দেশের উচ্চশিক্ষার প্রসার ও অগ্রগতি: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

ফায়াজুন্নেসা চৌধুরী
ফায়াজুন্নেসা চৌধুরী  © টিডিসি সম্পাদিত

উচ্চশিক্ষা একটি জাতির অগ্রগতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গত কয়েক বছরে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। বিশেষ করে গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। তবে, তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে আমরা এখনো কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এজন্য শিক্ষকদের নয়, বরং রাষ্ট্রের দায়িত্বহীন নীতিমালা ও অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ দায়ী।

উচ্চশিক্ষার অগ্রগতির উদাহরণসমূহ

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও উদ্ভাবন
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ডিআইইউ) বেসরকারি পর্যায়ে গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। ২০২৩ সালে, স্কোপাস ইনডেক্সড জার্নালে ডিআইইউ-এর প্রকাশিত ১,১৩৯টি গবেষণাপত্র দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে তাদের শীর্ষস্থানে নিয়ে গেছে।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা উদ্যোগ

গবেষণার ক্ষেত্রে শুধু বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) নয়, বরং অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে প্রতিনিয়ত।

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি):
গবেষণার মানের দিক থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছে। এখানে তিনজন শিক্ষক বিশ্বের সেরা দুই শতাংশ বিজ্ঞান গবেষকের তালিকায় স্থান পেয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি):
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু দেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং গবেষণার ক্ষেত্রেও অগ্রণী। জিনোমিক গবেষণা থেকে শুরু করে পরিবেশ, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক বিজ্ঞান—সব ক্ষেত্রেই ঢাবি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। কোভিড-১৯ মহামারির সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল ভাইরাস সিকোয়েন্সিং এবং ভ্যাকসিন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করেছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি):
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সমুদ্র গবেষণা এবং পরিবেশবিদ্যায় বিশেষায়িত গবেষণার জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে। সমুদ্র সম্পদের টেকসই ব্যবহারের জন্য তাদের গবেষণা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি):
বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কৃষি এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় এই বিশ্ববিদ্যালয় টেকসই কৃষি উন্নয়নের জন্য নতুন প্রযুক্তি এবং ফসলের জাত উদ্ভাবন করছে।

উদাহরণ:

ধান ও গমের উৎপাদন বাড়ানোর নতুন জাত উদ্ভাবন, জৈব কীটনাশক এবং পরিবেশবান্ধব সার তৈরির গবেষণা, টেকসই উন্নয়নের জন্য উচ্চশিক্ষা।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন শুধু অ্যাকাডেমিক শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অর্জনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় জলবায়ু পরিবর্তন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গবেষণায় অগ্রণী। যবিপ্রবি এবং চবি পরিবেশ সংরক্ষণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবহারের জন্য গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই উদ্যোগগুলো দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা এবং গবেষণার মানকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিচ্ছে।

উচ্চশিক্ষার চ্যালেঞ্জ: অগ্রগতির পথে অন্তরায়

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা খাত গত কয়েক বছরে উন্নতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও এখনো বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

অর্থায়নের ঘাটতি
উচ্চশিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দের অভাব এখনো বড় সমস্যা। গবেষণা কার্যক্রম এবং ল্যাব উন্নয়নে পর্যাপ্ত অর্থায়নের অভাবে শিক্ষার্থীরা অনেক সময় প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।

গবেষণার সুযোগ ও শিক্ষকদের সীমাবদ্ধতা
বেশিরভাগ শিক্ষকের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং গবেষণার সুযোগ সীমিত। অনেক শিক্ষক ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাজ করেন, যা যথেষ্ট নয়।

অসম শিক্ষার সুযোগ
শহরের শিক্ষার্থীরা তুলনামূলকভাবে ভালো সুবিধা পেলেও গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা নানা সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হয়। প্রযুক্তি এবং অবকাঠামোর অভাবে তারা পিছিয়ে পড়ে।

রাষ্ট্রের দায়িত্ব: উচ্চশিক্ষায় পরিকল্পনার অভাব

উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে রাষ্ট্রের ভূমিকা অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো সুদূরপ্রসারী এবং স্থিতিশীল নীতিমালার অভাব দেখা যায়।

অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা
তৃতীয় বিশ্বের দেশ হওয়ায় শিক্ষা খাতে সঠিক বিনিয়োগ সম্ভব হচ্ছে না।

প্রযুক্তির অভাব
উন্নত গবেষণা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি এবং ল্যাব সুবিধার অভাব আমাদের গবেষণা কার্যক্রমে সীমাবদ্ধতা তৈরি করছে।

সম্ভাবনা ও পরিকল্পনা: অগ্রগতির সোপান

উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে কিছু সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি।

বাজেট বৃদ্ধি এবং গবেষণার জন্য ফান্ডিং
উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। গবেষণার জন্য আলাদা ফান্ড তৈরি করে শিক্ষকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।

পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে গবেষণা ও উদ্ভাবনের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।

শেষ কথা: আশার আলো

উচ্চশিক্ষার উন্নতি কেবল শিক্ষকদের প্রচেষ্টা বা শিক্ষার্থীদের উদ্যমের উপর নির্ভর করে না; এটি রাষ্ট্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সমাজের একটি সমন্বিত উদ্যোগ। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিনিয়োগ পরিকল্পনা সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারলে অচিরেই বাংলাদেশ বিশ্বের উচ্চশিক্ষা মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করবে।

লেখক: শিক্ষক (কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি 
পিএইচডি রিসার্চ ফেলো
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, বাংলাদেশ।


সর্বশেষ সংবাদ