গোলাম আযমের মরদেহে ছুড়ে মারা সেই জুতা নিলামে বিক্রি

‘লাশবাহী গাড়িটা আসার পরপরই আমি স্যান্ডেল খুলে হাতে নেই। জুতা মারব- এই পরিকল্পনা ছিল না। ভেবেছিলাম- জুতা দেখিয়ে ঘৃণা প্রদর্শন করব। কিন্তু যখন লাশবাহী সামনে এলো, তখন নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলাম না। আমার ঘৃণা এবং বাংলাদেশের প্রতি যে ভালবাসার জায়গা থেকে মনে হয়েছে, এখন আমার কিছু একটা করা উচিত। আমি এক দৌঁড়ে স্যান্ডেল মাথার ওপর উঁচু করে ‘জয় বাংলা’ বলে লাশবাহী গাড়ির কাছে চলে যাই এবং ছুঁড়ে মারি।’

২০১৪ সালের ২৫ অক্টোবর বায়তুল মোকাররম মসিজিদের সামনে যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা গোলাম আযমের কফিনে জুতা নিক্ষেপের পর এভাবেই সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন গণজাগরন মঞ্চে নেতা মাহমুদুল হাসান মুন্সী। মুন্সীর সেই ‘এক পাটি জুতা’ রোববার নিলামে বিক্রি হয়েছে। দাম হয়েছে ৫১ হাজার টাকা। ২ মে শুরু হওয়া হওয়া নিলামটি ৩ মে রাত ১১টা পর্যন্ত চলে। এক পাটি জুতাটির নিম্ন বিডমূল্য ধরা হয় ৫০ হাজার টাকা।

বিষয়টি সম্পর্কে মাহমুদুল হাসান মুন্সী জানান, বিডে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্রেতা ৫১ হাজার টাকায় জুতাটি কিনে নিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে উনাকে আমি অনেকদিন ধরে চিনি। সে কারনে ইতিহাসটির হারিয়ে যাওয়া নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। সিকিউরিটির জন্য যারা বিড করেছেন, তাদের কেউই আসলে প্রকাশ্যে কথা বলতে চাননি।
মুন্সী জানান, নিলামে বিজয়ীর সাথে কথা বলে সম্মতিক্রমে পুরো টাকাটি বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনে দান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। মুন্সী জানান, নিলামজয়ী লোকটি স্যান্ডেলটি গ্রহণ করবেন না। এটি তিনি আমার ছেলে নির্বাণকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন; যা নিয়ে আমি নির্বাক।

জুতা নিক্ষেপকারী মাহমুদুল হক মুন্সী এখন নিরাপত্তার স্বার্থে জার্মানিতে অবস্থান করছেন। জুতা নিক্ষেপ ও দেশ ছেড়ে যাওয়ার ব্যপারটি এর আগে তার একটি লেখা গণমাধ্যমে বেশ সাড়া ফেলে। সে সময় তিনি লেখেন, হুমকি ধমকি তীব্র হয় গোলাম আজমের লাশে জুতা মারার পর। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসতে পেরেছিলাম সেদিন আমার সহযোদ্ধাদের ও পুলিশের কারণে।

‘জুতা মারার পর হাঁটতে হাঁটতে ফিরে আসছি যখন পেছন থেকে দৌড়ে এসে জামাত-শিবির লাথি মারে আমাকে, ছিটকে গিয়ে পুলিশে গায়ের ওপর পড়ি। তখন ধরেই নিয়েছি মারা যাচ্ছি আমি। কারণ তখন ওখানে জামাত-শিবিরের কর্মী কয়েক হাজার। মরে যাবার আগে কয়েকটারে নিয়ে মরার ইচ্ছে থাকায় ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম, পেছন থেকে শাওন আপা, রুসমত ভাই ও কানিজ আপা টেনে হিঁচড়ে না নিয়ে আসলে এবছর পঁচিশে অক্টোবর আমার স্মরণে শোকসভা করতে হইতো।’ প্রায় প্রতিদিন ফোনে হুমকি দিতো, ফেসবুকের আদার বক্স ভরে গেছিলো গালি ও খুন করে ফেলার হুমকির স্রোতে। একটা জিডি করেছিলাম তখন স্থানীয় থানায়। সেই জিডির কোন তদন্ত আজ পর্যন্ত হয়নি।

