আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা: বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নিবেন কী করে?
- রাগিব হাসান
- প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৩:১০ PM , আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২২, ০৬:৩৬ PM
আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক। হাজার হাজার। এর মাঝে হার্ভার্ড, প্রিন্সটনের মতো বনেদি বিশ্ববিদ্যালয় যেমন আছে, তেমনি আছে অখ্যাত নাম না জানা নাম সর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয়। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নেয়াটার পিছনে সময় দিতে হবে।
কোথায় একেবারেই যাবেন না?
শুরুতেই বলি কী ধরণের বিশ্ববিদ্যালয় একেবারেই বাদ দিবেন। প্রচুর বিশ্ববিদ্যালয় আছে যারা আসলে ডিগ্রি বেচার ব্যবসা করে। এসব জায়গার পিছনে টাকা পয়সা ঢালা বোকামি, আর ভর্তি হলেও এসব জায়গার নাম দেখলে ভিসা রিজেক্ট নিশ্চিত। কাজেই শুরুতেই দেখবেন আপনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ভাবছেন সেটির বা সেটিতে আপনার ডিপার্টমেন্টের ডিগ্রি প্রোগ্রামের এক্রেডিটেশন আছে কি না, এবং যে সংস্থা এক্রেডিটেশন দিয়েছে সেটি নিজেই ভুয়া বা দুই নম্বর কী না। ইন্টারনেটে খোঁজ নিন এই ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে কী বলা হয়েছে। মনে রাখবেন, দুইনম্বর অনেক ইউনিভার্সিটির কিন্তু গালভরা নাম থাকে যেমন অমুক ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, তমুক স্টেট ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি। খেয়াল করে খোঁজ নিয়ে দেখুন আসলেই এইটা স্টেইট ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের অংশ কি না। এসব দুই নম্বর জায়গা শুরুতেই বাদ দিয়ে ফেলেন।
আরও পড়ুন: বশেমুরবিপ্রবি ছাত্রীকে ধর্ষণ তালিকায় মাদ্রাসা পড়ুয়া, প্রকৌশল ছাত্রও
কী কী ফ্যাক্টর বিচার করবেন?
ইউনিভার্সিটি নির্বাচনে বেশ কিছু দিক খেয়াল রাখবেন, আসুন দেখা যাক এই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলা কী কী?
১) সুনাম: ইউনিভার্সিটির সুনাম কেমন? সুনামের ব্যাপারটা আসলে আপেক্ষিক, তবে কিছু ইউনিভার্সিটির বনেদি হিসাবে নাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। সুনাম বের করার আরেকটা উপায় হলো র্যাংকিং। নানা সংস্থার পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং করা হয়, এর মধ্যে আছে US News and World Report, টাইমস এডুকেশন, ইত্যাদি। অনেকেই এই র্যাংকিং দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বের করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সমস্যাটা হলো এই রকমের অধিকাংশ র্যাংকিংই আসলে নির্ভরযোগ্য বা কার্যকর না। মানে ধরা যাক কোনো এক র্যাংকিং এ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রম ২৫, আরেকটির ২৭। এর মানে কিন্তু এই না যে প্রথমটির