বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষা মুখস্ত শিক্ষা ও গাইড নির্ভরে হতে পারে

অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন
অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন  © সংগৃহীত

বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি বাংলাদেশের কিছু কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। যেমন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রা‌ম বিশ্ববিদ্যালয় ও নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। নতুন পদ্ধতি হলো লিখিত পরীক্ষার সংযোজন। যদিও পদ্ধতি হিসেবে এইটা নতুন না। আওয়ামীলীগ সরকারের আমলেও ৭৩ এর অধ্যাদেশে চালিত পুরোনো ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত অন্যান্য অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লিখিত পরীক্ষা ছিল এবং সেটা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা আছে। এখন লিখিত পরীক্ষা সুবিধা ও অসুবিধাগুলো একটু আলোকপাত করি।

লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে ন্যূনতম অ্যাকাডেমিক মান নিশ্চিত করে সঠিকভাবে প্রণীত একটি লিখিত পরীক্ষা প্রার্থীর বিষয়জ্ঞান, বিশ্লেষণক্ষমতা, ও ধারণাগত স্বচ্ছতা যাচাই করতে পারে। বিশেষ করে যেখানে আবেদনকারীর সংখ্যা অনেক বেশি, সেখানে এটি প্রাথমিক বাছাইয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এটি  পক্ষপাত ও স্বজনপ্রীতি কমাতে সহায়ক অজ্ঞাতনামা মূল্যায়নের মাধ্যমে (যদি তা ঠিকভাবে করা হয়) লিখিত পরীক্ষা নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে পারে, যা অনেক আমাদের দেশে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এর মাধ্যমে সাম্প্রতিক জ্ঞান যাচাই হতে পারে অর্থাৎ প্রার্থী নতুন তথ্য ও প্রবণতা সম্পর্কে কতটা আপডেট তা বোঝা সম্ভব, যা কেবল ডিগ্রি বা গবেষণাপত্র দেখে সবসময় বোঝা যায় না। লিখিত পরীক্ষা সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করে। বিশেষ করে প্রভাষকদের যাদের গবেষণাপত্র বা অভিজ্ঞতা কম, তাদের জন্য ভালো লিখিত পরীক্ষা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সুযোগ তৈরি করতে পারে।

তবে লিখিত পরীক্ষার কিছু সমস্যাও আছে। লিখিত পরীক্ষা শিক্ষাদান ও গবেষণার দক্ষতা যাচাই করে না। একজন ভালো শিক্ষক হতে হলে দরকার শিক্ষাদান, গবেষণা, ও সহযোগিতার (কলাবোরেশনে কাজ) মানসিকতা — যা কেবল লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে মাপা সম্ভব নয়। এটি মুখস্থ শিক্ষা ও ভবিষ্যতে গাইড নির্ভর পরীক্ষায় পরিণত হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষাগুলো এমনভাবে নেওয়া হয় যে তাতে মেমোরাইজেশন বা মুখস্থ বিদ্যার গুরুত্ব বেশি হয়, সমালোচনামূলক বা  ক্রিটিক্যাল চিন্তা নয়। এছাড়া বাংলাদেশের মত দেশের বাস্তবতায় প্রশ্ন ফাঁস, পক্ষপাতদুষ্ট মূল্যায়ন ইত্যাদি মাধ্যমে লিখিত পরীক্ষাও দুর্নীতির শিকার হতে পারে যদি যথাযথ স্বচ্ছতা না থাকে।

শিক্ষক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষা বিশ্বমানের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এটি প্রচলিত নয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ হয়: গবেষণাপত্রের মান, শিক্ষাদানের ডেমো, গবেষণা সেমিনার, রেকমেন্ডেশন লেটার ইত্যাদি সাবজেক্ট বিষয়ে এক্সপার্ট  ইন্টারভিউ প্যানেলের দ্বারা মূল্যায়নের মাধ্যমে। সেখানে লিখিত পরীক্ষা নয়, বরং সামগ্রিক মূল্যায়ন-ই মুখ্য। আমাদের যেইটা দরকার সেটা হলো একটা বিশ্বমানের টেকসই পদ্ধতি। একমাত্র এন্ট্রি লেভেলের প্রভাষক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষা হতে পারে। কিন্তু অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক বা সহকারী অধ্যাপক যাদের পিএইচডি আছে তাদের নিয়োগ পদ্ধতিতে লিখিত  থাকা কাম্য নয়। সবচেয়ে যেইটা জরুরি সেটা হলো লিখিত পরীক্ষা অবশ্যই উপাচার্যের নেতৃত্বে নেওয়া যাবে না। উপাচার্যরা সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হন তাই বাংলাদেশের মত দেশের কথা বিবেচনা করলে দেখা যায় উপাচার্যরা সরকারকেই সার্ভ করেন। যেই বিভাগে অন্তত ১৫ জন অথবা তার বেশি শিক্ষক আছে সেখানে এক তৃতীয়াংশ সিনিয়র মোস্ট শিক্ষক নিয়ে বিভাগের প্রধানের নেতৃত্বে লিখিত পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। এই লিখিত পরীক্ষা কেবল প্রার্থীদের শর্টলিস্ট করার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। এরপর আরেকটা স্তর হতে হবে শিক্ষাদানের ডেমো, গবেষণা সেমিনারের মাধ্যমে। এই স্তরেও অবশ্যই উপাচার্য বোর্ডের সদস্য হিসেবে থাকবেন না। তবে উপাচার্য যদি যেই বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ হয় সেই বিষয়ের হন তাহলে উপাচার্য উপস্থিত থাকতে পারেন। অন্যথায় অবশ্যই নয়। এরপরের স্তরে উপাচার্যের উপস্থিতিতে ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে ফাইনাল নিয়োগের সুপারিশ হতে পারে। 

এছাড়াও আমার কিছু প্রস্তাব আছে: ১। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফল বিবেচনা একদম বাদ দেওয়া। ২। ওয়ার্ল্ড রেঙ্কিং-এ ৫০০ এর মধ্যে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি থাকলে অনার্স ও মাস্টার্স-এ সিজিপিএ শিথিলযোগ্য করা এবং প্রকাশনা ও অন্যান্য যোগ্যতায় যোগ্য বিবেচিত হলে সরাসরি সহকারী অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া। ৩। পোস্টডক্টরাল অভিজ্ঞতাকে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার সমান বিবেচনা করা। একই সাথে পিএইচডি সুপারভাইজার ও বিশ্বমানের কোলাবোরেটর থেকে রেকমেন্ডেশন লেটারকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা। ১০০ বছর আগে আইনস্টাইনের রেকমেন্ডেশন লেটারের কারণে সত্যেন বোসের পিএইচডি না থাকা সত্ত্বেও অধ্যাপক করা হয়েছিল। এখন কেন রেকমেন্ডেশন লেটার বিবেচনা করিনা যেখানে সারা পৃথিবী এইটাকে নিয়োগ প্রক্রিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ কম্পোনেন্ট হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

লেখক: অধ্যাপক, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