কোভিড ঘাটতি পোষানোর বছরে সমালোচনায় শিক্ষাক্রম, একক ভর্তি অন্ধকারেই

বছরজুড়ে বিভিন্ন কারণে আলোচনায় ছিল দেশের শিক্ষাঙ্গন
বছরজুড়ে বিভিন্ন কারণে আলোচনায় ছিল দেশের শিক্ষাঙ্গন  © টিডিসি ফটো

বছরজুড়ে দেশের শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গনের বহু ঘটনার সাক্ষী হয়ে বিদায়ের পথে ২০২৩ সাল। এ বছর নানা কারণে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নতুন কারিকুলাম। বছরজুড়ে এই আলোচনা-সমালোচনা শেষদিকে এসে তা আন্দোলনেও রূপ নেয়। নতুন শিক্ষাক্রমের বিরোধিতা করে গ্রেফতার হয়েছেন বেশ কয়েকজন অভিভাবক-শিক্ষকও।

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে তিন বছর পর প্রথমবারের মতো এবার এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা সব বিষয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির টানাপোড়েনে বিশ্ববিদ্যালয়ে একক ভর্তি পরীক্ষা আলোর মুখ না দেখা, ভুলে ভরা পাঠ্যবই, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে টানা আন্দোলন, বৈষম্য নিরসন ও পদোন্নতির দাবিতে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারদের আন্দোলনসহ শিক্ষাখাতে নানা ঘটনা ঘটেছে বিদায়ী বছরে।

বছরের শুরুতে ভুলে ভরা নতুন পাঠ্যবই দিয়ে শুরু হয় এই বিতর্ক। আর বছর শেষে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে শিক্ষাঙ্গনে। এ কারণে এক মাস আগে নভেম্বরে শেষ হয় চলতি বছরের শিক্ষা কার্যক্রম।

নতুন কারিকুলাম নিয়ে বছরজুড়ে সমালোচনা
গত জানুয়ারি থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম চালু হয়। ২০২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে আরও চার শ্রেণিতে চালু হচ্ছে নতুন এ কারিকুলাম। এতে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচি ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে, যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের আনন্দময় পরিবেশে পড়ানোর পাশাপাশি মুখস্থনির্ভরতার পরিবর্তে দক্ষতা, সৃজনশীলতা, জ্ঞান ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে শেখাতেই নতুন এই শিক্ষাক্রম চালু করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।

আরও পড়ুন: একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখে নতুন শিক্ষাক্রমের বৈশ্বিক গুণ-মান অর্জন

তবে শিক্ষক ও অভিভাবকদের অনেকেই এর সমালোচনা করছেন। নতুন কারিকুলাম বাতিলের দাবিতে রাজধানীতে মানববন্ধনও করেছেন অভিভাবকরা। ফেসবুক গ্রুপ থেকে গড়ে ওঠা ‘সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন’ নামের সংগঠন এখনো সক্রিয়। তবে মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানোর অভিযোগে এনসিটিবি পক্ষ থেকে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা করা হয়। এতে এ পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা বর্তমানে কারাগারে আছেন।

এদিকে গতমাসের শেষের দিকে এসে নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রমের অংশ হিসেবে হিন্দি গানের সাথে স্কুলের পোশাক পরা ছেলেমেয়েদের অশ্লীল নাচ কিংবা ব্যাঙের লাফ অথবা হাঁসের ডাক দিচ্ছে— এমন কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তখন এনসিটিবি জানিয়েছিল, এসব ভিডিও স্বার্থান্বেষী একটি গোষ্ঠী নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন ও ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জনমনে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। 

মন্ত্রণালয়-ইউজিসির টানপোড়েনে আলোর মুখ দেখেনি একক ভর্তি পরীক্ষা
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রমে জটিলতা, দীর্ঘসূত্রতা, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নিরাপত্তাহীনতা, দুর্ভোগ, অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় এবং সময়ক্ষেপণ পরিহারের লক্ষ্যে একক ভর্তি পরীক্ষার উদ্যোগ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। শেষ পর্যন্ত সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একক ভর্তি পরীক্ষা আলোর মুখ না দেখার নেপথ্যে রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির ‘ক্ষমতার দ্বন্দ্ব’।