চেয়ে পরেরটি কম মানের। কাজেই কেবল র্যাংকিং দিয়ে ইউনিভার্সিটি নির্ধারণ করা বুদ্ধিমানের কাজ না। র্যাংকিং লিস্টগুলো একটি কাজেই ব্যবহার করতে পারেন, সেটা হলো ইউনিভার্সিটি কোন গ্রুপে পড়ে তা সম্পর্কে মোটামুটি আন্দাজ করা। যেমন, প্রথম ১০ এর মধ্যে আছে, নাকি প্রথম ৫০ এর মধ্যে — এরকম। প্রথম দশ এ থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মোটামুটি নিঃসন্দেহে বিশ্বের সেরা ইউনিভারসিটি। র্যাংকিং এ ১১ থেকে ৫০ এর মধ্যের ইউনিভার্সিটি গুলা মোটামুটি কাছাকাছি মানের, আর ৫১ থেকে পরেরগুলা এর পরের গ্রেডের। সহজ ভাষায় প্রথম ১০টাকে উচ্চবিত্ত্ব, মাঝের ৪০টাকে মধ্যবিত্ত্ব, আর পরের গুলাকে নিম্নবিত্ত্ব ধরতে পারেন। তবে তার মানে এই না যে শেষের গ্রুপের একটা ইউনিভার্সিটি মাঝের গ্রুপের চাইতে একেবারেই কম মানের — আসলে মানের দিক থেকে গ্রুপ ২ ও ৩ এর তফাৎ করাটা কঠিন। কারণ র্যাংকিং ছাড়াও আরো অনেক ফ্যাক্টর দিয়ে ইউনিভার্সিটির মান ধরা হয়। আইভি লীগের যেকোনো ইউনিভার্সিটি যে গ্রুপেই থাকুক না কেন খুবই বনেদি হিসাবে গণ্য ও সারা বিশ্বে সমাদৃত। আবার পরের দিকে কোনো র্যাংকিং এ পড়ে গেলেও অন্য কারণে ইউনিভার্সিটির ডিগ্রির সুনাম থাকতে পারে।
২) ডিপার্টমেন্টের সুনাম: খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ফ্যাক্টর হলো ডিপার্টমেন্টের সুনাম। অনেক সময়ে ইউনিভার্সিটির র্যাংক পিছনে হলেও ঐ ডিপার্টমেন্টের সুনাম থাকতে পারে। ধরা যাক ক বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংক মাঝারি, খ বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংক নিচের দিকে। কিন্তু এটা সত্ত্বেও খ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো বিভাগের নাম ডাক ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নাম ডাকের চাইতে বেশি হতে পারে।
আরও পড়ুন: ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠাবে আমেরিকা-ব্রিটেনসহ ২৮ দেশ
৩) প্রফেসরের সুনাম: বিশেষ করে পিএইচডির ক্ষেত্রে অ্যাডভাইজরের সুনাম খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যাপারটি বুঝবেন কী করে? প্রফেসরের নাম ধরে গুগল সার্চ করে দেখুন কিংবা গুগল স্কলারে প্রফেসরটির পাবলিকেশন স্ট্যাটিস্টিক্স ঘেঁটে দেখুন। নামকরা কারো অধীনে কম র্যাংকের জায়গাতে পিএইচডি করলেও দীর্ঘমেয়াদে সেটা করা ভালো।
৪) খরচ: বিশেষ করে ফান্ডিং না পেলে এই ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে। একেক ইউনিভার্সিটির টিউশন ফি একেক রকমের। পাবলিক ইউনিভার্সিটি যা নানা স্টেটের অর্থে চালিত, তাদের টিউশন ফি কম। আবার প্রাইভেটের বেশি। আমেরিকার দক্ষিণের দিকে টিউশন ফি পশ্চিমের দিকের ইউনিভার্সিটির চাইতে কম। ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে গেলে টিউশন ফি এর পরিমাণ সহজেই দেখতে পাবেন।
