আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি নিম্ন পর্যায়ে অবস্থান করছে। যেখানে গবেষণার ফলাফল দেশ ও অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে, সেখানে আমাদের শিক্ষার্থীরা শুধু পরীক্ষা উত্তীর্ণ হওয়ার দক্ষতায় সীমাবদ্ধ।
উন্নত বিশ্বের তুলনা
উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণাই শিক্ষার মূল চালিকাশক্তি। সেখানে স্নাতক পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীরা গবেষণাভিত্তিক প্রকল্পে যুক্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি বা স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শিক্ষার্থীরা ল্যাবভিত্তিক প্রকল্প, ইন্ডাস্ট্রি-ইউনিভার্সিটি সহযোগিতা এবং বাস্তব সমস্যা সমাধান প্রকল্পে অংশ নেয়।
শুধু গবেষণা নয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমস্যা সমাধান, বিশ্লেষণত্মাক চিন্তা এবং সৃজনশীলতা গড়ে তোলা হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, এ ধরনের সুযোগ সীমিত। ফলে আমরা নতুন ধারণা বা উদ্ভাবনে পিছিয়ে পড়ি, এবং জ্ঞান-উৎপাদনও বিদেশি নির্ভর হতে হয়।
গবেষণাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে করণীয়
বাংলাদেশে গবেষণাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে হলে প্রথমে মানসিক পরিবর্তন জরুরি। ডিগ্রিকে কেবল সনদ হিসেবে নয়, বরং শেখা ও গবেষণার ধাপ হিসেবে দেখতে হবে।
*নীতি ও অর্থায়ন: সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে গবেষণার জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং তার কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের পদোন্নতি, সম্মানী ও প্রশিক্ষণে গবেষণার প্রকৃত মানকে গুরুত্ব দিতে হবে।
*শিক্ষার্থীদের উৎসাহ: পাঠ্যক্রমে গবেষণাভিত্তিক অ্যাসাইনমেন্ট, সমস্যা-ভিত্তিক শেখা এবং সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে সংযুক্ত প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষি, স্বাস্থ্য বা তথ্যপ্রযুক্তি খাতে শিক্ষার্থীদের গবেষণা প্রকল্প বাস্তব সমস্যার সমাধান করতে পারলে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে।
*প্রশিক্ষণ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: শিক্ষার্থীদের এবং শিক্ষকদের জন্য আন্তর্জাতিক কনফারেন্স, ওয়ার্কশপ ও একাডেমিক এক্সচেঞ্জ সুবিধা বাড়াতে হবে। এতে নতুন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন হবে।
*প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি: বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে গবেষণাভিত্তিক সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে- যাতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বাজেট বরাদ্দসহ যেখানে প্রশ্ন করা, নতুন ধারণা এবং ভিন্নমত প্রকাশ স্বাভাবিক ও উৎসাহিত হবে।
সবার জন্য সুস্পষ্ট বার্তা
*শিক্ষার্থীদের প্রতি বার্তা: ডিগ্রি শুধু শুরু, শেষ নয়। গবেষণা আপনাকে আলাদা করবে, চিন্তাশীল ও দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে।
*শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান: শিক্ষাদান ও গবেষণাকে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে দেখুন। গবেষণা শুধু জার্নাল বা পত্রিকা প্রকাশ নয়; এটি জ্ঞান সৃষ্টি ও সমাজে অবদান রাখার সুযোগ।
*বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব: গবেষণাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করন। পর্যাপ্ত ল্যাব, ডেটাবেস, গবেষণা তহবিল এবং সময় বরাদ্দ দেওয়া।
*নীতিনির্ধারকদের বার্তা: গবেষণায় বিনিয়োগ মানেই দেশের ভবিষ্যতে বিনিয়োগ। এটি একটি জাতীয় দায়িত্ব।
বিশ্ববিদ্যালয় যদি কেবল ডিগ্রি বিতরণের প্রতিষ্ঠান হয়, তবে জাতির চিন্তাশক্তি স্থবির হবে। আর যদি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার কেন্দ্র হয়ে ওঠে, তবে সেখান থেকেই জন্ম নেবে নতুন জ্ঞান, নতুন উদ্ভাবন এবং একটি আত্মনির্ভর বাংলাদেশ।
এখন সিদ্ধান্ত আমাদের- ডিগ্রি-কেন্দ্রিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেবো, নাকি গবেষণাভিত্তিক উচ্চশিক্ষা গড়ে তুলবো?
লেখক: প্রভাষক, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
ই-মেইল: mahmud@aub.ac.bd