৩৬ ঘণ্টার বিদ্রোহে রক্তাক্ত প্রান্তরে পরিণত পিলখানা, ৭৪ জনের প্রাণহানী
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:৩৯ AM , আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:৪১ AM
আজ শনিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) পিলখানা ট্র্যাজেডি দিবস। তৎকালীন বিডিআর ও বর্তমান বিজিবি সদর দপ্তর পিলখানায় সংঘটিত হয় এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬শে ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। সেনা কর্মকর্তা ছাড়াও রেহাই পায়নি শিশু ও নারীরাও। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাদের। ১৪ বছর আগে সংঘটিত বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বর্বর ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড এটি। ভয়াবহ সেই ট্রাজেডি আজও কাঁদায়।
এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় (পিলখানা হত্যা মামলা) ১৩৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন এবং ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা। হত্যাকাণ্ডের ১৪ বছর পার হয়ে গেলেও এখনও আসামিদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া কোনো মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। নিম্ন আদালত থেকে হত্যা মামলার রায় উচ্চ আদালত হয়ে এখন আটকে আছে আপিল বিভাগে।
২০১৩ সালে নিম্ন আদালতের রায়ের পর তিন বছর আগে হাইকোর্টেও হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে, কিন্তু আপিল বিভাগে শুনানি শুরু না হওয়ায় চূড়ান্ত নিষ্পত্তির বিষয়টি এখনও অনিশ্চিত। দীর্ঘ বিচার ও রায় শেষে ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি পিলখানা হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে খালাস চেয়ে ২০৩ আসামি আপিল করেন। আর ৮৩ জনের সাজা বৃদ্ধি চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে করা হয় ‘লিভ টু আপিল’।
এ অবস্থায় এখন আপিল শুনানির উদ্যোগ নিলে বিচারের মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হবে। যদিও এরপর রিভিউ আবেদনের সুযোগ থাকবে। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করা ছাড়া আর কোনো সুযোগ থাকবে না।
এ ব্যাপারে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, এ ঘটনায় অনেকের ফাঁসি হয়। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য হাইকোর্টে আসে, সঙ্গে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও আপিল করে। পরে হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে অনেকের সাজা কমেছে, অনেকের বহাল আছে।
তিনি বলেন, হাইকোর্টে রায়ে যাদের সাজা বহাল আছে তাদের মধ্যে ৩৩ জন আপিল বিভাগে আপিল করেছে। এরপর আসামিপক্ষ আপিলের সারসংক্ষেপ জমা না দেওয়ায় শুনানি করা যাচ্ছিলো না। তাদের সারসংক্ষেপ জমা দেওয়ার জন্য আমরা একটি ফাইল করেছি। এবার ৩৩টি ফাইল আসবে। এরপর তাদের যে সময় দেওয়া হবে সেই সময়ের মধ্যে যদি তারা সারসংক্ষেপ জমা না দেয় তাহলে তাদের আপিল ডিসমিস হয়ে যাবে।
যা ঘটেছিল সেদিন
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা ২৭ মিনিটে বিজিবির বার্ষিক দরবার চলাকালে দরবার হলে ঢুকে পড়েন একদল বিদ্রোহী সৈনিক। এদের একজন তৎকালীন মহাপরিচালকের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করেন। এরপরই ঘটে যায় ইতিহাসের সেই নৃশংস ঘটনা। বিদ্রোহী সৈনিকরা সেনা কর্মকর্তাদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তারা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে তাদের পরিবারকে জিম্মি করে ফেলেন। পুরো পিলখানায় এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। চারটি প্রবেশপথ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আশপাশের এলাকায় গুলি ছুড়তে থাকেন তারা।
