মেধাবীদের দেশ ত্যাগের ফলাফল ভয়াবহ হবে: অধ্যাপক আবুল কাসেম

অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক
অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক  © টিডিসি ফটো

বাংলাদেশে চাকরির বাজারে কর্মসংস্থানের স্বল্পতা, গবেষণার উপযুক্ত ক্ষেত্র না থাকা এবং বিভিন্ন চাকরির নিয়োগে অস্বচ্ছতার কারণে ক্যারিয়ারের অনিশ্চয়তায় দিন দিন বিদেশমুখী হচ্ছেন মেধাবী তরুণরা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে দেশের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বর্তমানে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছেন। এদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থীকে পরবর্তীতে দেশে ফিরে আসতে দেখা যায়। শিক্ষার্থীরা মনে করেন, মেধার যথাযথ মূল্যায়ন হয় না দেশে। তাছাড়া, বিদেশের মাটিতে ক্যারিয়ার গঠন তুলনামূলক সহজ। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে অচিরেই দেশ মেধাশূণ্য হয়ে পড়ার পাশাপাশি নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টিকে মেধার পাচার হিসেবে উল্লেখ করে শিক্ষাবিদেরা অচিরেই এ পরিস্থিতি নিরসনে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দেন। 

২০২০ সালের জানুয়ারিতে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম-এর পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সি যুবসমাজের প্রায় ৮২ শতাংশ ভালো ভবিষ্যতের আশায় দেশত্যাগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বিশ্বব্যাংক ২০২১ সালের এক পরিসংখ্যানে বাংলাদেশকে মেধা পাচার প্রবণ শীর্ষ ২০ শতাংশ দেশের একটি হিসেবে চিহ্নিত করে।

আঁচল ফাউন্ডেশন শুক্রবার (৭ জুন) এক প্রতিবেদনে জানায়, বর্তমানে দেশে ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। ২৯.৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্যারিয়ার হিসেবে সরকারি চাকরি করতে চান, ৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ব্যবসা বা উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন এবং মাত্র ৭.১ শতাংশ শিক্ষার্থী বেসরকারি চাকরি করতে চান। এছাড়া বাকি শিক্ষার্থীরা এখনো কোনোরূপ ক্যারিয়ার ভাবনা ঠিক করেনি যা মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ২২ শতাংশ।

ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে মেধা পাচারের সংখ্যা ছিল সাড়ে ৫২ হাজার। ওপেন ডোরস ডেটা-এর সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালে সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার জন্য গিয়েছেন। এ সংখ্যা ১৩ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ২০২২–২৩ শিক্ষাবর্ষেও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৮ শতাংশ বেড়েছে। প্রকৃতপক্ষে বিদেশে পাড়ি জমানোর এই প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলছে।

আরও পড়ুন: কোটা পদ্ধতি কি আগের মত ফিরবে? মানতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা

শিক্ষাবিদেরা মনে করেন, বর্তমানে শিক্ষার্থীদের উন্মুক্ত আড্ডায় আলোচ্য বিষয় হিসেবে বিসিএস পরীক্ষার সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে উচ্চশিক্ষায় বিদেশ যাওয়া। দেশের বাজারে চাকরির স্বল্পতা, মানসম্মত শিক্ষার অভাব, গবেষকদের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়াসহ নানা কারণে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে। কেউ কেউ উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরলেও বেশিরভাগই স্থায়ী হচ্ছেন বিভিন্ন দেশে। 

শিক্ষার্থীদের বিদেশে পাড়ি জমানোর এই প্রবণতা নিয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম ফজলুল হকের সাথে। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, দেশত্যাগের এই প্রবণতা আকস্মিক কোন ঘটনা নয়। তিনি বলেন, আমি মনে করি ১৯৭২ সাল থেকেই এটা শুরু হয়। দীর্ঘ ৫৩ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশ বিভিন্ন ঢেউয়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ক্রমেই মেধাবীদের চলে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এ পর্যন্ত কোন সরকার আন্তরিকতার সাথে এই পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কাজ করেনি। মেধাবীদের দেশত্যাগের ফলাফল খুবই ভয়াবহ হবে। যে কোন দেশের অতীত ইতিহাসে ভুল থাকতে পারে, কিন্তু সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোতে হয়। আমাদেরও তাই করা উচিত।

“তরুণদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার একটি বড় কারণ হলো আমাদের রাজনৈতিক কাঠামো। এখানে অবৈধভাবে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্জনের জন্য অত্যন্ত সুনিপুণ পথ তৈরি করা আছে। রাজনৈতিক লিডার হতে হলে কি কোন শিক্ষা কিংবা চিন্তাশীল হওয়ার প্রয়োজন আছে? কমবেশি সকল রাজনৈতিক দলের অবস্থা একইরকম। ফলে তরুণরা আশাহত হয় এবং আমাদের অভিভাবকগণও তাদের স্বপ্ন দেখাতে ব্যর্থ হয়-অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম ফজলুল হক, শিক্ষাবিদ

শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা আঁচল ফাউন্ডেশন শুক্রবার (৭ জুন) এক প্রতিবেদনে জানায়, বর্তমানে দেশে ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। ২৯.৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্যারিয়ার হিসেবে সরকারি চাকরি করতে চান, ৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ব্যবসা বা উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন এবং মাত্র ৭.১ শতাংশ শিক্ষার্থী বেসরকারি চাকরি করতে চান। এছাড়া বাকি শিক্ষার্থীরা এখনো কোনোরূপ ক্যারিয়ার ভাবনা ঠিক করেনি যা মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ২২ শতাংশ। 

আরও পড়ুন: কোটা পুনর্বহাল রাখার যৌক্তিকতা দেখছি না: অধ্যাপক আবুল কাসেম

এমন পরিস্থিতিতে দেশে মেধাবীদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হচ্ছে না উল্লেখ করে অধ্যাপক আবুল কাসেম বলেন, তরুণদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার একটি বড় কারণ হলো আমাদের রাজনৈতিক কাঠামো। এখানে অবৈধভাবে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্জনের জন্য অত্যন্ত সুনিপুণ পথ তৈরি করা আছে। রাজনৈতিক লিডার হতে হলে কি কোন শিক্ষা কিংবা চিন্তা চেতনার প্রয়োজন আছে? কমবেশি সকল রাজনৈতিক দলের অবস্থা একইরকম। ফলে তরুণরা আশাহত হয় এবং আমাদের অভিভাবকগণও তাদের স্বপ্ন দেখাতে ব্যর্থ হয়। 

এই অধ্যাপক আরও বলেন, একজন শিক্ষার্থী দীর্ঘ শিক্ষা জীবন শেষে দেখা যায় নতুন করে তাকে পুনরায় দুই থেকে তিন বছর প্রস্ততি নিয়ে চাকরির পরীক্ষা দিতে হয়, তারপর চাকরি হতেও পারে আবার নাও হতে পারে এই যে অনিশ্চিত গন্তব্য এটিই তরুণদের সবচেয়ে বেশি আশাহত করেছে। ফলে তারা সহজ কর্মজীবনের খোঁজে বিদেশে পাড়ি জমায়।   এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে কখনোই গড়ে উঠবে না। উন্নত রাষ্ট্রেও দুর্নীতি হয়, কিন্তু সেখানে দুর্নীতিকে এতটা আকর্ষণীয় হিসেবে গ্রহণ করা হয় না। প্রকৃতপক্ষে তারা দুর্নীতিকে পরিহার করার জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু বাংলাদেশে সরাসরি কেউ দুর্নীতিকে সমর্থন না করলেও অনেকের মাঝে আড়ালে আবডালে দুর্নীতিকে আঁকড়ে ধরার প্রবণতা দেখতে পাওয়া যায়। যেটি জাতি হিসেবে আমাদের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। 

“একজন শিক্ষার্থী দীর্ঘ শিক্ষা জীবন শেষে দেখা যায় নতুন করে তাকে পুনরায় দুই থেকে তিন বছর প্রস্ততি নিয়ে চাকরির পরীক্ষা দিতে হয়, তারপর চাকরি হতেও পারে আবার নাও হতে পারে এই যে অনিশ্চিত গন্তব্য এটিই তরুণদের সবচেয়ে বেশি আশাহত করেছে-অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম ফজলুল হক, শিক্ষাবিদ

মেধা পাচার রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে এই অধ্যাপক বলেন, এই প্রবণতা রোধ করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে স্পষ্ট আইন করা এবং এটির প্রচার করা উচিত। বিদেশে যাওয়ার মানসিকতা রোধে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাতে হবে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তরে পরিবর্তন নিয়ে আসা উচিত। শিক্ষানীতি, শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষার লক্ষ এসব নির্ধারণে একেবারে দলান্ধ কিংবা এনজিও করছে এমন ব্যক্তিবর্গের চেয়ে নিরপেক্ষদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। যারা এই দেশকে নিজের দেশ বলে মনে করেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক রয়েছে এমন মানুষদের নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা জরুরি। 


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence