নজরুল: বিদ্রোহে গড়া এক কবির মহাকাব্য

কাজী নজরুল ইসলাম
কাজী নজরুল ইসলাম  © সংগৃহীত

কবি, গল্পকার, নাট্যকার, সঙ্গীতস্রষ্টা, সাংবাদিক এবং সৈনিক কাজী নজরুল ইসলাম প্রমাণ করেছেন কলমও হতে পারে তরবারি। তাঁর প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি সুর যেন স্বাধীনতার, অধিকারবোধের আর আত্মমর্যাদার মশাল। তাঁর জীবনের প্রতিটি বাঁকে যেন জ্বলছে  - বিদ্রোহ, ভালোবাসা, মানবতা ও মুক্তির এক অদম্য দীপ্তি।

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন এক অগ্নিস্নাত পুরুষ, যাঁর কলমে ঝড় উঠে, যাঁর কণ্ঠে বজ্র বাজে।

আমি চির বিদ্রোহী বীর — বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি চির উন্নত শির!” এই পঙ্‌ক্তি শুধু কবিতার লাইন নয়, এটি এক জীবনের ঘোষণা। তিনি কখনো কারো কাছে মাথা নত করেননি, এমনকি প্রবল রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপে পড়েও নিজের বিশ্বাস থেকে একচুলও সরে যাননি। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা থেকে শুরু করে ধনী-দরিদ্রের বিভেদ—সব কিছুর বিরুদ্ধেই তিনি সোচ্চার হয়েছেন।

সাহিত্যে নজরুলের আগমন এক বিপ্লব। বাংলা সাহিত্যে তিনি এনেছেন নতুন ভাষা, ছন্দ ও বিষয়বস্তু। ১৯২২ সালে প্রকাশিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা বাংলা সাহিত্যে যেন এক আগ্নেয়গিরির উদ্‌গিরণ।

অগ্নিবীণা ,সঞ্চিতা, সাম্যবাদী , চক্রবাক, প্রলয় শিখা  এবং যুগবাণী বিদ্রোহী এ কাব্যগ্রন্থ বাংলা সাহিত্যে এনেছে এক নতুন মাত্রা। দুর্দিনের যাত্রী  রাজনৈতিক, সামাজিক সংকটের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদী গদ্য গ্রন্থ । বিষের বাঁশি ,মৃত্যুক্ষুধা,যুগবাণী এবং মহাশ্মশান গল্পগ্রন্থ বিদ্রোহের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সাম্রাজ্যবাদ, শোষণ, বৈষম্য—সবকিছুর বিরুদ্ধে নজরুলের কলম ছিল বিদ্রোহের তলোয়ার। তিনি বলেন,

‘আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না।’

ব্রিটিশ শাসনের দাসত্ব তিনি মেনে নেননি কখনো। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেও মনের গভীরে লালন করতেন উপনিবেশবিরোধী চেতনা। তাঁর কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’-তে তিনি উচ্চারণ করেন: “তোদের কেড়ে লব রাজ-সিংহাসন, ছিন্ন করব তোদের বন্ধন!” এই সাহসী উচ্চারণ তাঁকে কারাগারে পাঠায় ।

রাজনৈতিক দিক থেকেও নজরুল ছিলেন এক অনন্য বিদ্রোহী। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ব্রিটিশ বিরোধী লেখা প্রকাশ করে তিনি কারাবরণ করেন। কারাগারে বসেই রচনা করেন অমর কবিতা ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’, যেখানে তিনি বলেছিলেন—“আমি বন্দী, তবু মুক্ত”। কারারুদ্ধ হয়েও তাঁর আত্মা ছিল স্বাধীন, তাঁর কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত।

নজরুলের কলমে সব মানুষ এক—ধনী-গরিব, হিন্দু-মুসলিম, নারী-পুরুষ। ধর্ম ছিল তাঁর কাছে মানবতার পথ, বিভেদের নয়। তাই তিনি গেয়েছেন:

‘দেয়াল তুলিস না ভাই, হৃদয়ের মাঝে দেয়াল নাই।’

ধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তিনি বলেন: ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, না ঈশ্বর, না আল্লাহ।’

‘মোরা একতারি বাওয়া বাদশারই নাম গাই,
আমরা হাফিজ, রুমি, মওলানা আর শাম গাই।"

তিনি নারীকে কেবল প্রেমিকা বা মা নয়, দেখেছেন যোদ্ধা, নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে। বলেছেন, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’।

নজরুলের জীবনের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দিক হলো তার অসমাপ্ততা—তার জীবনের শেষাংশ ছিল নিঃশব্দ, অথচ তাঁর সৃষ্টি আজও উচ্চারিত হয় মানুষের কণ্ঠে, প্রতিবাদে, প্রার্থনায়। তার কবিতা আর গান বাঙালির হৃদয়ে আগুন জ্বেলে রাখে—একটি ন্যায্য, সম্মানজনক ও মানবিক সমাজ গঠনের জন্য।  নজরুল বেঁচে থাকবেন—প্রতিটি প্রতিবাদে, প্রতিটি স্বপ্নে, প্রতিটি মুক্তির সুরে। কারণ নজরুল, সত্যিই, বাঙালির হৃদয়ের আগুন।আজকের যুগেও যখন সমাজে বিভাজন, বৈষম্য ও নিপীড়নের চিত্র দেখা যায়, তখন নজরুল আমাদের শেখান কীভাবে প্রতিবাদ করতে হয়। “জাগো অজগর, উঠ রে চিতায়!”—এই আহ্বান কেবল অতীত নয়, এটি আমাদের আজকের প্রয়োজন।

লেখক: সংবাদকর্মী ও শিক্ষার্থী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ,রংপুর।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence