জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুদিনে তাঁর চিঠি ও অন্যান্য কথা

নওশাদ জামিল 
নওশাদ জামিল   © টিডিসি সম্পাদিত

চিঠিপত্র লেখার সেই আনন্দময় সময়গুলো সত্যিই স্মৃতি হয়ে গেছে। শেষ কবে কাকে চিঠি লিখেছিলাম, এখন তা আর মনে নেই। মনে থাকার কথাও নয়। এটুকু শুধু স্পষ্ট, চিঠি পেলে ভীষণ ভালো লাগত। আমাদের কৈশোরে চিঠির সেই উষ্ণ আনন্দের রেশ আজ সময়ের গাঢ় হতাশার ছায়ায় মিলিয়ে গেছে, বিজ্ঞানের বিস্ময়কর সব আবিষ্কার অনুভূতিকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।

নতুন শতাব্দীর গোড়ায় মফস্বলে স্কুলজীবন পেরিয়ে ঢাকায় এলাম, ঢাকা স্টেট কলেজে ভর্তি হলাম। কলেজ আঙিনায় পা রাখার পর হাতে এল মুঠোফোন। কলেজ পেরিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাতেই আমাদের সামনে এল ইন্টারনেট, ইমেল। তারপর এল ফেসবুক ও অন্যান্য মাধ্যম। বিজ্ঞানের বিস্ময়কর তেলেসমাতি দুনিয়া। এসবই চিঠির মূল হন্তারক। আমরা যখন চিঠি লেখার ও পাওয়ার উষ্ণতা একটু একটু করে বুঝতে শুরু করেছিলাম, ঠিক তখনই তার গায়ে ঠান্ডা জল ঢেলে দিল প্রযুক্তির শীতল হাত। ইন্টারনেটের ছোঁয়ায় যদি দূরকে আপন করা যায়, মুহূর্তেই যদি পৌঁছে দেয়া যায় সমূহ বার্তা, তবে কে আর ডাকপিয়নের অপেক্ষায় থাকবেন?

চিঠির কথা বলার নেপথ্যে আছে দুটো বিষয়। প্রথমটি, আমার বেড়ে ওঠার ও জেগে ওঠার সময়ে চিঠি লেখার প্রচলন ছিল। ময়মনসিংহের এক অখ্যাত গ্রাম থেকে আমিও তো চিঠি লিখেছিলাম; স্কুলের ওপরের ক্লাসে পড়ার সময় চিঠি লিখেছিলাম, সঙ্গে দুটি কবিতাও পাঠিয়েছিলাম কবি শামসুর রাহমানের শ্যামলীর ঠিকানায়। স্নেহভরে তিনি আশীর্বাদ জানিয়ে উত্তর দিয়েছিলেন। চিঠি পেয়ে সেকি আনন্দ, সেকি উত্তেজনা! তারপর যখন ঢাকায় চলে এলাম, ভর্তি হলাম কলেজে, তখন তো ইচ্ছা হলেই চলে যেতাম কবির শ্যামলীর বাসায়। কবিকে প্রথম সামনাসামনি দেখে যতটা শিহরিত হয়েছিলাম, তার ঢের বেশি আলোড়িত হয়েছিলাম চিঠি পেয়ে। কবি শামসুর রাহমানের চিঠি পাওয়ার সেই আনন্দ, সেই ভালোলাগার অনুভূতি আজও হৃদয়ের অতলে সদা জাগরূক।

চিঠির কথা যখন বলছি, তাহলে এটাও বলি প্রিয় কোনো লেখককে চিঠি লিখতে ইচ্ছা হয় আমার। প্রিয় লেখকের সঙ্গে চিঠির পাতায় শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আলোচনা, কখনোবা ব্যাক্তিগত সমস্যা কিংবা সঙ্কটের কথাও লিখতে ইচ্ছা হয় প্রাণখুলে। পাশাপাশি প্রিয় লেখকের মূল্যায়ন কিংবা পরামর্শ চিঠি আকারে পেতে ইচ্ছা হয়। চিঠি কাকে লিখব, যাকে লিখব, তিনি কি উত্তর দেবেন? ব্যস্ততা ফেলে রেখে আমার মতো যৎসামান্য সাহিত্যিককে কেন লিখবেন?

