কোরবানির মূল ভাবগাম্ভীর্য থেকে সরে যাচ্ছে এক শ্রেণির তরুণ প্রজন্ম

শিক্ষার্থী
শিক্ষার্থী  © টিডিসি ফটো

ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। মুসলমানদের দুটি প্রধান ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে একটি হচ্ছে ঈদ উল আজহা। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই মিলে ঈদগাহে নামাজ আদায় শেষে মোলাকাতের মাধ্যমে সব ভেদাভেদ দূর করে এবং কোরবানির মাধ্যমে ধনী এবং সামর্থ্যবান মুসলমানেরা তাদের পশু উৎসর্গ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেন। ঈদ আনন্দ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা তাদের ভাবনা তুলে ধরেছে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস।

বিশ্বের সমস্ত মুসলিমদের জন্য বছরের যে দুটি উৎসব বরাদ্দ তার একটি হচ্ছে ঈদ উল আজহা। প্রিয় পশু কুরবানির মাধ্যমে নিজেদের মধ্যেকার যে পশুত্ব, বর্বরতা, রাগ, বিদ্বেষ সবই আল্লাহর নিকট কুরবানি করি আমরা। এই আনন্দ ভাগাভাগি করে নিই সকলের সাথে। আমাদের মত যারা পড়াশোনার তাগিদে নিজের শহরের বাইরে থাকি তারা এই আনন্দ ভাগাভাগি করার শুরুটা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি হওয়ার সময়ই।

বাস ট্রেনের টিকেট কেনার সময় থেকেই যেন মনের মধ্যে একটা আনন্দের ঢেউ উঠতে থাকে। অনেকটা দিন পর বাবা-মা পরিবারের সাথে দেখা, সাথে স্কুলকলেজের বন্ধুদের সাথে কাটানো সময়ের জন্যে উৎসুক হয়ে থাকা, সবই যেন অন্যরকম এক অনুভূতির সৃষ্টি করে। ঈদ উল আজহার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়টা আমার কাছে মনে হয় হাটে গিয়ে কুরবানির পশু কেনা। প্রতিটা মানুষ নিজেদের হিসাবনিকাশে ব্যস্ত, আলাদা আলাদা মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া, ব্যাপারীদের প্রিয় পশু কিনে নিয়ে আসা অনেকটা তাদের ঘরের সদস্যকে বিদায় দেওয়ার মতোই মনে হয়। কখনো তাদের চোখের পানি দেখলে মনের মধ্যে অবাক, ভালোবাসা, মায়ার এক অপূর্ব মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়। সকলের ঈদ সুন্দর, সুস্থভাবে কাটুক, সকলের কুরবানীকে আল্লাহ তাআলা কবুল করে নিক এই প্রার্থনা করি।

সাদমান সাকিব জোয়ার্দার, শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট  
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

ত্যাগের মাঝেই যে প্রকৃত সুখ নিহিত থাকে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো মুসলিম ধর্মালম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসবের একটি ঈদ-উল-আযহা। এই উৎসবকে ইদুজ্জোহা বা ত্যাগের উৎসবও বলা হয়। কারণ ঈদ-উল-আযহা আসলে মুসলমানরা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী মহান আল্লাহর নামে পশু কুরবানি করে। আর এই পশু কুরবানির মাধ্যমে নিজের ভিতরের অহংকারকে ত্যাগ করে নিজেকে মহান আল্লাহর দরবারে স্থাপন করে। তাছাড়া এই ঈদের কুরবানিকৃত পশুর কিছু অংশ আত্মীয়স্বজন এবং গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দিতে হয় যার ফলে দরিদ্রদের প্রতি ধনীরা দায়িত্ব পালনের একটি সুযোগ পায় এবং একই সঙ্গে আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এভাবেই সকল ভেদাভেদ ভুলে মিলিত হই ঐক্যের বন্ধনে, উপভোগ্য হয়ে ওঠে ঈদ আনন্দ।

