জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

‘আজ গেস্ট রুম থেকে ওর লাশ বের হবে’- কর্মীকে মারধরের পর ছাত্রলীগ নেতা

জাবি ও ছাত্রলীগের লোগো এবং মূল অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি হাসান মাহমুদ ফরিদ (বায়ে)
জাবি ও ছাত্রলীগের লোগো এবং মূল অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি হাসান মাহমুদ ফরিদ (বায়ে)  © টিডিসি ফটো

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) শাখা ছাত্রলীগের এক সহ-সভাপতির বিরুদ্ধে সংগঠনটির এক কর্মীকে মেরে কান ফাটিয়ে রক্তাক্ত করার অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মোশাররফ হোসেন আবাসিক হলের অতিথি কক্ষে এই ঘটনার সময় শাখা ছাত্রলীগের আরও সাত নেতা উপস্থিত ছিলেন। এসময় ভুক্তভোগী ছাত্রলীগকর্মী ‘অভিনয়’ করছে বলে চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যেতে কালক্ষেপণের অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। 

গতকাল মঙ্গলবার (২১ মার্চ) রাত সাড়ে আটটার দিকে অতিথি কক্ষে বহিরাগতকে মারধর ও অন্যান্য বিষয়ে হল শাখা ছাত্রলীগের সভা চলাকালীন মারধরের এই ঘটনা ঘটে। আনুমানিক রাত ২টার দিকে ওই সভা শেষ হয়। 

অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা হাসান মাহমুদ ফরিদ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি। তিনি পরিবেশ বিজ্ঞানর বিভাগ ৪৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী। আর ভুক্তভোগী ছাত্রলীগ কর্মী সজীব আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের ৪৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী। 

আরও পড়ুন: বিয়ের দাবিতে ছাত্রলীগ নেতাকে জনসম্মুখে গণধোলাই দিলেন প্রেমিকা

মারধরের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪ ব্যাচের ছাত্র ও  বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগে সহ-সভাপতি আবুল কালাম আজাদ ও শাহ পরান, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, ৪৫ ব্যাচের ছাত্র ও ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান, ছাত্রবৃত্তি বিষয়ক উপ-সম্পাদক আলরাজি সরকার এবং ৪৬ ব্যাচের সাগর সিদ্দিকী।  

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘটনার সময় ওই সিনিয়রের থাপ্পড়ে সজীবের কান ফেটে রক্ত বের হয়। তখন সজীব কেঁদে কেঁদে  বলেন, ‘ভাই আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আর রাজনীতি করবো না। বাসায় চলে যাবো।’  সজীব কান্না করতে শুরু করলে ক্ষিপ্ত হয়ে শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহ আল ফারুক ইমরান বলেন, ‘সে নাটক করতেছে। ওরে তোল। আজকে এই গেস্টরুম থেকে ওর লাশ বের হবে।’

আরও পড়ুন: ইংরেজি-আইন পড়তে ভর্তি পরীক্ষায় পদার্থ-রসায়ন কেনো?

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি দিবেন্দু দিব্যের সাথে দ্বন্দ্বে জড়ান মীর মশাররফ হোসেন হল শাখা ছাত্রলীগের কর্মীরা। পরে দিবেন্দু হলের গেস্টরুমে তুলে এনে মারধর করেন তারা। রাবি ছাত্রলীগের ওই নেতা জাবি ছাত্রলীগের ছাত্রবৃত্তি বিষয়ক উপ-সম্পাদক আলরাজি সরকারের পরিচিত হওয়ায় এ নিয়ে হল ছাত্রলীগের সিনিয়রদের মিটিং হয়। মীমাংসা শেষে দিব্য ক্ষমা চেয়ে চলে যাওয়ার সময় হলের জুনিয়র কর্মীরা আবারও তাকে মারধর করে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাত সাড়ে ৮টায় গেস্টরুম শুরু হয়। গেস্টরুম শুরু হওয়ার পর সজীবকে মারধর করা হয়।