বিদ্রোহীরা দরবার হল ও এর আশপাশ এলাকায় সেনা কর্মকর্তাদের গুলি করতে থাকেন। তাদের গুলিতে একে একে লুটিয়ে পড়তে থাকেন সেনা কর্মকর্তারা। ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পর এ বিদ্রোহের অবসান হয়। পিলখানা পরিণত হয় এক রক্তাক্ত প্রান্তরে। পরে পিলখানা থেকে আবিষ্কৃত হয় গণকবর। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের মরদেহ। ৩৬ ঘণ্টার এ হত্যাযজ্ঞে ৫৭ সেনা কর্মকর্তা, একজন সৈনিক, দুই সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, ৯ বিজিবি সদস্য ও পাঁচজন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন।
আরও পড়ুন: দেশে প্রতিদিন লোক বাড়ছে, কমছে কৃষি জমি: শিক্ষামন্ত্রী
মামলার রায়
১৫ জনের মৃত্যুর কারণে উচ্চ আদালতে মোট ৮৩৫ আসামীর শুনানি শুরু হয়। ৩৭০ কার্য দিবস শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭শে নভেম্বর রায় ঘোষণা করে হাইকোর্ট। সেখানে মোট ৫৫২ জনকে শাস্তির আওতায় আনা হয়। খালাস দেয়া হয় ২৮৩ জনকে। নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ জন আসামীর মধ্যে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখে হাইকোর্ট। ৮ জনকে মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন প্রদান করা হয় এবং ৫ জন খালাস পান। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম এত বেশি সংখ্যক আসামির সাজা হাইকোর্টে অনুমোদন হয়।
নিম্ন আদালতে ১৬০ জন যাবজ্জীবন প্রাপ্ত আসামীর মধ্যে হাইকোর্ট ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখে এবং ১৪ জনকে খালাস দেয়। তবে নিম্ন আদালতে যাদেরকে খালাস দিয়েছিল, তাদের মধ্যে ৬৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে হাইকোর্ট ৩১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। ৪ জনকে ৭ বছরের কারাদণ্ড এবং ৩৪ জনের খালাস আদেশ বহাল রাখে। সে হিসেবে হাইকোর্টে মোট যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে ১৮৫ জনকে। এছাড়া ২২৮ জনকে ১৩ থেকে ১ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়।
বিজিবি ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানা গেছে, ২০০৯ সালের বর্বরোচিত এই ঘটনার পর দুটো ফৌজদারি মামলা দায়ের হয়। এর মধ্যে বিস্ফোরক মামলাটির শুনানি এখনও নিম্ন আদালতে চলছে। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর নিম্ন আদালত হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। ওই রায়ে ৮৫০ আসামির মধ্যে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া ২৭৮ জনকে খালাস দেন আদালত। রায় ঘোষণার আগেই মারা যান চার আসামি।
পিলখানায় এই বিদ্রোহের ঘটনায় বিডিআরের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে যায়। শুরু হয় বিডিআর পুনর্গঠনের কাজ। বিডিআরের নাম, পোশাক, লোগো ও সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তন করা হয়। জাতীয় সংসদে ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন, ২০১০’ পাস হয়। ওই বছরের ২০ ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ২৩ জানুয়ারি বাহিনীর সদর দপ্তরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ- বিজিবির নতুন পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন এবং মনোগ্রাম উন্মোচন করেন। এর মধ্যদিয়ে শুরু হয় এ বাহিনীর নতুন পথচলা।
এদিকে বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলাটির বিচারকাজ ২০১১ সালে শুরু হলেও এখনও ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে আটকে আছে। পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ২৩ ও ২৪শে মার্চ দিন ধার্য করা হয়েছে। মোট সাক্ষীর সংখ্যা ১৩৪৫ জন জন হলেও এ পর্যন্ত সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে মাত্র ১৮৫ জনের। মামলার মোট আসামির ৮৩৪ জন। এরমধ্যে ২৪ জন মারা গেছেন এবং পলাতক আছেন ২০ জন। দুটি মামলার একই আসামী হওয়ায়, তাদের নিরাপত্তাজনিত কারণে প্রতি মাসে দুই থেকে তিন দিন মামলার কার্যক্রম চালানো হয়।
এভাবে ধীর গতিতে এই মামলার কার্যক্রম চলতে থাকায় চূড়ান্ত নিষ্পত্তি কবে হতে পারে সেটা এখনও অনিশ্চিত।