মিজানুর রহমান, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

পবিত্র ঈদুল আজহা বড়দের জন্য যতটা ভাব-গাম্ভীর্য আর ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর ঠিক তার থেকে বেশি আনন্দের এবং কষ্টের হয়ে থাকে বাচ্চাদের জন্য। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে হয়ত বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুরা নতুন জামার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলেও ঈদুল আজহায় প্রতিবছর কোরবানির পশু নিয়ে মাতামাতি এবং আবেগে জড়িয়ে যাওয়া বাচ্চাদের জন্য সুখকর হয়ে থাকে। আবার ঈদের দিন কোরবানির সময় বা কোরবানি পরবর্তীতে জড়িয়ে যাওয়া আবেগ শিশুমনে একরাশ দুঃখের সঞ্চার করে। 

এই তো গেল বছর যখন কোরবানির উদ্দেশ্যে গরু ক্রয় করা হয় তখন আমার ছোট্ট বোনের আনন্দ দেখে কে! সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই তার গরুকে একবার হলেও দেখা চাইই চাই, গরুকে খড় বা বিচুলি দেয়া, বিভিন্ন জায়গায় বাচ্চাদের দলের সাথে গিয়ে প্রতিবেশীদের কোরবানির পশু দেখে আসা এবং বড়দের মতো মুখ গম্ভীর করে পশুর ক্রয়মূল্য জেনে নেওয়ার চেষ্টা, আবার এই কাজে সঙ্গ দেয়া বাচ্চা কাচ্চাদের সাথে চিপস বা কোমল পানীয় ভাগাভাগি করে নেওয়া এই চার দেয়ালের বন্দী শহরজীবনে তার মধ্যে অন্যরকম এক আনন্দ সঞ্চার করে। ঈদের দিন যখন কোরবানি সম্পন্ন হয়ে যায় তখন লুকিয়ে লুকিয়ে এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলতে দেখা গিয়েছিল। তার এই সকল কীর্তিকলাপ দেখে নিজের মনে নিজেই বলে উঠি, ‘একদিন আমিও বাচ্চা ছিলাম।’

গোলাম হাফিজ ফাহিম, শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। 

মুসলমানদের দুটি প্রধান ধর্মীয় উৎসবের মাঝে ঈদ উল আজহার গুরুত্ব অন্যতম। ঈদ উল আজহা এর অর্থ হচ্ছে ত্যাগের উৎসব বা কোরবানির ঈদ। ঈদ উল আজহাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত সবাই একত্রিত হয়ে পরিবার ও পরিজনদের সাথে ঈদের আনন্দ উপভোগ করি। ঈদের দিন সকালে আমরা পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন হয়ে মিষ্টি মুখ করে নামাজ করতে যাই। সেখানে নামাজ আদায় শেষে বন্ধু, ভাই, প্রতিবেশীদের সাথে ঈদের মুলাকাত ও শুভেচ্ছা বিনিময় করি। ঈদ উল আজহার অন্যতম মূল লক্ষ্য হলো মানবতার সেবা করা।

যেখানে  আমাদের ধনী, গরীব সবাইকে একসঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে ও সহানুভূতি ও উদারতার গুরুত্ব শেখায়। ঈদ উল আজহার মূল আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কোরবানি করা হয়। কোরবানির মাধ্যমে ধনী এবং সামর্থ্যবান মুসলমানেরা তাদের পশু উৎসর্গ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেন এবং এই কোরবানির পশুর মাংস গরিবদের মাঝে বিতরণ করেন। কোরবানির মাংসের এক তৃতীয়াংশ গরিবদের মাঝে বিতরণ করা হয়, যা তাদের জন্য অনেক বড় এক সহযোগিতা হয়ে থাকে।

