বাংলাদেশে করোনা টেস্টের আগ্রহ কমছে কেন?

  © সংগৃহীত

বাংলাদেশে সম্প্রতি করা এক জরিপ বলছে, কোভিড আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগের বেশি করোনা টেস্ট করাতে অনাগ্রহী। এই জরিপটি পরিচালনা করেছেন ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ ও রিসার্চ সেন্টারের প্রধান অধ্যাপক ডা. রিদওয়ান-উর রহমান।

এতে অংশ নেয়া ১২০২ জন ব্যক্তির মধ্যে ৮৫ শতাংশই চিকিৎসক যারা কোভিড রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তারা জানান, তাদের কাছে আসা রোগীদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগের বেশি করোনা পরীক্ষা করাতে অনাগ্রহ দেখিয়েছে।

এর কারণ হিসেবে উত্তরদাতাদের ৫৩ শতাংশের বেশি বলেছে যে, টেস্ট করানোর সুযোগের অভাব এই অনাগ্রহ তৈরি করেছে। এছাড়া পরীক্ষার ফল দেরী করে আসা ও ভুল রিপোর্ট আসার কারণে পরীক্ষা করার আগ্রহ হারিয়েছে ১৬ শতাংশ রোগী। তৃতীয় বড় কারণ হচ্ছে সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়। এই হারটিও শতকরা ১৬ ভাগ।

তবে এই জরিপটি যেহেতু পরিপূর্ণ পদ্ধতি মেনে করা হয়নি তাই একে অংশগ্রহণকারীদের অনুমান বলে বর্ণনা করেন অধ্যাপক রিদওয়ান। তিনি বলেন, যারা এতে অংশ নিয়েছে তারা চিকিৎসক যারা করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন, তাদের অভিজ্ঞতা, সমাজের একটি প্রতিনিধিত্বশীল অংশের সাথে তাদের যোগাযোগ রয়েছে।

তিনি বলেন, সোশ্যাল স্টিগমাটা অনাগ্রহ, যেটা আন-সেফ টেস্টিং সাইট সেটা অনাগ্রহ, টেস্ট পাওয়া যাচ্ছে না যেটা সেটা অনাগ্রহ, কস্ট যেটা সেটাও অনাগ্রহ, দেরী করে রিপোর্ট এটাও অনাগ্রহ। তাহলে মোটামুটি ৯০ ভাগের বেশি মানুষ অনাগ্রহের কারণে টেস্ট করতে চায় না।

বাংলাদেশে গত কয়েক দিনে টেস্টের সংখ্যা বেশ কমেছে। রবিবার এই সংখ্যা ছিল ১০ হাজারের কিছু বেশি। আর আজ সোমবার এই সংখ্যা কিছুটা বেড়ে ১৩ হাজারের কিছু বেশি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।

অধ্যাপক রিদওয়ান মনে করেন শুধু মানুষের অনাগ্রহের কারণে টেস্টের সংখ্যা কমেনি। বরং এর পেছনে আসলে সরকারের দায় রয়েছে। কারণ সরকার কম পরীক্ষা করাতে চায় যাতে কোভিড শনাক্ত কম হয়।

তিনি বলেন, সরকার প্রথম থেকেই চেয়েছে যে টেস্ট কম হোক, টেস্ট কম হলে রোগী কম হবে, এবং রোগী কম হলে আমরা জিতেছি এটার বিরুদ্ধে, করোনার বিরুদ্ধে।

চট্টগ্রামের আনোয়ারা এলাকার বাসিন্দা পাভেল সিদ্দিকী জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে কোভিডের নানা উপসর্গে ভোগেন। তার সাথে তার পরিবারের কয়েক জন সদস্যও জ্বর, গলা ব্যথা, শরীর ব্যথা, হালকা কাশির মতো উপসর্গে ভোগেন। তবে কোভিডের এসব উপসর্গ থাকলেও কোন ধরণের পরীক্ষা করেননি তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা।

তিনি জানান, পরীক্ষার সুযোগ না থাকায় এবং সামাজিক অবমাননার ভয়ে টেস্ট করাতে যাননি। টেস্ট করাতে হলে আমার বাসা থেকে যেখানে যেতে হবে সেখানে যেতে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। তার মানে যেতে আসতে ছয় ঘণ্টা লাগবে। এই পুরোটা সময়ই সম্পূর্ণ 'এক্সপোজড' অবস্থায় থাকতে হবে যা রিস্কি।

