বদলে যাচ্ছে ঢাকা, কমবে যানজট
আগামী ডিসেম্বরে ঢাকার গণপরিবহনে যুক্ত হবে মেট্রোরেল। একই সময়ের মধ্যে ঢাকায় বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি চালুর কথা রয়েছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে নগরের পরিবহন ব্যবস্থা একেবারে বদলে যাবে- এমন মত বিশেষজ্ঞ, সরকারি কর্মকর্তাসহ অনেকের।
স্বাধীনতার ৫০ বছরের বিজয় দিবসে মেট্রোরেল চালু হবে উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে চলছে প্রস্তুতি। এরই মধ্যে জাপান থেকে কোচ আসা শুরু হয়েছে। প্রথম দফায় ৬টি কোচ ইতিমধ্যে ঢাকায় পৌঁছে গেছে।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মো. শামসুল হক বলেছেন, ‘‘এটা অবশ্যই অনেক বড় সুখবর। এটা অনেক আগেই হওয়া উচিত।’’
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, ‘‘ঢাকার যানজট এবং পরিবেশে মেট্রোরেলের অসামান্য প্রভাব পড়বে।’’
এমনকি পরিকল্পনা অনুসারে ঢাকায় মেট্রোরেলের সবগুলো রুট বাস্তবায়িত হলে তীব্র যানজটের শহর ঢাকার যানজট কমবে এবং এর ফলে দেশের জিডিপি এক শতাংশ বেড়ে যাবে বলেও মনে করেন তিনি।
ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল
ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের নাম এমআরটি-৬। এটি উত্তরা থেকে শুরু হয়ে মিরপুর, ফার্মগেট, মতিঝিল হয়ে কমলাপুর যাবে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ২৯ কিলোমিটার অংশ চলতি বছরের ডিসেম্বরে এবং আগারগাঁও থেকে কমলাপুর পর্যন্ত প্রায় ১১ কিলোমিটার ২০২৩ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য ছিল। এটি এগিয়ে নিয়ে আসার কাজ চলছে।
বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, ‘‘প্রতিদিন ভোররাতে ফজরের আজানের সময় মেট্রোরেল চালু হবে। চলবে রাত একটা পর্যন্ত। ইজতেমা, ক্রিকেট বা ফুটবল খেলার মতো উপলক্ষ্যে এই শিডিউল মানুষের চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করা হবে।''
তিনি বলেন, ‘‘মেট্রোরেল চালু হলে দুই জায়গায় প্রভাব পড়বে। প্রথমত: সময়। উত্তরা থেকে কমলাপুর যেতে এখন ২-৩ ঘণ্টা সময় লাগে। মেট্রো হলে সময় লাগবে মাত্র ৩৮মিনিট। এই সময়ের মধ্যেই ১৭টি স্টেশনের প্রতিটিতে ৩০-৪৫ সেকেন্ড থামবে। এই বেঁচে যাওয়া সময় অন্য ব্যক্তিগত ও সামাজিক কাজে লাগাতে পারবে মানুষ। দ্বিতীয়ত: তখন শহরে জ্বালানি পোড়ানো অনেক কমে যাবে। এতে ঢাকার পরিবেশের উন্নয়ন হবে।’’
ঢাকার কেবল মেট্রোরেল-৬ প্রতিদিন ৫ লাখ যাত্রী পরিবহন করতে পারবে বলে আশা করছে কর্তৃপক্ষ।
মেট্রোরেলের যত প্রকল্প
ঢাকার মেট্রোরেলের আরো পাঁচটি প্রকল্প রয়েছে। এমআরটি লাইন-১, যার অধীনে আবার দুটো রুট হবে। বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর রুটকে বিমানবন্দর রুট বলা হচ্ছে, আর নতুন বাজার থেকে পূর্বাচলকে পূর্বাচল রুট বলা হচ্ছে। পরিকল্পনা অনুসারে এটা চালু হবে ২০২৬ সালে।
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, ‘‘এই রুটের সব প্রাথমিক সার্ভে, বেসিক ডিজাইন করা শেষ। ডিটেইল ডিজাইনের কাজও শেষ হওয়ার পথে। এখন এটা নির্মাণের জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়ায় আমরা যাচ্ছি।’’
এমআরটি লাইন ৫ (উত্তর) সাভারের হেমায়েতপুর থেকে গাবতলী-মিরপুর-বনানী-গুলশান-২ হয়ে ভাটারা যাবে। এটি চালু হবে ২০২৮ সালে। এটার সার্ভে এবং ডিজাইনের কাজ চলছে।