এই দিনটি বিশেষ করে গরিবদের জন্যও এক বড় আনন্দের দিন হয়ে থাকে। এই দিনে ধনী এবং গরিবের মধ্যে কোন বিভেদ থাকে না। আমাদের সমাজে অবস্থানরত অনেক উচ্চ বিত্তবান শ্রেণির লোক ঈদের সময়ে তাদের গরীব প্রতিবেশীদের আর্থিকভাবে সহায়তা করে থাকেন, যা তাদের জীবনে এক ধরনের স্বস্তি নিয়ে আসে। সার্বিকভাবে, ঈদ উল আজহা মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি সময় আনন্দ, ত্যাগ, সহানুভূতি এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের প্রতীক। ঈদ বয়ে আনুক ধনী গরীব সকলের মাঝে আনন্দ, সুখ ও সমৃদ্ধি। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা ও ঈদ মোবারক। 

মো. আব্দুল মান্নান, শিক্ষার্থী, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

জিলহজ্জ মাসের দশ তারিখে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের আদেশে নিজের সবচেয়ে ভালোবাসার বস্তুটিকে নিঃস্বার্থে উৎসর্গ করার ঘটনার মধ্যে দিয়েই আবির্ভাব ঘটে কুরবানির ঈদের। আত্মশুদ্ধি বা তাকওয়া অর্জন করাই কুরবানির মূল উদ্দেশ্য হওয়া সত্ত্বেও বর্তমান যুগের কুরবানি অনেকটাই ট্রেন্ড নির্ভর হয়ে গিয়েছে। পশুর জাঁকজমকপূর্ণ নাম, পশু এবং পশুখাদ্যের মাত্রাতিরিক্ত বাজারমূল্য, সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত প্রচারণা এবং শো অফের প্রতিযোগিতার কারণে কুরবানির মূল ভাবগাম্ভীর্যের যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে। মহান প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে পালিত এই বিশেষ ইবাদতটিও এখন অনেকটা প্রদর্শনীর বা ট্রেন্ড ফলো করার অসুস্থ এক প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়ে উঠছে। 

পশু ক্রয়ের থেকে শুরু করে কুরবানি,মাংস বণ্টনের দৃশ্য পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করার মধ্যে দিয়ে চলছে শো অফের প্রতিযোগিতা। তরুণ প্রজন্মের কাছে কুরবানি অনেকটা ইবাদতের চাইতে ট্রেন্ড হয়ে উঠেছে, যা ধর্মীয় এবং সামাজিক আদর্শের সাথে অনেক সময় সাংঘর্ষিক হয়ে উঠতে পারে। ক্রয়কৃত কুরবানির পশুর মূল্য নিয়ে গর্ব অনুভব করা বা লজ্জিত হওয়া, পশুকে নিয়ে বিভিন্ন কন্টেন্ট তৈরি করা।

এছাড়াও শুধুমাত্র প্রদর্শনীর জন্য মাংস বিতরণ করা, অসহায় দুস্থ মানুষকে সুষ্ঠুভাবে মাংস বণ্টন না করা, পশুকে অস্ত্র বা অন্য কিছু দিয়ে ভয় দেখানো এবং তা নিয়ে ভিডিও তৈরি করা, জবেহকৃত পশুর ছবি বা রক্তাক্ত অস্ত্রের ছবি আপলোড করা, কুরবানিকে শুধুমাত্র খাওয়া-দাওয়ার উৎসব মনে করা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের ফলে কুরবানির মূল উদ্দেশ্য এবং ভাবগাম্ভীর্যের থেকে বর্তমান প্রজন্মের তরুণ সমাজ ক্রমশই অনেকটা দূরে সরে আসছে।

ধর্মীয় জ্ঞান, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং নৈতিকতার চর্চা, মিডিয়া লিটারেসি অর্জন এবং প্রয়োগ, কুরবানির মাহাত্ম্য জানা এবং অনুধাবনের মধ্যে দিয়েই এসকল সমস্যার সমাধান করা সহজ হয়ে উঠবে।

মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান লিমন, শিক্ষার্থী,  শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