মিডিয়া সন্ত্রাসবাদী প্রবণতার শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে
- মির্জা নাদিম
- প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৫, ১০:০১ PM , আপডেট: ২৬ আগস্ট ২০২৫, ০৮:০৬ PM
বাংলাদেশের গণমাধ্যম আজ গভীর সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে ন্যূনতম নৈতিকতা, তথ্য যাচাই ও বস্তুনিষ্ঠতার মানদণ্ডকে উপেক্ষা করার প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। অনেক সময় সংবাদ পরিবেশন হয় আংশিক সত্যের ওপর ভিত্তি করে, যার ফলে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। ক্ষুদ্র ঘটনা বা অসম্পূর্ণ তথ্যকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে অযথা বিতর্কের জন্ম দেওয়া আজ প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। ভিউ বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক মুনাফা কিংবা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে কিছু সংবাদমাধ্যম পেশাগত দায়িত্ব বিসর্জন দিচ্ছে; যা গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা ধ্বংস করছে।
২০০৯ সালের পর আওয়ামী লীগের দীর্ঘ একচ্ছত্র শাসনামলে দেশের কিছু প্রভাবশালী মিডিয়া হাউস কার্যত সরকারি প্রচারণার হাতিয়ার হয়ে ওঠে। সমালোচনামূলক সাংবাদিকতা ও সত্য অনুসন্ধানের পরিবর্তে তারা ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রক্ষায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। ফলে সাংবাদিকতা হারিয়েছে স্বাধীনতার চেতনাকে, আর মিডিয়ার নিরপেক্ষতা হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই পক্ষপাতমূলক ভূমিকা অনেক সংবাদমাধ্যমকে জনবিশ্বাস হারাতে বাধ্য করেছে।
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলন এই অবিশ্বাসের চিত্রকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। আন্দোলনের সময় কিছু সংবাদমাধ্যম ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত তথ্য প্রচার করে, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালায়। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয় এবং কয়েকটি ঘটনায় সংবাদকর্মীরা আন্দোলনকারীদের রোষের শিকার হন। সহিংসতা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়, তবে এই প্রতিক্রিয়া ছিল জনগণের দীর্ঘদিনের জমে থাকা অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ। যখন সংবাদমাধ্যম জনমানুষের ভাষ্য প্রতিফলিত না করে ক্ষমতার বয়ানকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তখন সেই ব্যবধান অনিবার্যভাবে সংঘাত ডেকে আনে।
গণমাধ্যম একটি জাতির বিবেক। তাই সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোকে হতে হবে নীতিনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ এবং দায়িত্বশীল। সাংবাদিকতার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত তথ্যের সঠিকতা, প্রাসঙ্গিকতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা; না যে কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা। আজ আমাদের প্রয়োজন সাংবাদিকতার শুদ্ধি-আন্দোলন। বিকৃত তথ্য প্রচার, রাজনৈতিক চাটুকারিতা ও মিডিয়া সন্ত্রাস বন্ধ করতে না পারলে গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হবে এবং স্বাধীন মত প্রকাশের পথ আরও সংকুচিত হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, সংবাদ কেবল তথ্যের আদান-প্রদান নয়, এটি সমাজ গঠনের এক শক্তিশালী হাতিয়ার। ভুল বা বিভ্রান্তিকর সংবাদ শুধু ব্যক্তির ক্ষতি করে না—এটি জাতীয় নিরাপত্তা, সামাজিক স্থিতি এবং জনমতের দিকনির্দেশক শক্তিকেও বিপর্যস্ত করে। একবার বিশ্বাসযোগ্যতা হারালে গণমাধ্যমের পক্ষে সেই আস্থা পুনর্নির্মাণ করা অত্যন্ত কঠিন।
এই সংকট নিরসনে কিছু মৌলিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি; প্রথমত, সংবাদ পরিবেশনের আগে কঠোর তথ্য যাচাই (ফ্যাক্ট-চেকিং) বাধ্যতামূলক করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সংবাদকর্মীদের জন্য নিয়মিত নৈতিকতা ও পেশাগত মানদণ্ড বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক বা কর্পোরেট প্রভাবমুক্ত সম্পাদকীয় স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে। চতুর্থত, অনলাইন সংবাদপোর্টালগুলোকে দায়িত্বজ্ঞানহীন শিরোনাম ও ক্লিকবেইট সংবাদ প্রকাশ থেকে বিরত রাখতে হবে।
এছাড়া, পাঠক, দর্শক ও শ্রোতাদেরও সচেতন হতে হবে। গণমাধ্যমকে দায়বদ্ধ করার অন্যতম শক্তি হলো জনগণ নিজেই। যদি দর্শক বিভ্রান্তিকর সংবাদকে প্রত্যাখ্যান করে, তবে সংবাদমাধ্যম বাধ্য হবে তাদের মানোন্নয়নে মনোযোগী হতে।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম একসময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে লড়াইয়ের অগ্রণী ভূমিকায় ছিল। আজও সেই সম্ভাবনা বিদ্যমান, যদি আমরা নীতিনিষ্ঠ ও সাহসী সাংবাদিকতার পথে ফিরতে পারি। সময় এসেছে রাজনৈতিক আনুগত্য ও ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সত্য, ন্যায় ও জনগণের পক্ষে কথা বলার।
মিডিয়া সন্ত্রাস বন্ধ করা কেবল সাংবাদিকদের দায়িত্ব নয়; এটি রাষ্ট্র, নাগরিক সমাজ ও সচেতন জনগণেরও দায়িত্ব। কেননা, একটি জাতির গণতন্ত্রের মান নির্ধারণ হয় তার সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, সততা ও নৈতিকতার ওপর।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী।