ইসরায়েলি হামলায় গাজার সব বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চিহ্ন, স্কুল-কলেজও ধ্বংসস্তূপ
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৩১ PM

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় সর্বাত্মক তাণ্ডব চালাচ্ছে ইসরায়েল। সর্বশেষ এ বছরের গত ১৮ মার্চ থেকে শুরু হওয়া হামলায় ধ্বংস হয়েছে স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাদের বর্বর হামলায় গাজা উপত্যকায় আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। ইসরায়েলি হামলায় পুরো অঞ্চলের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একের পর এক মাটির সাথে মিশে গেছে। ফিলিস্তিনের সংবাদ সংস্থা ওয়াফা জানিয়েছে, গাজা উপত্যকার ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটিই বিমান হামলা ও বোমাবর্ষণে ধ্বংস বা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, জানুয়ারির শুরুতে গাজার প্রায় ৭৫ শতাংশ শিক্ষা অবকাঠামো ধ্বংসপ্রাপ্ত ছিল।
একসময় গাজা শহরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে ১৭ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতেন, যাদের অধিকাংশই নারী। মেডিসিন, কেমিস্ট্রি, সাহিত্য থেকে বাণিজ্য—বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা চলত। আজ সেখানে শিক্ষার কোনো চিহ্ন নেই। ১৮ মাসের টানা বোমাবর্ষণে পুড়ে যাওয়া অডিটোরিয়ামে আজ গর্ত আর ছিন্নভিন্ন আসন ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। চলতি বছরের মার্চের ১৮ তারিখ যুদ্ধবিরতি ভেঙে ফের হামলা শুরুর পর ওই ক্যাম্পাসই এখন শত শত উদ্বাস্তু পরিবারের অস্থায়ী আশ্রয়স্থল। পাঠাগারের বই জ্বালিয়ে চলছে রান্না, বাগানজুড়ে ধ্বংসাবশেষের মধ্যে ছোটাছুটি করছে শিশুরা। ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের নিচে গড়ে উঠেছে অস্থায়ী বাজার।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, গাজার স্কুলগুলোর অবস্থাও একই। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েল পাল্টা অভিযানে নামে। ৯ অক্টোবর গাজা শহরের রোজারি সিস্টার্স স্কুলের পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান পরীক্ষা হবার কথা ছিল। তবে তার আগেই স্কুল, পাঠাগার, থিয়েটার—সবকিছু মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়।
ওয়াফার তথ্য অনুযায়ী, গাজায় জাতিসংঘের পরিচালিত ২৮৮টি স্কুলসহ মোট ৭৩৭টি স্কুল ছিল। এসবের বড় অংশই আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। ৬২৫ হাজার শিক্ষার্থী এবং ২২ হাজারের বেশি শিক্ষক শিক্ষাজীবন হারিয়েছেন।
শিশুদের জন্য তৈরি নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছিল কিছু স্কুল। কিন্তু ইসরায়েলি হামলায় সেসব স্কুলও রেহাই পায়নি। নভেম্বর ২০২৩-এ জাতিসংঘের পরিচালিত আল ফাখুরা স্কুলে হামলায় অন্তত ১৫ জন, আল-বুরাক স্কুলে অন্তত ২৫ জন এবং ডিসেম্বরে শাদিয়া আবু ঘাজালা স্কুলে আরও অনেকের প্রাণহানি ঘটে।
রাওয়েদা আমীর নামের এক শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরাকে জানায়, গাজায় বসান আলকোলাকের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ছিল আমার স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণের প্রথম ধাপ। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শিক্ষার্থী প্যালেস্টাইন ইউনিভার্সিটিতে ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি প্রোগ্রামে ভর্তির খবর পাই, আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলাম তখন। অথচ আজ সেই বিশ্ববিদ্যালয় শুধুই ধ্বংসস্তূপ—২০২৩ সালের ডিসেম্বরের ইসরায়েলি হামলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে তার শিক্ষার আশ্রয়।
গাজার আল-কুদস ওপেন ইউনিভার্সিটির গাজা শাখাও রক্ষা পায়নি। বোর্ড অব ট্রাস্টিজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, একটানা ৪০ দিনেরও বেশি সময়ের টানা হামলায় তাদের ক্যাম্পাস ধ্বংস করে সেখানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক মহলের কাছে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের আহ্বান জানিয়েছে, যাতে যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ সংগ্রহ করে দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করা যায়। তারা বলেছে, এই আক্রমণ শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মানবিক পরিকাঠামোর বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞের অংশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষের পাশে দাঁড়িয়ে আরেক শিক্ষার্থী বসান বলেন, অক্টোবর ৭-এর আগেও গাজা অনেক প্রাণবন্ত ছিল। আমার বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সমুদ্রের কাছাকাছি, অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশে। তিনি মনে করেন, উচ্চশিক্ষার এই স্বপ্ন যদি আরব আমিরাতের মতো দেশের কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পূরণ করতে হতো, তবে তার পরিবারকে প্রায় ২৫,০০০ ইউরো খরচ করতে হতো—যা তার পক্ষে ছিল অসম্ভব বলে জানান তিনি।
গাজার শিক্ষা ব্যবস্থার ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র আরও ভয়াবহ করে তুলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হত্যাকাণ্ড। ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটরের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ৯৪ জন বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসরকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের পাশাপাশি শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাবিদদের নিশানা করাকে তারা ফিলিস্তিনি সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্য নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পিত প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করেছে।
এ অবস্থায় গাজার শিক্ষার্থীদের সামনে কোনো স্পষ্ট ভবিষ্যৎ নেই। ২০২৩ সালের ৬ নভেম্বরের পর থেকে কোনো শিক্ষার্থী স্কুলে ফিরতে পারেনি। ই-লার্নিং চালু করার চেষ্টা চলছে পশ্চিম তীর থেকে, তবে গাজায় বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন অবস্থায় তা কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব। আশ্রয়হীন শিশু ও তরুণদের মানসিক আঘাত এতটাই গভীর যে, শুধু শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা নয়, তাদের মানসিক পুনর্বাসনও জরুরি হয়ে পড়েছে।
ইসরায়েলি হামলা শুরু হওয়ার পর পশ্চিম তীরেও স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে পাঠদান চালু করেছে। তবে সেখানে অবরোধ, সেনা অভিযান এবং বসতি স্থাপনকারীদের হামলার ঝুঁকির মধ্যেও শিক্ষা ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে।
প্রসঙ্গত, ইসরায়েলি হামলায় গত ১৭ মাসের যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে, আহত ১ লাখ ১৩ হাজারের বেশি। ইসরায়েল এক মাসেরও বেশি সময় ধরে খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধসহ সব ধরনের পণ্য প্রবেশ বন্ধ করে রেখেছে। ফলে মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলোর সামান্য মজুদেও টান পড়েছে। সব মিলিয়ে ইসরায়েলের পরিকল্পিত গণহত্যা ও বর্বরতায় গোটা গাজা যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।