বঙ্গবন্ধুর ঘটনাবহুল শিক্ষাজীবন এবং তার শিক্ষাগুরুরা
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০১৯, ১১:৩৩ AM
বাংলাদেশের জন্ম থেকে শুরু করে সামনে এগিয়ে চলা, সবকিছুর সঙ্গে যার নাম জড়িয়ে আছে- তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ডাক নাম খোকা। ১৯২০ সালে ১৭ মার্চ বাঙালি জাতির পিতা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা শেখ লুৎফর রহমান, মা সায়েরা খাতুন।
টুঙ্গিপাড়ার পাশের গ্রাম গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি সাত বছর বয়সে। আদালতের সেরেস্তাদারের চাকরির সুবাদে বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমান ১৯৩৪ সালে মাদারীপুর থেকে বদলি হয়ে গোপালগঞ্জে যান। সেখানে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন তিনি। পরে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন।
মাঝে চার বছর অসুস্থ্য থাকার পর আবার পড়াশোনা শুরু করেন। মাধ্যমিকে পড়ার সময় চোখের দুরারোগ্য বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হলে কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর চোখের অপারেশন হয়। ফলে মাঝের কয়েক বছর পড়াশোনা বন্ধ থাকে।
১৯৪২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল থেকে এন্ট্রাস বা এখনকার এসএসসি পাস করেন। একই বছরে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে কলা শাখায় তিনি ভর্তি হন। সেসময় কলকাতার ধর্মতলার বেকার হোস্টেলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বেকার হোস্টেলের যে কক্ষে থাকতেন, সেই কক্ষটি সংরক্ষণ করছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
বাবা প্রতি মাসে যে অর্থ পাঠাতেন, তা দিয়ে নিজের ও তাঁর সহপাঠী শেখ শাহাদাৎ হোসেনের খরচ চলত। এরমাধ্যমে শিক্ষাজীবনেও বঙ্গবন্ধুর দরদী মনোভাব প্রকাশ পায়। ১৯৩৮ সালে ছাত্রজীবনেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সাত দিন জেল খাটেন। ১৯৪০ সালে গোপলগঞ্জ স্কুলে বক্তৃতা দিয়ে দ্বিতীয়বার গ্রেফতার হন।
আরও পড়ুন: ১৫ আগস্ট ঢাবির ৪০তম সমাবর্তনে যোগ দেওয়ার কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর
১৯৪৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতার ফরিদপুর জেলা সমিতির সম্পাদক হন। ১৯৪৬ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ওই কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর বাবার ইচ্ছে পূরণে ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন তিনি। কিছু সময় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকেন। নেতৃত্ব দিতেন ছাত্রলীগের। সেখানে ১৯৪৯ সালের ৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবিদাওয়া আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে পুনরায় পড়াশোনার সুযোগ দিতে রাজি ছিল ‘বন্ড সই’ করার মাধ্যমে। তবে বঙ্গবন্ধু তাতে রাজি হননি। সে অবস্থায় তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৫২ সালের শেষ পর্যন্ত বন্দিজীবন কাটান। তারপরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো আন্দোলনে তিনি সমর্থন দেন।
ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। পাকিস্তান আমলে ঢাকাসহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর যে কলাকানুন ছিল ১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর তা বাতিল করে দেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স-১৯৭৩ অনুমোদন করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার কথ ছিল। কিন্তু ঘাতকের বুলেটের আঘাতে নিহত হওয়ায় বঙ্গবন্ধুর আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হয়নি।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে তাঁর শিক্ষাজীবন ও শিক্ষকদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধুর প্রাথমিক শিক্ষাজীবনে তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা বেগম আদরের পুত্রের জন্য তিনজন শিক্ষক রেখেছিলেন। ধর্ম শিক্ষার জন্য মৌলভি ছাড়াও ছিলেন পণ্ডিত সাখাওয়াত উল্লাহ পাটোয়ারী ও কাজী আবদুল হামিদ।
শিক্ষক সাখাওয়াত উল্লাহ পাটোয়ারী সম্পর্কে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর খেলাধুলা ও পড়ার সাথি শেখ আশরাফুল হক ওরফে আমিন মিয়া। তাঁরা একই সঙ্গে সাখাওয়াত উল্লাহ পাটোয়ারীর কাছে পড়তেন। পাটোয়ারী স্যার অন্যত্র চলে যাওয়ার সময় তাঁর বিছানাপত্রের গাঁটটি পৌঁছে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু।
আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধুর দুর্লভ ভিডিওচিত্র নিয়ে প্রদর্শনী 'সেলুলয়েডে বঙ্গবন্ধু'
ছাত্রজীবনে বঙ্গবন্ধুর ‘আদর্শ’ ছিলেন কাজী আবদুল হামিদ। এই শিক্ষক তাঁকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিলেন তা তিনি অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন।
টুঙ্গিপাড়ার গিমাডাঙ্গায় স্কুলের শিক্ষক বেজেন্দ্রনাথ সূত্রধর। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক বেজেন্দ্রনাথ সূত্রধর ও সহপাঠী সৈয়দ নুরুল হক মানিকের কথা ভোলেননি। তাদেরকে ঢাকা আসার জন্য খবর পাঠান।
তাঁরা দুজন নির্দিষ্ট তারিখে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য গেলে সব নিয়মকানুন উপেক্ষা করে শিক্ষকের কাছে নিজেই ছুটে আসেন এবং পায়ে ধরে সালামের পর বুকে জড়িয়ে ধরেন। বন্ধু মানিককেও জড়িয়ে ধরেন। তিনি শিক্ষককে নিয়ে নিজের চেয়ারে বসিয়ে উপস্থিত মন্ত্রী, এমপিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গর্বভরে বলেন, ‘আমার শিক্ষক।’
বঙ্গবন্ধুর আরেকজন শিক্ষক গিরিশ বাবু। ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ খ্রিষ্টান মিশনারি হাইস্কুলে ভর্তি হন। তখন ওই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন গিরিশ বাবু। গিরিশ বাবু ছাত্র মুজিবকে স্নেহ করতেন সাহসিকতা ও স্পষ্টবাদিতার জন্য।
১৯৪১ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নেন, তখন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন নরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। ওই সময় একজন মুসলমান ছাত্র অন্যায়ভাবে মারপিটের শিকার হলে বঙ্গবন্ধু নরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কাছে মীমাংসা চান। শিক্ষক নরেন্দ্রনাথ বিষয়টি সুষ্ঠুভাবে সমাধান করলে বঙ্গবন্ধু ওই শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে তা মেনে নেন।
ওই স্কুলে বঙ্গবন্ধুর দুজন শিক্ষকের নাম পাওয়া যায়। রসরঞ্জন বাবু ইংরেজির শিক্ষক, তাকে ইংরেজি পড়াতেন। আর মনোরঞ্জন বাবু অঙ্কের শিক্ষক।
১৯৪৩ সালে মন্বন্তরের সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ওই সময় কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষক সাইদুর রহমান, আই এইচ জুবেরী, নারায়ণ বাবুসহ অধ্যাপকদের সহমর্মিতা সম্পর্কে জানা যায় বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে।
ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ড. জুবেরীও বঙ্গবন্ধুকে খুব ভালোবাসতেন। মন্বন্তরের সময় অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে বঙ্গবন্ধু অসুস্থ হলে অধ্যক্ষ মাঝেমধ্যে খবর নিতেন। বিএ পরীক্ষা দেওয়ার সময় অধ্যক্ষ বঙ্গবন্ধুকে সহায়তা করেছিলেন।
তথ্যসূত্র: বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও নিবন্ধ