৫) ইউনিভার্সিটির অবস্থান: ইউনিভার্সিটির অবস্থানটাও একটা বড় ব্যাপার। আমেরিকার অনেক ইউনিভার্সিটি বড় শহরের মাঝে অবস্থিত, আবার অনেক ইউনিভার্সিটি প্রত্যন্ত এলাকার খুব ছোট্ট এক শহরের মধ্যে অবস্থিত। অনেক সময়ে ইউনিভার্সিটি যেখানে আছে সেখানে হয়তো ইউনিভার্সিটি ছাড়া আর কিছুই নাই। বড় শহরে হলে যাতায়াত, রেস্টুরেন্ট, যোগাযোগ ব্যবস্থা সহ অনেক বড় সুবিধা পাওয়া যায়। ঐ শহরেই হয়তো এয়ারপোর্ট আছে যার ফলে অন্যত্র যাওয়া সহজ। কিন্তু সমস্যাটা হলো বড় শহরে বাসা ভাড়াটাও বেশি হতে পারে। ক্যাম্পাস থেকে দূরে থাকলে যাতায়াতে সময় লাগতে পারে, আবার অনেক সময়ে গাড়ি চালিয়ে যেতে হবে, গাড়ির ইন্সুরেন্স সহ অন্যান্য খরচ মিলে অনেক বেশি পড়তে পারে। ছোট ক্যাম্পাস টাউন বা কলেজ টাউন জাতীয় জায়গা অনেক সময়ে এমন হয় যে তার আসেপাশে কিছুই হয়তো নাই। আমার পিএইচডির বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয়ের ক্যাম্পাস ছিলো আরবানা-শ্যাম্পেইন নামের দুই যমজ শহর জুড়ে। গুগল ম্যাপে জুম করলেই দেখতে পাবেন তার আশে পাশে আসলে ভুট্টা ক্ষেত ছাড়া কিছুই নাই — কাছের বড় শহর শিকাগো থেকে ওটা প্রায় আড়াই ঘণ্টার ড্রাইভ দূরে। এরকম জায়গায় বাসা ভাড়া সস্তা হয়, খাবার দাবারও হয়তো কম দামের হতে পারে। কিন্তু অনেক কিছুই যেমন দেশী খাবার দাবারের দোকান, দেশী মুদীর দোকান, এসবের কোনটাই নাও থাকতে পারে। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে এসব শহরে করার মতো কাজ খুব বেশি থাকেও না।
আরও পড়ুন: স্বপ্নের ঢাবি এখন দুঃস্বপ্ন
ইউনিভার্সিটির অবস্থানের আরেকটি দিক হলো কাজের সুযোগ — পড়ার সময়ে বা পাস করার পরে। বড় শহরে অফ ক্যাম্পাস কাজ, ইন্টার্নশিপ, কিংবা পাস করার পর চাকুরির সুযোগ — সবই অনেক বেশি। পক্ষান্তরে ছোট শহরে স্থানীয়ভাবে কাজের সুযোগ কম, ফলে পাস করার পরে দূরে যেতে হবে নির্ঘাত। সেজন্য ইউনিভার্সিটিটা কোথায় অবস্থিত, কাছে ধারে বড় শহর কোথায়, সেটা অবশ্যই ঠিকমত দেখে নিবেন।
৬) গরম ঠাণ্ডা — আবহাওয়া: আমরা বাংলাদেশের মতো গরম দেশের মানুষ — তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে গেলেই জমে যাই, তাই না? আমি অন্তত এক সময়ে সেরকমই ছিলাম। আমেরিকার একটা বড় ব্যাপার হলো এটি একটি মহাদেশ — উত্তর আমেরিকার একুল ওকুল জুড়ে থাকা একটা বিশাল দেশ, ফলে এর নানা জায়গায় জলবায়ুর বৈচিত্র্য অনেক বেশি। উত্তরের দিকে বেজায় ঠাণ্ডা, এতো ঠান্ডা যে কল্পনার বাইরে — আমার মনে আছে একদিন বাইরে খটখটে রোদ দেখে খুশি হয়ে বেরিয়ে টের পেলাম, তাপমাত্রা তখন -৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো (ছাপার ভুল না, এটা মাইনাস তিরিশ!!)। নিঃশ্বাস ফেলার সাথে সাথে সেটা বরফ হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনেই। ঠাণ্ডা জায়গায় অনেকেই টিকতে পারেন না, কাজেই ইউনিভার্সিটির অবস্থান কোথায়, সেখানকার আবহাওয়া কী রকম, গুগল করে বা উইকি থেকে দেখে নিন।
বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নেয়ার পদ্ধতি