ছোটবেলা থেকেই পারিবারিকভাবে কানাডা চলে যাওয়ার সুযোগ থাকার পরও কেনো তিনি তখন না গিয়ে পরে জার্মানি চলে যেতে বাধ্য হলেন তার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি লিখেছেন: মানুষ নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশ পাড়ি দেয় অনেক কারণে। কেউ পড়াশোনার জন্য, কেউ চাকুরির জন্য, কেউ ব্যবসার জন্য, কেউ অন্য মানুষের প্রতি ভালোবাসায় আর কেউ উন্নত জীবনের লোভে। আমার জন্য উক্ত কোন কারণই কাজ করেনি। আমাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে বেঁচে থাকার জন্য।

আমার শক্তির জায়গাটুকু ছিলো লেখালেখি। আমি লিখে লিখে অনেক কিছু করবার চেষ্টা করেছি, করে ফেলেছিও কিছু কিছু যা কোনদিন ভাবিনি আমার পক্ষে সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লেখালেখির পাশাপাশি তাই জড়িয়ে যাই ব্লগে ‘কুখ্যাত নাস্তিক’ বলে পরিচিত মানুষগুলোর সাথে। ব্লগার দিনমজুরের মুক্তির ডাক দিয়ে আন্দোলন করা, ব্লগ আড্ডার আয়োজন বা চট্টগ্রামে ভূমিধ্বসে মানুষের জন্য সাহায্য তোলা কিংবা ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনের গ্রেফতারের প্রতিবাদে আন্দোলন করা, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল পাকিস্তানে যাবে না এরকম অনেকগুলি ইভেন্ট যার কিছু কিছু মনেও নেই।

‘শত্রু বাড়তে থাকে। মোবাইল নাম্বার ওপেন ছিলো ব্লগে তাই কল করে হুমকি ধমকি দিতো কিছু মানুষ। ব্লগে পোস্ট দেয়া হতো সরকার চেঞ্জ হলে কোন দশজন ব্লগারের লাশ পড়বে। আমার নাম থাকতো সেসব লিস্টে। আমরা পাত্তা দিতাম না। কারণ ব্লগের লেখালেখির কারণে ব্লগার খুন হবে এটা ছিলো এক ধরনের হাস্যকর চিন্তা তখন।’

সেই হাস্যকর চিন্তাটাই কিভাবে সত্যি হয়ে দেখা দিলো তার কথা তিনি লিখেছেন এভাবে: ২০১৩-র ১৪ই ফেব্রুয়ারি। আমার খুব কাছের একজন মানুষ, একজন ব্লগার থাবাবাবা কে হত্যা করা হয় কুপিয়ে তাঁর বাসার সামনে। গণজাগরণ মঞ্চের প্রথম সারির একজন হওয়ার কারণে ফেসবুক, মোবাইলে তখন হুমকি ছিলো নিত্যদিনের উপসঙ্গ। এই হত্যার পর সে হুমকি আরো বেড়ে যায়। কিন্তু গা করতাম না কারণ তখন সরকারের পুলিশি নিরাপত্তা সার্বক্ষণিক ছিলো মঞ্চের সংগঠক হিসেবে।

‘অবস্থা নাজুক হয় হেফাজত ঢাকায় সমাবেশের ঘোষণা দেয়ার পর থেকে। কোন কোন ছাত্রসংগঠনের নেতারা আমাদের মঞ্চে দাঁড়াতে দিতে চাইতেন না ব্লগার বলে। গালাগালি করা হতো। মনে আছে রায়েরবাজার সমাবেশের দিন আমাকে বলা হয় “লাথি মেরে সব ব্লগারদের মঞ্চ থেকে ফেলে দেবো, শালা নাস্তিক!”

আন্দোলনের স্বার্থে শুনেও না শোনার ভান করে সরে গেছি। এর মাঝে আমার পরিচিত ও কাছের চারজন ব্লগারকে গ্রেফতার করে সরকার। এই চারজনের ভেতর একজন আমার ব্যাপারে কিছু নাস্তিকতার প্রমাণাদি হস্তান্তর করে ডিবি পুলিশের কাছে। আমি তাকে দোষ দেই না, সে ভীত হয়ে এই কাজটি করেছিলো।

তারপর শুরু হয় জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অত্যাচার। আমাকে বলে আমাদের হাতে সব আছে, আপনাকেও গ্রেফতার করা হবে। এর মাঝে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে পৌঁছে দেয়া হয় ৮৪ ব্লগারের লিস্ট, যার ভেতর আমার নাম উল্লেখ করা ছিলো। এর মাঝে একবার শাহবাগ থেকে টিএসসির দিকে যাবার পথে ভিড়ের ভেতর গান পাউডার মেরে আমার গায়ের চাদরে আগুন ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করে, সাথে থাকা সহযোদ্ধারা সাথে সাথে সেটা নিভিয়ে ফেলে। কিন্তু ধরতে পারেনি ভিড়ের কারণে অপরাধীকে।’


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence