ঢাবির হলে ওঠা নিয়ে শঙ্কা নবীনদের, নিরাপত্তার আশ্বাস প্রশাসনের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ছবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার শুরু হয়ে আগামী ১৪ আগস্ট শেষ হবে সকল ইউনিটে ভর্তির এ কার্যক্রম। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের আগামী ১৬ আগস্ট থেকে কিছু অনুষদে শুরু হবে সশরীরে পাঠদান। ফলে এসব কার্যক্রমকে সামনে রেখে অনেক শিক্ষার্থী ইতিমধ্যে হলে ওঠা শুরু করেছেন। অনেকে বাইরে মেস বা হোস্টেলে থাকা শুরু করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে উঠতে আসা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতির উত্তাপ মাঠ, হলের গেস্ট রুম কিংবা গণরুম আতঙ্কে তাদের অনেকে শঙ্কিত। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আসা অভিভাবকরাও এমন পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। বৃহস্পতিবার থেকে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকেই এই গুঞ্জন অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে।

এর মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে উঠতে আসা এসব নবীন শিক্ষার্থীদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা হলে ওঠাতে তৎপরতা দেখা গেছে বিভিন্ন হল শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মাঝে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, সংশ্লিষ্টরা দায়িত্বশীল আচরণ করলে ক্যাম্পাসে বর্তমানে যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রয়েছে সেটি ধরে রাখা সম্ভব হবে। তারা এ বিষয়ে কাজ করছেন।

বর্তমানে ক্যাম্পাস ও হলগুলোতে সুষ্ঠু, স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রয়েছে। যদি সবাই দায়িত্বশীল আচরণ করেন, তাহলে নির্বাচন কেন্দ্রিকও কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হবে না। -উপাচার্য

সরেজমিনে দেখা যায়, নবীন শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গ্রুপের হয়ে হলে ওঠা নিয়ে শঙ্কাবোধ করে নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন। যার উত্তরও আসছে ভিন্ন রকম। কেউ কেউ আর্থিক সচ্ছলতা থাকলে হলে উঠতে নিষেধ করছেন। আবার কেউ নিজের কাছের জুনিয়র তৈরি করতে তার সাথে যোগাযোগ করছেন আন্তরিকতার সাথে। তারা হলে ওঠার বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বর্ণনা দিচ্ছেন জুনিয়রদের।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ছাত্রলীগের একক নিয়ন্ত্রণে থাকায় সংগঠনটির বিভিন্ন প্রোগ্রামে থাকতে হয় হলের শিক্ষার্থীদের। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে শিক্ষার্থীরা লিগ্যাল সিট না পাওয়ায় তাদের ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে হলে উঠতে হয়। যার ফলে তাদেরকে সকল প্রোগ্রামে যতটা সম্ভব উপস্থিত থাকতে হয়। আবার যদি কেউ প্রোগ্রামে অনুপস্থিত বা নিয়মিত ফাঁকি দিয়ে থাকে রাতে তাদের গেস্ট রুমে জিজ্ঞাসাবাদ ও জবাবদিহি করতে হয়।

ঢাবির হল খোলা থাকবে, ক্লাস চলবে অনলাইনে

আরও পড়ুন: ঢাবির সূর্যসেন হলে দুই শিক্ষার্থীকে রাতভর নির্যাতন ছাত্রলীগের

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দ্বিতীয় বর্ষের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, হলে থাকতে গেলে ছাত্রলীগের মোটামুটি সকল প্রোগ্রামে উপস্থিত থাকতে হয়। এখন আগস্ট মাস, প্রতিদিনই কোনো বা কোনো প্রোগ্রামে উপস্থিত থাকতে হয়। আবার সামনে নির্বাচন হওয়ায় সেই প্রোগ্রামের পরিমাণটা আরও বেড়ে যাবে। আবার যদি কেউ প্রোগ্রামে উপস্থিত না হয় তাকে হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকিসহ বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