আরও পড়ুন: একক ভর্তি পরীক্ষা: অধ্যাদেশে সিদ্ধান্ত আসবে দ্বিতীয়বার ভর্তিসহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে

একক ভর্তি পরীক্ষা নিতে ইউজিসি গত ৩১ অক্টোবর ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ, ২০২৩’–এর খসড়া চূড়ান্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠালেও সেটি চূড়ান্ত হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় নানা জটিলতায় সেটি চূড়ান্ত করতে না পারায় এবারও আগের মতো ভর্তি পরীক্ষা হবে বলে জানায় ইউজিসি। ফলে নানা আশা-ভরসা থাকলেও শেষ মূহুর্তে এসে থেমে যায় শিক্ষার্থীদের বহুল কাঙিক্ষত একক ভর্তি।

কর্মবিরতিতে অচল সরকারি কলেজ
পদোন্নতি, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনসহ বিভিন্ন দাবিতে সব সরকারি কলেজে কয়েক দফায় কর্মবিরতি পালন করেছে বিসিএস ক্যাডারের শিক্ষকরা। গত সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি। পরে অক্টোবরে দাবি আদায় না হওয়ার বেশ কয়েক দফায় কর্মবিরতি পালন করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে ১৪ অক্টোবর রাতে শিক্ষামন্ত্রী আন্দোলনরতদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি তাদের সব দাবি পূরণে আশ্বাস দিলে কর্মসূচি থেকে সরে আসে শিক্ষা ক্যাডাররা। 

বছর শেষে রাজনৈতিক উত্তাপের প্রভাব শিক্ষাঙ্গনে
জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির কারণে এক মাস আগেই শেষ হয়েছে চলতি বছরের শিক্ষাকার্যক্রম। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে শেষ হয় শিক্ষার একাডেমিক বছর। কিন্তু এবার এক মাস আগেই অর্থাৎ নভেম্বর মাসেই শেষ হয়েছে শিক্ষাবর্ষ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নভেম্বরের ৩০ তারিখের মধ্যে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল।

আরও পড়ুন: মাদ্রাসার বইয়ে, শিক্ষাক্রমেও পরিবর্তন আসছে

এদিকে অক্টোবরের শেষের দিকে এসে দ্বাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো মুখোমুখি অবস্থান নেয়। এ কারণে অক্টোবর মাস থেকে রাজনীতির মাঠে উত্তাপ ছড়ায়। ফলে বছরের শেষ সময়ে সব শ্রেণিতে বার্ষিক পরীক্ষা, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির অর্ধবার্ষিকী (ষাণ্মাসিক) মূল্যায়ন, এসএসসির প্রস্তুতি, এইচএসসির প্রাক-নির্বাচনীসহ বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষায় ব্যাঘাত ঘটে। এর পাশাপাশি অবরোধসহ নানা রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে অনলাইন শিক্ষাক্রমে ফেরে বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।

এমপিওভুক্তির দাবিতে রাজপথে শিক্ষকরা
এমপিওভুক্তির দাবিতে নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা জুন থেকে আন্দোলন শুরু করেন। রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শিক্ষক সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) সদস্যরা অবস্থান নেন। ১৯ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। সেখানে তিনি বলেন, এ বিষয়ে (জাতীয়করণ) আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ নেই।

তবে জাতীয়করণের যৌক্তিকতা আছে কি না, সেটাসহ শিক্ষা ও শিক্ষকদের সার্বিক মানোন্নয়নের লক্ষ্যে দুটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। শিক্ষামন্ত্রীর এমন আশ্বাসেও অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যান শিক্ষকরা। পরে ২ আগস্ট সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠকের পর আন্দোলনরত শিক্ষকরা কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন।

৩ বছর পর এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষা স্বাভাবিক ধারায়
করোনার পর প্রথমবারের মতো ২০২৩ সালে এসএসসি, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা সব বিষয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে দেখা গেছে, দুটি পরীক্ষায় পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার পর পূর্ণ নম্বর ও পূর্ণ সময়ের প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দেওয়ায় ফল কিছুটা খারাপ হয়েছে। তবে এটি অস্বাভাবিক নয়।