এমআরটি লাইন-৫ (দক্ষিণ) গাবতলী-কল্যাণপুর-আসাদগেট-পান্থপথ-হাতিরঝিল-আফতাবনগর হয়ে পূর্ব দাশেরকান্দি যাবে। এর বেসিক ডিজাইন করতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়েছে। এমআরটি লাইন-২ গাবতলী-বসিলা-মোহাম্মদপুর-সাতমসজিদ রোড-ঝিগাতলা-সায়েন্সল্যাব-আজিমপুর-পলাশী-শহীদ মিনার-ঢাকা মেডিকেল-পুলিশ হেডকোয়ার্টার-গোলাপ শাহ মাজার-মতিঝিল-আরামবাগ-মুগদা-মান্ডা হয়ে চিটাগাং রোড যাবে। এর প্রাথমিক সমীক্ষা চলছে।
এমআরটি লাইন-৪ ঢাকার কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ যাবে। এটা করা হবে পিপিপি পদ্ধতিতে। পিপিপি পদ্ধতিতে করার প্রক্রিয়া চলছে। এমআরটি লাইন-৫ (দক্ষিণ), এমআরটি লাইন-২, এমআরটি লাইন-৪ চালু হবে ২০৩০ সালে।
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, ‘‘প্রথম মেট্রোরেল করার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন এনেছি। যেসব লাইন শহরের মধ্য দিয়ে যাবে, সেগুলো মাটির নীচ দিয়ে যাবে। যেমন, এমআরটি লাইন-১ এর অধীনে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর রুট মাটির নীচ দিয়ে যাবে। আবার নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল রুট হবে এলিভেটেড।’’
মেট্রোরেলের যে ঘাটতি রয়েই গেছে
অধ্যাপক এম শামসুল হক। তিনি দেশের অন্যতম সফল প্রকল্প হাতিরঝিল পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় পরিবহন বিশেষজ্ঞদের অন্যতম তিনি। ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থার নবসংযোজন মেট্রোরেলের প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি বলেন, ‘‘এই ঘনবসতির শহরে অনেক আগেই এটা হওয়া উচিত ছিল। এতদিন হয়নি, এখন হয়েছে। এটা বিশ্বজুড়ে নগরের সর্বাধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা।’’
মেট্রোরেলকে ঢাকার পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসাবে স্বীকার করলেও তার মতে, এই প্রকল্পের সব সুবিধা নিতে হলে আরো বড় পরিসরে ভাবা দরকার ছিল।
তিনি বলেন, ‘‘মেট্রো কিন্তু কেবল পরিবহন খাতের উন্নয়ন প্রকল্প না, এটা একটা নগর পরিকল্পনার গাইডলাইন।’’
শামসুল হক বলেন, ‘‘মানুষের বসবাসের জায়গা কোনটা হবে, পরিবহন ব্যবস্থা সেটা নির্ধারণে সহযোগিতা করে। যেমন, ঢাকায় সন্তান যেখানে পড়ে, অভিভাবকরা তার আশেপাশেই থাকেন। তার মানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের বাসস্থানকে প্রভাবিত করছে। একইভাবে মেট্রো যেহেতু শহরের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও দ্রুতগামী যোগাযোগ ব্যবস্থা, তাই মানুষ এটা বোঝার পর স্টেশনের আশপাশে গিয়ে থাকার চেষ্টা করবে।’’
‘‘এখন সে থাকতে চাইলেই তো হবে না, সেখানে ব্যবস্থা থাকতে হবে।”
তিনি বলেন, ‘‘এখন ঢাকায় একটা জেনারেল রুল দেয়া আছে যে, আবাসিক এলাকায় ছয়তলার বেশি হতে পারবে না। তাহলে দেখা যাবে, মানুষ থাকতে চাইলেও থাকতে পারবে না। তখন দেখা যাবে, তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের রিটার্ন আসবে না। মেট্রো স্টেশনের পাশে থাকার অর্থ হাঁটার দূরত্বে থাকা।’’
‘‘(বিদেশে)মেট্রো স্টেশনের পাশে কিন্তু শততলা ভবনও অ্যালাও করে। এমনভাবে অ্যালাও করে, একপাশে অফিস-ব্যবসা-বাণিজ্য। শেষের পেরিফেরিতে থাকার জায়গা। এটা হয়ত তিন-চার স্টেশন দূরেও হতে পারে। যেখানে থাকা, সেখানেই চাকরি। এটা একটা দর্শন আছে। সেই দর্শনটা আমাদের এখানে মিসিং।’’