ইন্টারনেটের যুগে আমরা যারা লেখালেখি করি, আমরা একই সঙ্গে ভাগ্যবান, আবার দারুণ দুর্ভাগাও। হাতের কাছেই পেয়ে যাই সমগ্র পৃথিবী, তারপরও একজন মানুষও নেই, প্রাণখুলে যাকে চিঠি লেখা যায়!

এবার চিঠির কথা বলার দ্বিতীয় কারণ বলি। একবার পড়েছিলাম ফয়জুল লতিফ চৌধুরী সম্পাদিত ‘জীবনানন্দ দাশের চিঠিপত্র’ বইটি, প্রিয় কবির চিঠিগুলো পড়তে পড়তে বারবার চোখে ভেসে উঠছিল আমার কৈশোরের কত স্মৃতি! সারল্য ভরা মানুষটি কী বিনয়ের সঙ্গেই না বলেছিলেন একটি চিঠি লিখতে।

কবি জীবনানন্দ দাশ চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘কালিদাস তাঁর মেঘদূতে বলেছিলেন শ্রেষ্ঠজনের কাছে দাবি জানাতে হয়, তাঁরা মানুষের আন্তরিক দাবির সম্মান রক্ষা করেন। আমিও আজ একটা মস্ত দাবি নিয়ে আপনার কাছে হাজির হয়েছি। আপনি যদি সময় করে এই বইটা পড়ে দেখেন—ও তারপর বিশদভাবে আমাকে একখানা চিঠি লেখেন তা হলে আমি খুব উপকৃত বোধ করব। বিস্তৃতভাবে আলোচনা করবার জন্য আপনাকে অনুরোধ করলাম বলে ক্ষমা করবেন। কিন্তু আগেই বলেছি আমার আজকের দাবিটা খুব মস্ত বড়, এবং সবচেয়ে মহত্জনের কাছে।’

কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পাঠিয়ে চিঠিটি লিখেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। বরিশালের মতো আধাগ্রাম-সিকিশহরে তিনি থাকেন। শিক্ষকতা করেন বজ্রমোহন কলেজে। জীবনানন্দ দাশ প্রমথ চৌধুরীকেও চিঠি লিখেছিলেন, সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ বইখানা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যেমন বিনয়ের সঙ্গে লিখেছেন, প্রমথ চৌধুরীকে লেখা চিঠিও তেমন বিনয়াবনত, ভক্তিপূর্ণ। জীবনানন্দ দাশ খুব করে অনুরোধ করেছিলেন, বইটি পড়ে যেন ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেন তাঁর প্রিয় গদ্যশিল্পী প্রমথ চৌধুরী।

জীবনানন্দ দাশের অনুরোধ কে রেখেছেন, কে রাখেননি তা এখন ইতিহাস। সাহিত্যের সেই আলো-আঁধারির ইতিহাস না ঘেঁটে, জীবনানন্দ দাশের চিঠি নিয়ে কিছু কথা বলি। কবি, আমারও খুব ইচ্ছা হয়েছিল আপনাকে একটা চিঠি লিখতে! ডায়েরি পাতায় একটা খসড়াও করেছিলাম, সেটাও কৈশোরের কথা; বিনয়ের সঙ্গে লিখেছিলাম, ‘প্রিয় কবি, আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। বাংলাদেশের তরুণ কবি আমি। কবিতা পড়ি, লিখিও মাঝেমধ্যে। গভীর বিস্ময় নিয়ে অনেকবার পড়েছি আপনার কবিতা। অনেকবার। যতবার পড়েছি, ততবারই বুঝেছি আপনি দীপ্তিময় এক অনন্যসাধারণ অলীক পাহাড়। যখনই চাই অতিক্রম করতে, তখনই পায়ে পায়ে টেনে ধরে রাজ্যের কুয়াশাজাল। আমার পা দুটি বরফ হয়ে যায়, তারপর গলে যায়। গলতে গলতে মিশে যায় পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে। আপনাকে অতিক্রম করতে চাই, ছাড়িয়েও যেতে চাই বীরদর্পে। আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনিই যখন বড় প্রতিবন্ধক, তখন আপনার কাছেই দ্বারস্থ হয়েছি। আমাকে পরামর্শ দিয়ে একটি চিঠি লিখবেন।’