সমালোচনার মুখে  নতুন কারিকুলামে পাঠ্যবই সংশোধন
২০২৩ সালে নতুন কারিকুলামে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে অসংখ্য ভুল ধরা পড়ে। যা গণমাধ্যমে আসার পর টনক নড়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি)। শুরু হয় ভুল চিহ্নিত করার কাজ। প্রায় চার মাস পর এপ্রিলের শেষ এসে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ২২টি বইয়ে ৪২১টি ভুল-ভ্রান্তির সত্যতা পায় এনসিটিবি। ভুলগুলো সংশোধন করে ২৯ এপ্রিল এনসিটিবির ওয়েবসাইটে সংশোধনী দেওয়া হয়।

বিসিএস নন-ক্যাডার প্রার্থীদের আন্দোলন
গত বছরের মার্চের শেষ দিকে ৪০তম বিসিএসের ফল প্রকাশ করে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। ক্যাডার পদের চাকরিপ্রার্থীরা গত বছরের নভেম্বরে যোগ দিলেও নানা জটিলতায় অনেক দিন নন-ক্যাডার পদের ফল আটকে ছিল। এ নিয়ে বছরের মাঝামাঝিতে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন ৪০তম বিসিএসের নন-ক্যাডার প্রত্যাশীরা। পরে সেপ্টেম্বরে ৩ হাজার ৬৫৭ জন প্রার্থীকে নবম থেকে ১২তম গ্রেডের বিভিন্ন পদে সুপারিশ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পরিবর্তন হবে চাকরির প্রশ্ন, পরীক্ষাও: শিক্ষামন্ত্রী

এদিকে বৈষম্যমূলক নন-ক্যাডার বিজ্ঞপ্তি বাতিল করে পদসংখ্যা বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন ৪৩তম বিসিএসের ফলপ্রত্যাশী চাকরিপ্রার্থীরা। চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে সংবাদ সম্মেলনে তারা এ দাবি জানিয়েছেন। এরপর পিএসসি সামনে একাধিকবার কর্মসূচি পালন করেন চাকরিপ্রার্থীরা।

চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে ২৭ হাজার শিক্ষক নিয়োগ
২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। চলতি বছরের ১২ মার্চ প্রাথমিক সুপারিশের ফল প্রকাশ করা হয়। এতে দেশের স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক পদে নিয়োগের জন্য ৩২ হাজারের বেশি প্রার্থীকে নির্বাচন করা হয়।

পরে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ২৮ হাজারের মতো প্রার্থী ভি-রোল ফরম পূরণ করে চূড়ান্ত সুপারিশ পেতে আবেদন করেন। প্রার্থীদের অপেক্ষা শেষ হয় গত ২০ সেপ্টেম্বর। সেদিন রাতে মোট ২৭ হাজার ৭৪ জনকে নিয়োগের চূড়ান্ত সুপারিশ করে এনটিআরসিএ। এসব শিক্ষকরা চাকরিতে যোগ দিলেও এখনো অনেকে এমপিওভুক্ত হতে পারেননি।

প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় ‘ডিভাইস’ ব্যবহার করে জালিয়াতি
গত ৮ ডিসেম্বর তিন বিভাগের ১৮ জেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের প্রথম পর্বের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতে মোট পরীক্ষার্থী ছিলেন ৩ লাখ ৬০ হাজার ৬৯৭ জন। এই পরীক্ষায় দেশের বিভিন্ন জেলায় ১৪০ জনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার, বহুনির্বাচনী প্রশ্নের উত্তরপত্রে জালিয়াতিসহ নানা কারণে পরীক্ষার আগে ও পরীক্ষা চলাকালে তাঁদের আটক করা হয়। এই পরীক্ষায় অনিয়ম-দুর্নীতি ও ডিভাইসের মাধ্যমে জালিয়াতির অভিযোগ তুলে পরীক্ষা বাতিল চেয়ে রিট আবেদন করেছিল ৫৪ প্রার্থী। তবে গত বুধবার (২০ ডিসেম্বর) ফল প্রকাশ করা হয়েছে,  যাতে নয় হাজার ৩৩৭ জন উত্তীর্ণ হয়েছেন। 


সর্বশেষ সংবাদ