শামসুল হক বলেন, ‘‘হংকং, সিঙ্গাপুর, জাপান দেখিয়েছে যে, যেখানে ১০তলা ভবন হয়েছে, সেখানে কীভাবে বড় ভবন হবে। এটার জন্য কিন্তু কোনো অধিগ্রহণ দরকার নাই। এর জন্য দরকার রিডেভেলপমেন্ট। মালিককে যদি বলি, আপনার এখানে এখন ৬তলা ভবন, এখানে অ্যাম্বুলেন্স ঢোকে না, ফায়ার ব্রিগ্রেড ঢোকে না। আমার সাথে পার্টনারশিপে আসেন, আমি রিডেভেলপমেন্ট করে দেবো।”
তিনি আরো বলেন, ‘‘যারা এটা বাস্তবায়ন করছেন, তারা কেবল মেট্রোরেল প্রকল্পের দিকে তাকিয়ে আছেন। বাইরে কিন্তু এটাকে সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট হিসাবে নেয়। তখন স্টেশনের পাশে লাখ লাখ লোক থাকলেও যানজট হয় না। কারণ, মানুষ ছোট গাড়ি ব্যবহার করবে না। ট্রান্সপোর্ট এবং ল্যান্ড ইউজকে একত্রিত করে পরিকল্পনা করলে সেই শহর হয়ে যায় স্মার্ট। পুরো বিশ্ব শত বছরের অভিজ্ঞতায় ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মাধ্যমে মেট্রোকে যে জায়গায় নিয়ে এসেছে, সেই অংশটুকু কিন্তু আমরা নেই নাই।’’
আরো যত প্রকল্প
ঢাকায় আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হলো বাস রুট রেশনালাইজেশন বা বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি প্রকল্প। যেটা চলতি বছরের এপ্রিল থেকে পাইলট আকারে চালু হওয়ার কথা ছিল। করোনাভাইরাসের কারণে এটা এখন চাপা পড়ে গেছে। পাইলট প্রকল্পে ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত লাইন চালু হওয়ার কথা ছিল।
এই প্রকল্পের আওতায় ঢাকার বাস রুটগুলোকে বিভিন্ন কোম্পানির অধীনে ভাগ করে দেয়া হবে, সব বাসকে এসব কোম্পানির অধীনে চলতে হবে। প্রতিটি কোম্পানির গাড়ির রং হবে আলাদা আলাদা। যাত্রী উঠানো-নামানোর জন্য থাকবে নির্ধারিত স্থান।
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সাড়ে ২০ কিলোমিটার পথে নির্মাণ চলছে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প। এই পথে বাসের জন্য আলাদা লেন থাকবে, যেখানে ঘণ্টায় ২৫ হাজার যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। এই প্রকল্পটি ২০২২ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে এর অগ্রগতি নিয়ে নানা মহলে অসন্তোষ রয়েছে।
ঢাকার চারপাশে বৃত্তাকার রেলপথ, সড়কপথ এবং নৌপথ চালুর নানা উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে একসময় বৃত্তাকার নৌপথ চালুর অংশ হিসাবে ওয়াটার বাস চালুও করা হয়েছিল। পরে ওয়াটার বাসের সংখ্যা বাড়ানো হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই পরিবহনগুলো বন্ধ হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক এম শামসুল হক বলেন, এরকম নানা প্রকল্পে এসব ব্যর্থতার কারণ হচ্ছে, এখানে যে যার যার মতো কাজ করে। কেউ কারো সঙ্গে সমন্বয় করে না। নগরের চারপাশে নদীতো দূরে থাক। বহু শহরের পাশে একটা নদীও নেই। অথচ আমরা আমাদের নদীপথকে কাজে লাগাতে পারছি না।
‘‘বর্ষাকালে ঢাকার চারপাশে নদীতে যাত্রী পরিবহন করতে হলে কিছু ব্রিজ ভাঙতে হবে। তার মানে যারা ব্রিজ বানিয়েছে, তারা নদীপথের কথা চিন্তা করে নাই।”
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের মেট্রোরেল হচ্ছে, কিন্তু এই কাজের সাথে রাজউক নাই।’’
শামসুল হক মনে করেন, ‘‘এমন একটা কর্তৃপক্ষ থাকতে হবে, যে এসবের সঙ্গে নগর পরিকল্পনাকে সনম্বয় করবে। কোনো দেশে নগর সরকার এটা করে। দিল্লিতে একজন মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন। তারা এটা করে। সেই সমন্বয় থাকলে যিনি সদরঘাটে নামবেন, তিনি মতিঝিল পর্যন্তও সহজে পৌঁছতে পারবেন, সেই ব্যবস্থা থাকবে। বাস পেতে তাকে ভিক্টোরিয়া পার্ক পর্যন্ত আসতে হবে না।” [সূত্র: ডয়চে ভেলে বাংলা]