চিঠির কথাটুকু স্মৃতি থেকে লিখলাম, ডায়েরিতে এমনটাই লিখেছিলাম বোধ হয়। যেমনটাই লিখি না কেন, স্পষ্টত মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশকে তিনটি চিঠি লিখেছিলাম। আমার সেসব চিঠি, সেসব আবেগের কথা জীবনানন্দ দাশ পড়েননি, তাঁর পড়ার কথাও নয়, কেননা সেসব চিঠি তো ডাকে পাঠানো হয়নি। কোথায় পাব তাঁর বর্তমান ঠিকানা?

চিঠি নিয়ে সেসব স্মৃতি সবই কৈশোরের। প্রথমবার যখন ভূমেন্দ্র গুহকে দেখি, সম্ভবত সেটা ২০০৯ সালের গোড়ার দিকের ঘটনা, তাঁকে দেখেছিলাম বেঙ্গল শিল্পালয়ে, জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে বলেছিলেন তাঁর স্মৃতির কথা, অনুভবের কথা; তাঁর কথা তন্ময় হয়ে শুনতে শুনতে বারবার মনে পড়ছিল জীবনানন্দ দাশের উদ্দেশ্যে কৈশোরে চিঠি লেখার স্মৃতি। আমি তখন কাজ করতাম দৈনিক প্রথম আলোর বার্তা বিভাগে, হঠাৎ মনে পড়ে গেল ভূমেন্দ্র গুহের বক্তৃতা নিয়ে একটা প্রতিবেদনও লিখেছিলাম, পরদিন প্রথম আলোয় তা ছাপাও হয়েছিল; এবং এটাও মনে পড়ে গেল প্রতিবেদন পড়ে কবি পলাশ দত্ত অনুরোধ করেছিলেন ভূমেন্দ্র গুহর বক্তৃতা নিয়ে ‘কালি ও কলম’ পত্রিকায় একটা লেখা দিতে। কবির অনুরোধে তখন ‘কালি ও কলম’-এ একটা ফিচারধর্মী লেখাও দিয়েছিলাম, যত্নসহ তা ছাপাও হয়েছিল। 

ভূমেন্দ্র গুহর সঙ্গে শেষবার দেখা হয় সেটাও একদশক আগের কথা, ২০১৪ সালের ২২ ডিসেম্বর, কলকাতার রোটারি সদনে মিলনায়তনে। সেদিন যখন তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সেদিনও মনে পড়ছিল জীবনানন্দ দাশকে চিঠি লেখার স্মৃতি। কলকাতায় সেদিন দেখা হয়েছিল অনেক বিখ্যাত কবি-লেখকের সঙ্গেই, কবিতার কাগজ ‘আদম’ আয়োজিত সেই অনুষ্ঠানের মঞ্চ আলোকিত করেছিলেন বিখ্যাত সব লেখক। সেদিন মঞ্চে ডাক পড়েছিল এই অধমেরও। আমি কলকাতার ‘আদম সম্মানা পুরস্কার’ পেয়েছিলাম, সম্পাদক গৌতম মণ্ডলের আমন্ত্রণে পুরস্কার গ্রহণ করতেই কলকাতায় গিয়েছিলাম। সেদিন প্রিয় কবি শঙ্খ ঘোষের হাত থেকে গ্রহণ করেছিলাম কবিতার জন্য পুরস্কার। 