বেসরকারি একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করেন গোলাম কিবরিয়া। বেশ কয়েকদিন ধরে কোভিডে ভুগে এখন সুস্থতার দিকে তিনি।

কিবরিয়া জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কোভিড টেস্টের জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে বেশ ভোগান্তিতে পড়েছিলেন।

বিভিন্ন অ্যাপস ও লিংকের মাধ্যমে টানা ৪৪ ঘণ্টা চেষ্টা করার পর রেজিস্ট্রেশন করতে পেরেছেন তিনি। তবে, আস্থার অভাবে বেসরকারিভাবে টেস্ট করানোর চেষ্টা করেননি কিবরিয়া।

তিনি বলেন, আসলে কারা আমার টেস্টটা প্রোপারলি করে রেজাল্ট দিবে সেটা কোন ধরণের কনফিডেন্স পাওয়ার মতো জায়গা তো নাই বাজারে, বাংলাদেশে। তাই দ্বিধায় ছিলাম যে কোথায় টেস্ট করাবো। পারিবারিকভাবে যোগাযোগ করে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করেছি। জেনেছি যে তাকেও অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়েছে।

কিবরিয়ার এই অভিজ্ঞতার সাথে অনেকটাই মিলে যায় নমুনা সংগ্রহের কাজ করা মাসুদ রানার তথ্য।

রানা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বাড়িতে গিয়ে নমুনা সংগ্রহের কাজ করেন। তিনি জানান, এখন যারা রেজিস্ট্রেশন করে শুধু তাদেরই নমুনা সংগ্রহ করেন তারা। এছাড়া নমুনা সংগ্রহের সংখ্যাও আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে।

তিনি বলেন, আগে যে বাসায় ১০ জনের নমুনা সংগ্রহ করতে হতো এখন সেখানে ২ জনের নমুনা নিতে হয়। তবে বাড়ির সংখ্যা বেড়েছে এখন।

এমন অবস্থার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরাও। এ বিষয়ে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শ কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, নমুনা পরীক্ষা না করে সার্টিফিকেট দেয়া বা ভুয়া সার্টিফিকেট দেয়া, ফি নির্ধারণের মতো পদক্ষেপের জন্য মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে।

যার দায় ভার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার। আর প্রভাব হিসেবে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র সামনে আসবে না বলে মনে করেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।

তিন বলেন, এর দায়ভারটা আসলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার। মানুষকে আমরা তো উদ্বুদ্ধ করতে পারিই নাই, বরং মানুষ হতাশ হয়েছে। আস্থা হারিয়েছে।

তিনি মনে করেন মানুষের মধ্যে এই আস্থাহীনতা কাটাতে হলে পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে ঢেলে সাজাতে হবে।

তিনি বলেন, যারা ভুয়া সার্টিফিকেট দিচ্ছে তাদের সবাইকে ধরতে হবে। ভুয়া সার্টিফিকেট যাতে না দিতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বিভাগ, স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে একসাথে কাজ করতে হবে।

সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছেন বাংলাদেশে বর্তমানে তিন লাখ কিট মজুদ রয়েছে। দেশে করোনা পরীক্ষার কোন সংকট নেই। ভবিষ্যতে করোনা পরীক্ষা বাড়াতে আরো উদ্যোগ নেয়া হবে।

তবে সরকার করোনা পরীক্ষার তুলনায় দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধের অভিযানের দিকে বেশি নজর দিচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আয়েশা আক্তার বলেন, এখনো টেস্টের উপরই বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। যার কারণে ল্যাবের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।

শনাক্ত কম দেখানোর জন্য টেস্ট কম করার যে অভিযোগ সেটিও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক।

তিনি বলেন, এ ধরণের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কম শনাক্ত হওয়ার জন্য কম টেস্ট করাবো এরকম অবশ্যই না। আমরা ল্যাব বেশি বেশি স্থাপন করছি টেস্ট বেশি বেশি করানোর জন্য। আমাদের পর্যাপ্ত কিটও আছে। ফি নির্ধারিত হওয়ার কারণে অপ্রয়োজনীয় অনেক টেস্ট কমেছে। এছাড়া এখন আর দ্বিতীয় বা তৃতীয় বার টেস্ট করানো হচ্ছে না। যার কারণে মনে হতে পারে যে কম টেস্ট করানো হচ্ছে। [সূত্র: বিবিসি বাংলা]


সর্বশেষ সংবাদ