সরজমিনে দেখা যায়, নবীন শিক্ষার্থীরা যখন ভর্তির টাকা জমা দিতে সোনালী ব্যাংকের সামনে লম্বা লাইন ধরেছেন ঠিক একই সময় হলের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত তারা কে কোন হলে অ্যাটাচমেন্ট পেয়েছে সেই তথ্যের খোঁজে। তারা প্রতিটি শিক্ষার্থীকে ধরে ধরে হল অ্যাটাচমেন্ট জানার পরে বিভিন্ন বিষয় আলোচনা পরে ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে রাখছেন। হলে উঠতে গেলে সেই বড় ভাইকে যেন একবার ফোন দিয়ে হলে উঠেন সেই পরামর্শও দিচ্ছেন কেউ কেউ।

ছাত্রলীগ যতদিন হলগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকবে, ততদিন ক্যাম্পাসও ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। হল-ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে থাকলে অন্যকোনো অপশক্তি কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবে না। -শয়ন, ঢাবি ছাত্রলীগ সভাপতি

এছাড়া ক্যাম্পাসের নবীন শিক্ষার্থীদের হলে ওঠা নিয়ে ছেলেদের প্রায় প্রতিটি হলের সামনেই বিভিন্ন অঞ্চল বা কোরামভিত্তিক ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে। নবীন শিক্ষার্থীদের হলে তুলতে প্রতিটি কোরামের নেতারা দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের উপর চাপ প্রয়োগ করছেন। ফলে তারাও হলের গেটে অবস্থান নিচ্ছেন নবীন শিক্ষার্থীদের নিজেদের কোরামভুক্ত করার কাজে।

এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নবীন শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন পোস্ট করে হলের সার্বিক অবস্থা জানতে চাচ্ছেন। এসব পোস্টে অনেক সিনিয়র শিক্ষার্থীরা হলের ভালো-মন্দ উভয় দিক তুলে ধরছেন। কেউ নবীন শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দিচ্ছেন যেন তারা হলে না উঠেন। আর্থিক সচ্ছলতা থাকলে তারা যেন বাইরে মেস বা আত্মীয়ের বাসায় কিছুদিন থাকেন সেই পরামর্শও দিচ্ছেন।

৫ অক্টোবরই খুলছে ঢাবির হল

আরও পড়ুন: ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ায় আবারও ঢাবি শিক্ষার্থীকে মারধর

আবার কেউ কেউ হল শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা, বিসিএলে সফলতা ও যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যম হিসেবে এটির গুরুত্ব তুলে ধরছেন। এতে দ্বিধায় পড়ছে নবীন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা।

ভর্তি কার্যক্রম চলমান অবস্থায় একাধিক শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সাথে কথা বলে এমন মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। এদের অধিকাংশই সামনের নির্বাচন কেন্দ্রিক অস্থিতিশীল পরিবেশ নিয়ে শঙ্কাবোধ করেছেন। অভিভাবকরাও নিজের সন্তানকে হলে দিতে নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের এক নবীন শিক্ষার্থী বলেন, সামনে নির্বাচন। হলের যেহেতু সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতি করতে বাধ্য; সেহেতু নির্বাচনের সময় পরিস্থিতি কেমন হবে সেটা নিয়ে আমি শঙ্কিত। আমি হলে উঠবো কি-না বুঝতে পারছি না। পারিবারিক অবস্থা ভালো না, বাইরে থাকতে কষ্ট হবে। কিন্তু হলের গেস্টরুম-গণরুমের কথা শুনলেই ভয় লাগে।

নড়াইল থেকে এসেছেন আনিসুজ্জামান (ছদ্মনাম) নামে এক অভিভাবক ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিভিন্ন জনের কাছ থেকে হলে ওঠার ভালো ও মন্দ দিকগুলো শুনেছি। সেখানে এক রুমে অনেক শিক্ষার্থীদের থাকতে হয়, নিয়মিত প্রোগ্রাম করতে বাধ্য করা হয়। তাই আমি আমার ছেলেকে হলে রাখবো না। আপাতত সে তার মামার বাসায় থাকবে। নির্বাচন শেষ হলে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে তাকে হলে তুলে দেবো। 

শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ছাত্রনেতা আসিফ মাহমুদ বলেন, যাদের আর্থিক সচ্ছলতা রয়েছে বা ঢাকায় আত্মীয়-স্বজনের বাসা রয়েছে তাদের হলে না ওঠাই ভালো। কিন্তু একেবারেই অর্থনৈতিক ক্রাইসিস থাকলে তো আর কিছু করার নেই। শিক্ষার্থীদের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। একটা সিট দেওয়ার নাম করে বছরের পর বছর তাদের দিয়ে কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, এর আগে আমরা দেখেছি শান্তি সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন হলের ছাত্রলীগের গ্রুপের স্ক্রিনশট ভাইরাল হয়েছে। যেখানে প্রোগ্রাম না করলে হল থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দেওয়া হয়। আবার সামনে যেহেতু নির্বাচন, স্বাভাবিকভাবেই বুঝা যায় সামনের পরিবেশ আরও খারাপ হবে। ছাত্রলীগের কর্মসূচিও বাড়বে। আমরা চাই না একজন মেধাবী শিক্ষার্থী হলে উঠে এই বাজে অবস্থায় পড়ুক।

সামনে নির্বাচন। হলের যেহেতু সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতি করতে বাধ্য; সেহেতু নির্বাচনের সময় পরিস্থিতি কেমন হবে সেটা নিয়ে আমি শঙ্কিত। আমি হলে উঠবো কি-না বুঝতে পারছি না। -নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নবীন শিক্ষার্থী

ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন বলেন, ছাত্রলীগ যতদিন হলগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকবে, ততদিন ক্যাম্পাসও ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। হল-ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে থাকলে অন্যকোনো অপশক্তি কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবে না। ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে।

শয়ন আরও বলেন, ২০১৪ ও ১৮ সালের নির্বাচনের আগেও আমরা দেখেছি, ক্যাম্পাস ও হল ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়কে কেউ অস্থিতিশীল করতে পারেনি। সুতরাং হলে ওঠার ক্ষেত্রে নবীন শিক্ষার্থীদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। ছাত্রলীগ সবসময়ই শিক্ষার্থীদের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মাকসুদুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভয়ের কোনো কারণ নেই বা অত্যধিক চিন্তারও কোনো কারণ নেই। এখন পর্যন্ত আমরা ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ লক্ষ্য করিনি। সামনেও সেটার সুযোগ নেই। আমরা প্রশাসন সবসময়ই সতর্ক রয়েছি। ক্যাম্পাস ও হলগুলোতে শিক্ষার মান ঠিক রেখে সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখতে প্রশাসন কাজ করছে।

Home :: Dhaka University Halls

আরও পড়ুন: ঢাবির রোকেয়া হলে দুই ছাত্রীকে রাতভর নির্যাতন

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাস্তবতা হলো আমরা অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থীকে হলে সিট দিতে পারছি না। হলের শিক্ষার একটা সুন্দর পরিবেশ দরকার; সেটাও আমরা বিভিন্ন বাস্তবতার জন্য দিতে না পারায় স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি হয়। এমন বাস্তবতা মানিয়ে নিয়েই শিক্ষার্থীদের হলে অবস্থান করতে হয়।

ঢাবি উপাচার্য বলেন, বর্তমানে ক্যাম্পাস ও হলগুলোতে সুষ্ঠু, স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রয়েছে। যদি সবাই দায়িত্বশীল আচরণ করেন, তাহলে নির্বাচন কেন্দ্রিকও  কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল এবং ক্যাম্পাসে শিক্ষার একটা পরিবেশ বজায় থাকবে। আমরা সেটাই আশা করছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও সে ব্যাপারে তৎপর রয়েছে।


সর্বশেষ সংবাদ