তো, এতো সব ফ্যাক্টর বিচার করার পরে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নিবেন? এই ক্ষেত্রে আসলে আপনার নিজের প্রোফাইল বিচার করতে হবে। আপনার প্রোফাইল যদি ভালো হয়, মানে ধরুন বাংলাদেশের নামকরা ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যাচেলর্স, ভালো সিজিপিএ, দুই এক খান পাবলিকেশন, ভালো টোফেল জিআরই স্কোর, এসব যদি থাকে, তাহলে প্রথম শ্রেণীর ইউনিভারসিটিতে আবেদন করবেন। যদি আপনার সবকিছুর অবস্থা মধ্যবিত্ত টাইপের হয় মানে মাঝারি জিপিএ, পেপার নাই, মোটামুটি টোফেল জিআরই স্কোর, তাহলে জোর দিবেন মধ্যম মানের ইউনিভার্সিটির উপরে। আর সবকিছুর অবস্থা নিচের দিকে হলে নিচের দিকের ইউনিভার্সিটিতেই বেশি আবেদন করেন। নিজের অবস্থা যদি নিজে না বুঝেন তাহলে অনলাইনে বা ফেইসবুকে ভর্তি সংক্রান্ত নানা গ্রুপে পোস্ট করে অন্যদের পরামর্শ চান — অনেক সময়েই এইসব গ্রুপের অন্যান্য সদস্যরা আপনার প্রোফাইল দেখে অভিমত দিতে পারবেন। আরেকটা উপায় হলো যেখানে ভর্তি হতে চান, সেখানকার বর্তমান শিক্ষার্থীদের সাইটে গিয়ে তাদের সিভি বের করে দেখেন, আপনার প্রোফাইল কি সেই মাপের কি না।
আরও পড়ুন: ইউক্রেনের তরুণীদের দিকে ‘নজর’ দিয়েছে রুশ সেনারা
২০-৬০-২০ রুল: ভর্তির আবেদন করার সময়ে মোটামুটি ভাবে এভাবে ইউনিভার্সিটি বেছে নিন — ২০% আপনার লেভেলের উপরে, ৬০% আপনার লেভেলে, আর ২০% আপনার লেভেলের নিচে। মানে যদি আপনি মনে করেন আপনার অবস্থা মোটামুটি মাঝারির দিকে, তাহলে লাক ট্রাই করার জন্য হলেও ২০% ভালো মানের ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করেন, ৬০% আপনার যেখানে চান্স ভালো, সেসব জায়গায়, আর এপ্লাই করলেই চান্স পাবেন নিশ্চিত এমন ২০% জায়গায়। যদি ১০টা ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করেন, তাহলে ২টা খুব ভালোতে চান্স নেন, ৬টা আপনার চান্স ভালো এমন জায়গায়, আর ২টা অন্তত শিওর এডমিশন এমন জায়গায়।
আরেকটা বড় ফ্যাক্টর হলো ভর্তির আবেদনের ফি — অধিকাংশ ইউনিভার্সিতিতে ৫০ থেকে ১০০ ডলারের মতো ভর্তির আবেদন ফি লাগে। একটু কষ্ট হলেও যত বেশি সংখ্যক জায়গায় পারেন, এপ্লাই করবেন। মনে রাখবেন, আপনি যদি ভর্তি বা ফান্ডিং পান, তাহলে এই টাকার হাজার গুণ ফেরত পাবেন ভবিষ্যতে, কাজেই যতদূর পারেন এপ্লাই করেন।
কিছু কিছু ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির আবেদনের ফি লাগে না। গুগল সার্চ করে এসব ইউনিভার্সিটির তালিকা বের করে নিন এবং অবশ্যই এসব জায়গায় আবেদন করুন, কারণ হারাবার তো কিছুই নাই।
(এই লেখাটি ‘আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা’ বই থেকে নেয়া একটি অধ্যায়। বইটি পাবেন একুশে বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনীর স্টলে, ৩৩৩-৩৩৬, মুক্তমঞ্চ ও লিটল ম্যাগ চত্বরের পূর্ব এবং শিশুচত্বরের উত্তর-পশ্চিম দিকে।)
লেখক- সহযোগী অধ্যাপক, দ্য ইউনিভার্সিটি অব অ্যালবামা এ্যট বার্মিংহাম