সরানো হচ্ছে রাবির শামসুজ্জোহা স্মৃতিফলক

শামসুজ্জোহা স্মৃতিফলক
শামসুজ্জোহা স্মৃতিফলক  © সংগৃহীত

৬৯’র গণঅভ্যুস্থানে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন উত্তপ্ত হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। আন্দোলনের মুখে কোণঠাসা পাক-হানাদার বাহিনী। ফলে ক্যাম্পাসে হত্যাযজ্ঞের নীলনকশা করলে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ান তৎকালীন প্রক্টর (রিডার) রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহা। কিন্তু ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতির এ মহান ব্যক্তিত্বকে নির্মমভাবে গুলি করার পর বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে পাকহানাদার বাহিনী।

মহান এ অধ্যাপকের স্মৃতি চিরস্মরণীয় করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের দক্ষিণ পাশেই একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়। এখানেই এই বুদ্ধিজীবীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তবে রাজশাহী নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য ফলকটি সরানোর প্রক্রিয়া চলছে।

‘রাজশাহী নগর অবকাঠামো উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় তালাইমারি মোড় থেকে কাটাখালী বাজার পর্যন্ত ছয় লেন সড়ক নির্মাণকাজ চলছে। গত বছর শুরু হওয়া প্রকল্পটি এখন চলমান রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৯৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ দশমিক ১০ কিলোমিটার সড়কের নির্মাণ কাজ চলছে। সম্প্রসারিত এ সড়কের মধ্যে থাকবে দুই মিটারের সড়ক ডিভাইডার। ডিভাইডারের দুই পাশে ১০ দশমিক ৫ মিটারের সড়ক থাকবে। সড়কের উভয়পাশে ৩ মিটার অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচলের লেন ও উভয় পাশের ৩ মিটার ফুটপাত ও ড্রেন থাকবে। সড়কটির সৌন্দর্য বাড়াতে ডিভাইডার ও সড়কের উভয় পাশে গাছ লাগানো হবে।

আরও পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগ ডে বন্ধের নির্দেশ ইউজিসির

সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের অপর পাশেই রাস্তার দক্ষিণ দিকে ড. শামসুজ্জোহার স্মৃতিফলকের অবস্থিত। সেখানে লেখা ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় এই স্থানে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গুলিতে নিহত হন। এসময় তিনি বিক্ষুপ্ত ছাত্রমিছিল নিয়ন্ত্রণে রত ছিলেন। 

এছাড়া স্মৃতিফলকটি লোহার বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা। ভেতরে কিছু টবে ফুলের গাছ থকলেও প্রকল্পের কাজ চলায় সেগুলো এখন নেই। ফলকটি আগাছায় ভরে গেছে এবং এর দক্ষিণ পাশে বিশাল ড্রেন নির্মাণ কাজ শেষে হয়েছে। এমনকি ফটকের আশপাশে বিশাল বালুর স্তুপে ভরা। এদিকে উত্তর দিতে প্রধান ফটকের কাছ পর্যন্ত ড্রেনের কাজ চলছে। 

এবিষয়ে জানতে চাইলে সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক নূর ইসলাম তুষার বলেন, প্রকল্পের আওতায় রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ চলছে। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের দক্ষিণ দিকে শহীদ জ্বোহা স্যারের স্মৃতিফলক পড়ায় সম্প্রসারণ কাজে কিছুটা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। তাই এটা সড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তরের চিঠি পাঠিয়েছি। এখন এবিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। তাদের সাথে নিয়েই এই জায়গাতে রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ করা হবে এবং এ সংক্রান্ত সকল অর্থ সিটি করপোরেশন বহন করবে বলে জানান এ পরিচালক।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সিটি করপোরেশনের রাস্তা সম্প্রসারণের ফলে শহীদ অধ্যাপক শামসুজ্জোহার স্মৃতিফলক সরানোর প্রস্তাবনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল ৩ জুলাই অনুষ্ঠিত এ সংক্রান্ত এক সভায় এবিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে বেশকিছু প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে।

এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের প্রশাসক শাহরিয়ার রহমান বলেন, সিটি করপোরেশন প্রস্তাবনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠিত সাব কমিটিতে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। যদি স্মৃতিফলকটি সরাতে হয়, সেক্ষেত্রে ঐ স্থানের ঠিক দক্ষিণ দিকে বড় আকারে দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিফলক অথবা  শহীদ মিনার নির্মাণ করতে হবে। এছাড়া শহীদ জ্বোহা স্যারের জীবনী ও শাহাদাত সংক্রান্ত ইতিহাস লিখে রাখার ব্যবস্থা থাকতে হবে। স্থানটি যেহেতু স্পর্শকাতর, সেহেতু যথাযথ সম্মান প্রদর্শনকালে যাতে সেখানে সবাই দাঁড়াতে পারে সেই ব্যবস্থা রাখতে হবে। 

এ প্রশাসক বলেন, যেহেতু শহীদ শামসুজ্জোহা দেশের প্রথম শহীদ অধ্যাপক ও স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিকৃতি, সেহেতু তার শাহাদাতের স্থানটি গুরুত্বপূর্ণ। তাই রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ শেষ হলেও স্থানটি যাতে সকলে সহজে প্রত্যক্ষ করতে পারে, সেজন্য সেখানে ছোট করে হলেও ভাস্কর্য অথবা স্মৃতিচিহ্ন নির্মাণ করতে হবে। 

প্রধান ফটক সড়ান হতে পারে কিনা বিষয়ে জানতে চাইলে প্রশাসক জননা, এই বিষয়ে এখনো কোন আলোচনা হয়নি। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা তো হুটহাট চাইলেই রদবদল সম্ভব নয়। তাছাড়া এটা জাতীয় সম্পত্তি। এখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও গণপূর্তমন্ত্রনালয়সহ আরো বেশকিছু মন্ত্রণালয় জড়িত। তাছাড়া রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য যে জায়গা প্রয়োজন, তাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান ফটক, সাবাস বাংলাদেশ মাঠ, উপাচার্য ভবনের পুকুর পাড়ের কিছু অংশ এবং কাজলা গেটও ভাঙতে হবে। সেক্ষেত্রে এটা অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার বলে জানান তিনি।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল ইসলাম বলেন, রাজশাহী নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় রাস্তা সংস্কারের কাজ চলছে। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহার স্মৃতিফলক নিয়ে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনেই রাস্তার দক্ষিণ পাশে এটা অবস্থিত। রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য সিটি করপোরেশন থেকে স্মৃতিফলকটি আর একটু দক্ষিণ দিকে সরানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি এখনো পর্যালোচনার মধ্যে রয়েছে।

উপ-উপাচার্য বলেন, এই স্মৃতিফলক অত্যন্ত স্পর্শকাতর। কেননা এর সঙ্গে ইতিহাস জড়িত রয়েছে। পাক-হানাদারদের সামনে মাথা নতো না করা এক সংগ্রামের স্বাক্ষী এই স্মৃতিফলক। তবে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় রাস্তাঘাট সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। সেক্ষেত্রে ফলকটি যদি সরাতেই হয়, তবে ঐ বরাবর দক্ষিণে একটু সড়িয়ে দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিফলক নির্মাণের পাশাপাশি যেনো সেখানে দাঁড়িয়ে ফুল দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করা যায় এমন বিষয়গুলো চিন্তা করা হচ্ছে। খুব শীগ্রই বিষয়টি নিয়ে সিটি করপোরেশন সাথে আলোচনা করা হবে।

এই প্রকল্পের বাস্তবায়নের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে কিংবা অন্যকোন পরিবর্তন আসতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত স্মৃতিফলক নিয়েই প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। প্রধান ফটক কিংবা অন্যবিষয়ে কোন কথা হয়নি।


সর্বশেষ সংবাদ