দিন দিন ছোট হচ্ছে মেসে থাকা শিক্ষার্থীদের খাবার তালিকা

রাজধানী ঢাকার মেসে শিক্ষার্থীরা
রাজধানী ঢাকার মেসে শিক্ষার্থীরা  © টিডিসি ফটো

প্রতিবছর উচ্চ মাধ্যমিক শেষে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে পাড়ি জমায় হাজার হাজার শিক্ষার্থী। উচ্চশিক্ষার আশায় এসব শিক্ষার্থীরা নিজ পরিবার ছেড়ে আসেন। এছাড়া উচ্চ মাধ্যমিকের আগেও অনেকে পরিবার ছেড়ে নতুন গন্তব্যে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করেন। এসব শহরগুলোতে যেসব শিক্ষার্থীদের মাথা গোঁজার ঠাঁই থাাকে না, তারাই হোস্টেল বা মেসে স্থায়ী হন।

হোস্টেল-মেসে থাকা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা যখন নিজ পরিবার ছেড়ে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে পাড়ি জমান তখন সেখানে তাদের অনেকের স্থায়ী হওয়ার কোনো জায়গা থাকে না। ফলে এসব শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে মেস করে থাকে। এর মধ্যে কিছু শিক্ষার্থী পরিবার থেকে টাকা এনে মেস খরচ চালান। তবে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই মেস খরচ চালান টিউশনি অথবা খণ্ডকালীন চাকরির অর্থে।

বর্তমান পরিবেশে নানান  কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মত অবস্থা তৈরি হয়েছে। তবে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য যে পরিমাণ কর্মসংস্থান প্রয়োজন ছিল সেটি এখন নেই। যার ফলে শিক্ষার্থীরা এমন অবস্থার মধ্যে পড়েছে। -সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শিক্ষাবিদ

এদিকে, প্রতিনিয়ত নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়তে থাকায় প্রভাব পড়েছে এসব শিক্ষার্থীদের মেস জীবনেও। ফলে মেস ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, পানি বিল এবং খাবারের খরচে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। এমন অবস্থায় মাস শেষে হিসাব মেলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ‘মেস জীবনে’ টান পড়ায় অনেকের নতুন শহরে টিকে থেকে পড়াশোনা করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপায় না পেয়ে অনেকে খাবারের তালিকা ছোট করতে শুরু করেছেন।

দামের কারণে গরুর পর তালিকা থেকে অনেকটা বাদের পথে মুরগিও। রুই-কাতলা মাছের দামও নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় পাঙাশ, তেলাপিয়া কিংবা ছোট রুই (নলা) মাছের ওপর শেষ ভরসা করতে হচ্ছে এসব শিক্ষার্থীদের। কিন্তু এসব মাছের দামও বাড়তে থাকায় পিস ছোট করে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন রাজধানী ঢাকায় থাকা শিক্ষার্থীরা।

রাজধানীর মেসে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জীবনযাপন

ঢাকায় মেসে থাকা শিক্ষার্থীরা জানান, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ায় বাসার মালিকও ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে বর্তমানে একটি বড় অংকের অর্থ তাদের বাসা ভাড়ায় চলে যাচ্ছে। চাইলেই এই ব্যয় কমানো সম্ভব না। যার প্রভাব পড়েছে দৈনন্দিন খাবার তালিকায়। এ কারণে খাবারের ব্যয় কমিয়েই বাড়তি খরচ সামলানোর চেষ্টা করছেন তারা। খাবারের তালিকা আরও কীভাবে কাটছাঁট করা যায় সেই চেষ্টা করছেন তারা।

বাংলাবাজারে ৯ জন সদস্য মিলে একটি ফ্লাটে মেস করে থাকেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, চাকরি হোক কিংবা লেখাপড়া- যে কোনো প্রয়োজনেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষকে আসতে হয় ঢাকায়। পরিবারের কাছ থেকে দূরে এসে তাদের অধিকাংশেরই অস্থায়ী আবাস হয় রাজধানীর বিভিন্ন মেস। একসঙ্গে অনেকে থাকার ফলে খরচ কিছুটা কম হওয়ায় এসব ব্যাচেলর মেসে থাকেন। সম্প্রতি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মেসে থাকা প্রত্যেকের খাবারের খরচ যেমন বেড়েছে, একইসঙ্গে বেড়েছে সিট ভাড়া (থাকার খরচ)।

আগে আমাদের মেসে আমরা প্রতিবেলায় মাছ অথবা মুরগির তরকারির সাথে ডাল ও শাকসবজিও রাখতাম। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ায় এখন কমে এক পদে নিয়ে আসা হয়েছে। -মেহেদী হাসান লিমন, ঢাকা মেসে থাকা শিক্ষার্থী

তিনি বলেন, আমরা নয় জন একটি ফ্লাটে থাকি। যেখানে আগে আমাদের প্রতি মাসে মিল রেট (প্রতিবেলার খাবারের দাম) ছিল ৩৫ টাকা; সেখানে বিগত মাসে সেটা দাড়িয়েছে ৫৩ টাকায়। আগে একটা ডিম কিনতাম ৮ টাকায়। কিন্তু সেটা এখন ১৩ টাকা, আগে ব্রয়লার মুরগি ১৩০ টাকা দরে কিনলেও এখন কিনতে হচ্ছে ১৯০ টাকা করে। আগে গরুর মাংস ৬০০ টাকা কেজি কিনলেও এখন কিনতে হচ্ছে ৮০০ টাকায়। তাছাড়া, চাউল, গ্যাস, বাসা ভাড়া, তেল সব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে আমরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি।

পুরান ঢাকায় মেসে থাকা শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান লিমন বলেন, আগে আমাদের মেসে আমরা প্রতিবেলায় মাছ অথবা মুরগির তরকারির সাথে ডাল ও শাকসবজিও রাখতাম। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ায় এখন কমে এক পদে নিয়ে আসা হয়েছে। অথচ আগে যেখানে ৩০-৪০ টাকার মধ্যে মিল রেট থাকতো, এখন খাবারের পদ কমিয়েও মিলরেট আসে ৫০ টাকার উপরে। মাঝেমধ্যে একটা ডিম দিয়ে একবেলা পার করে দিতে হচ্ছে। আগে রুই মাছ দিয়ে অনায়াসে মিল চালানো যেত। কিন্তু রুইয়ের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন তেলাপিয়া বা নলা মাছে আস্থা রাখতে হচ্ছে। 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রহমান বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বর্তমানে বাজারের পরিমাণ আগে থেকে কমে গেছে। খাওয়া-দাওয়াও কম খাচ্ছি। খরচের পরিমাণ কমিয়ে আনতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বাজারের সম্ভব হয় না। আগে যেখানে মাসের অধিকাংশ সময়েই প্রোটিন হিসেবে গরুর মাংস বা মুরগি খাওয়া হতো, সেখানে এখন মাছ বা ডিম দিয়ে চলছে। প্রতিবেলায় শাক-সবজিই একমাত্র ভরসা।

আকাশ নামে আরেক শিক্ষার্থী জানান, মাছ হিসেবে আগে রুই মাছ বেশি কেনা হতো। এখন আর সম্ভব হয় না। পাঙাশ ও নলা কিনে মিল চালাতে হয়। রুই মাছ কিনতে গেলে কেজি ৩০০ পার হয়ে যায়, কম দামের মধ্যে এই ২টা মাছই পাই। আমাদের খেয়ে বেঁচে থাকা লাগবে তাই নলা বা পাঙাশ মাছ দিয়ে মিল চালাচ্ছি। কিন্তু এসব মাছের দামও বেড়ে যাওয়ায় পিসের আকার ছোট করে চলতে হচ্ছে।