ভুক্তভোগী সজীব আহমেদ বলেন, “ঝামেলাটা শুরু হয়েছিল বহিরাগত একজনের সাথে। সে ছাত্রলীগের বড় ভাইদের গেস্ট ছিল। এই ঝামেলার কারণে আমাদের গেস্টরুমে ডেকে অমানবিকভাবে নির্যাতন করা হয়। নায়িম (রসায়ন বিভাগ, ব্যাচ- ৪৮), সিয়াম (প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ব্যাচ- ৪৮) ও আমার কানে ইচ্ছেমত মারার চেষ্টা করা হয়। আমি কানে হাত দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করলে হাত সরিয়ে মারধর করেছে ইতিহাস বিভাগের ফরিদ ভাই (ব্যাচ- ৪৪)। আমি অসুস্থ হয়ে শুয়ে পড়ি, কিন্তু তারা আমাকে বসতেও দেয় নাই। ডাক্তারের কাছে যেতে চাইলে যেতে দেয় নাই। আমি ‘নাটক করছি’ বলে আমাকে লাথি দেওয়ার চেষ্টা করে মোস্তাফিজুর রহমান ভাই (আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ব্যাচ- ৪৬)।”

আরও পড়ুন: অপকর্মের সাথে জড়িতদের ছাত্রলীগের নেতা বানানো যাবে না: কাদের

সজীব আরও বলেন, ‘আমাকে জাবি মেডিকেলে নেওয়ার পর ডাক্তাররা এনাম মেডিকেলে সুপারিশ করলে ঘটনা জানাজানি হওয়ার ভয়ে হলের বড়ভাইরা আমাকে যেতে দেননি। পরে বন্ধুরা জোর করে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা করে জানান, আমার কানের পর্দা অনেকটা ফেটে গেছে । একমাস পরে জানা যাবে সেটি পুরোপুরি সারিয়ে উঠবে কি না।’ 

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছেন কিনা জানতে চাইলে ভুক্তোভোগী সজীব বলেন, ‘তারা ৪৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী। তাদের কারও ছাত্রত্ব নেই। কার কাছে অভিযোগ দেব?’ এদিকে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য জুনিয়রদের হুমকি ও আহত সজীবের চিকিৎসায় বাঁধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে হলের অন্য ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে।

আরও পড়ুন: গণমুখী আমলাতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতেই বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করেছিলেন: সাদ্দাম

অভিযোগের বিষয়ে অভিযুক্ত হাসান মাহমুদ ফরিদ বলেন, ‘আমাদের নিয়মিত গেস্টরুম চলছিল এমন সময় সজীবের কান দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করে । তখন আমাদের ভাইয়েরা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।’ 

অভিযুক্ত আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘রোজার আগে কর্মীদের দিক নির্দেশনা দিতে গেস্টরুম ডাকি। এছাড়াও গেস্টরুমে কর্মীদের সমসাময়িক কিছু মারধরের ঘটনা বিষয়ে জানতে আমরা তাদের নিয়ে বসি।’ 

অভিযুক্ত ইমরান বলেন, ‘রোজা এবং ইফতার নিয়ে আমাদের গেস্টরুম চলছিল এসময় সবার সামনে সে শারীরিক দূর্বলতাজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ে। কোন মারধরের ঘটনা ঘটেনি।’ 

আরও পড়ুন: চাঁদ দেখা যায়নি আজ, শুক্রবার থেকে রোজা শুরু

এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আখতারুজ্জামান সোহেল বলেন, আমি ঘটনাটি শুনেছি। রমজান মাসের আগে সাংগঠনিক দিক নির্দেশনা দেওয়ার জন্য সবাইকে নিয়ে বসতে বলা হয়েছিল। শুনেছি ছেলেটির কানে আগে থেকেই সমস্যা ছিল। আর গেস্ট রুমে একসাথে এক দেড়শো জন বসার ফলে একটু ভিড় হয়। তখন হঠাৎ  ওর কান থেকে রক্ত বেরোতে শুরু করে। পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে তদন্ত সাপেক্ষে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হলে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে মীর মোশাররফ হোসেন হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ওবায়দুর রহমান বলেন, ‘ঘটনাটি জেনেছি। ভুক্তভোগীকে লিখিত অভিযোগ দিতে বলেছি। হলের অন্যান্য শিক্ষকদের নিয়ে বসে প্রকৃত ঘটনা জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 


সর্বশেষ সংবাদ