সেদিন মঞ্চে বসে ছিলেন কবি আলোক সরকার, শঙ্খ ঘোষ, ভূমেন্দ্র গুহ, কালীকৃষ্ণ গুহসহ অন্যান্য বিখ্যাত কবি-লেখকগণ। মঞ্চে বসার স্থান হয় আমারও। সেদিন দর্শকসারিতে উপস্থিত ছিলেন কবি মৃদুল দাশগুপ্ত, গৌতম চৌধুরী, রাহুল পুরকায়স্থসহ অনেক কবি-সাহিত্যিকও। 

হঠাৎ লক্ষ করি দর্শকসারিতে আমাদের বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক প্রশান্ত মৃধাও উপস্থিত। অনুষ্ঠান শেষে প্রশান্ত দাদা আর আমি ভূমেন্দ্র গুহর সঙ্গে ছবিও তুলেছিলাম। সেদিন আমি একফাঁকে ভূমেন্দ্র গুহকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘যে মানুষ মারা যান, তাঁর কাছে কি কোনোভাবে চিঠি পৌঁছানো যায়? আপনি কি জীবনানন্দ দাশকে আমার একটি চিঠি পৌঁছে দিতে পারবেন?’ 

ভূমেন্দ্র গুহ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন, তারপর ম্লান হেসেছিলেন। দু:খজনক ব্যাপার, কবি ও চিকিৎসক ভূমেন্দ্র গুহ, আমরা যার মাধ্যমে নতুন করে আবিস্কার করেছি জীবনানন্দ দাশকে, তিনিও অনেক দিন হলো চলে গেছেন না ফেরার দেশে। 

চিঠির প্রসঙ্গে বলতে বলতে কোথায় যে চলে এলাম! স্মৃতি-বিস্মৃতি আসলে এমনই—এলোমেলো, পরম্পরাহীন। কত কথাই না মনে পড়ে; খুব মনে পড়ে আমার মায়ের কথা। শৈশবে মা খুব যত্ন করে আবৃত্তি করে শোনাতেন কুসুমকুমারী দাশের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘আদর্শ ছেলে’। কবিতার প্রথম দুটো পঙ্‌ক্তি ছিল ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ আমরা হয়তো অনেকেই কাজে বড় হতে পারিনি এখনো। কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হয়েছিলেন কুসুমকুমারী দাশের নাড়িছেঁড়া ধন কবি জীবনানন্দ দাশ।

আজ বুধবার (২২ অক্টোবর) বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যুর সত্তর বছর পেরিয়ে গেলেও তিনি যেন এখনও আছেন আমাদের শহরের বাতাসে, নিঃশব্দ দুপুরে, গভীর একাকী রাতে কোনো মানুষের হৃদয়ের ভেতর। তাঁর কবিতা সময়কে ছাড়িয়ে গেছে, তেমনই তাঁর চিঠিগুলোও শেখায় এক অনন্য মানবিক বিনয়। তাঁর চিঠিপত্রে অহংকারের কোনো ছাপ নেই; পরতে পরতে আছে শুধু নির্মল বিনয়, মমতা, আর বেঁচে থাকার করুণ এক আকুতি!

জীবনানন্দ নেই, ভূমেন্দ্র গুহও নেই; তবু তাঁদের অমলিন কাজ আজও আমাদের জীবনের অংশ হয়ে আছে চিন্তায় ও অনুভূতির গভীরে। সময় বদলায়, মানুষ বদলায়, সত্যিকারের সাহিত্য ও শিল্প কখনো পুরোনো হয় না। মহৎ কবি-সাহিত্যিক কিংবা শিল্পীরা চলে যান, কিন্তু তাঁদের সৃষ্ট কর্ম, ভাবনা, এমনকি একটি চিঠিও বেঁচে থাকে মানুষের আত্মায়, সময়ের অন্তহীন ঠিকানায়।

নওশাদ জামিল: কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক


সর্বশেষ সংবাদ