সাজ্জাদ নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, টিউশনি করে আমাদের চলতে হয়। টিউশনির স্যালারি আগের মতোই আছে, বাড়েনি। কিন্ত খাবারের দামতো আগে থেকে বেড়ে গেছে। ডিম দিয়ে বেশিরভাগ মিল চলে যায়। মাঝেমধ্যে পাঙ্গাশ মাছ কিনি তাও অতিরিক্ত দাম। টিউশনি করে এতো টাকা দামে বাজার করাও কষ্টকর হয়ে যায়।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বড় শহরগুলোতে মেস করে থাকা শিক্ষার্থীদের জীবনও প্রায় একই। ছাত্রদের পাশাপাশি আরও বেশি সমস্যায় ভুগছেন নারী শিক্ষার্থীরা।

নীলফামারীর কলেজপাড়া এলাকার নিরিবিলি ছাত্রীনিবাসের অনুরাধা রায় বলেন, আগে প্রতিদিন মুরগি কিনতাম। এখন আর হয় না। তেল, মশলা কম কিনতে হয়। অল্প তেল, মশলার রান্না খেতে হয়। মুরগিও তো খাওয়া হয় না এখন। এক বেলা ডিম খাচ্ছি ১৫ দিন ধরে৷ আরেক বেলা সবজি দিয়ে খেতে হয়। সকালেতো ডাল-ভর্তা।

মীম ছাত্রীনিবাসের ছাত্রী উম্মে হাবিবা বলেন, মেসে খাওয়া আর না খাওয়া সমান। মিলচার্জ ৪০ টাকা দিয়েও মাংস খেতে পারছি না। সে জায়গায় আগে আমরা গরুর মাংস খেতাম ২৫ টাকা মিল দিয়ে। বাজারের অবস্থা এতটাই খারাপ, আমরা যে খেয়ে ভালো করে পড়াশুনা করবো সে সুযোগও নেই। সরকার ছাত্রাবাসগুলোর দিকে তাকালে হাজার শিক্ষার্থীর আজাহারি শুনতে পারবে। আমাদের জন্য হলেও একটু দাম কমান, আমরা একটু ভালো খেয়ে বাঁচতে চাই।

খেতে না পারা ছাত্র-ছাত্রীদের যেমন সমস্যা, এর থেকে বড় সমস্যা মানসিক ও আর্থিক চিন্তা। এমন অবস্থা থেকে শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যা হতে পারে। -গোলাম রসুল রাখি, চিকিৎসক

পুষ্টিকর খাবারের অভাব কিংবা খাবারের তালিকার কাটছাটে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন হাজারও শিক্ষার্থীরা। নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. গোলাম রসুল রাখি বলেন, খেতে না পারা ছাত্র-ছাত্রীদের যেমন সমস্যা, এর থেকে বড় সমস্যা মানসিক ও আর্থিক চিন্তা। এমন অবস্থা থেকে শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যা হতে পারে। তাদের ঘুম কম হওয়া, হতাশা, হীনমন্যতা, অবস্বাদ, ক্লান্তিভাবসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে। এছাড়াও রক্তশূন্যতাও দেখা দিতে পারে।

তিনি আরও বলেন, এখানে মনিটরিং করে অন্য খাবারের মধ্যে যেমন ডিম, উচ্চ পুষ্টিসমৃদ্ধ সবজি, কলাসহ এ ধরনের খাবার দিয়ে তাদের নিয়মিত পুষ্টিমানটা ঠিক রাখা প্রয়োজন। তবে বর্তমানে প্রোটিনের যে সংকট এটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন চলতে থাকলে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপও বেড়ে যেতে পারে।

শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বর্তমান পরিবেশে নানান কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মত অবস্থা তৈরি হয়েছে। তবে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য যে পরিমাণ কর্মসংস্থান প্রয়োজন ছিল সেটি এখন নেই। যার ফলে শিক্ষার্থীরা এমন অবস্থার মধ্যে পড়েছে। রাষ্ট্রের উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী কাজ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তাছাড়া শিক্ষার সাথে জীবিকার যে সম্পর্ক আমাদের দেশে সেটিও খুব বেশি সুবিধাজনক না। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের এমন অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কর্মমুখী শিক্ষার ক্ষেত্র তৈরি করা বা কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করার বিকল্প নেই।


সর্বশেষ সংবাদ