মেডিকেলে সুযোগ পেয়েছে মেয়ে, খরচ জোগাতে চিন্তায় ভ্যানচালক বাবা

মেয়ে, মা ও বাবা
মেয়ে, মা ও বাবা   © টিডিসি ফটো

ভ্যানচালক আফতাবর রহমান। অভাবের সংসার। তবুও স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। দু’চোখ জুড়ে নিরন্তর স্বপ্ন। তবে সেই স্বপ্ন কোন উচ্চ বিলাসী স্বপ্ন নয়। স্বপ্ন সন্তানদের মানবিক মানুষ হিসেবে গড়া। এর মধ্যে দুই মেয়ে উচ্চশিক্ষায় আলোকিত করেছেন তিনি। সমাজে নতুন নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপনের তালিকায় প্রথম সারিতেই থাকবেন তিনি।

একমাত্র ছেলে মুন্না আলী প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন। মেয়ে আলপনা আক্তার সদ্য প্রকাশিত মেডিকেল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। সুযোগ পেয়েছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তির।

আফতাবর রহমান ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বড় পলাশবাড়ী ইউনিয়নের ধারিয়া বেলসাড়া গ্রামের বাসিন্দা। সম্পদ বলতে নিজের ভিটেমাটি আর ভ্যান।

ভ্যানচালক আফতাবর রহমান ইতোমধ্যেই বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী। ছোট পরিবার, আয় কম। তিন ছেলেমেয়ের পড়াশোনা নিয়ে কিছুটা বিপাকেই পরেছেন তিনি। মেয়ের মেডিকেলে পড়ানোর খরচ তার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।

সরেজমিনে তার বাসায় গিয়ে দেখা গেল, সকালেই তিনি ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে গেছেন। দেখা মিললো ইউনিয়নের কুশলডাঙ্গী বাজারে। জানালেন সন্তানদের এতদূর চলার গল্প।

আফতাবর রহমান জানান, ভ্যান চালিয়েই ছেলেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও মেয়ে দু’টোকে পড়াচ্ছি। ছেলে মুন্নার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় ২৫ শতক আবাদি জমির মধ্যে ৫ শতক জমি বিক্রি করে দিয়েছি। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে অর্থের জোগান দিতে বাকি ২০ শতাংশ জমিও বিক্রি করতে হয়েছে। ছেলেকে প্রতিমাসে ৩-৪ হাজার টাকা পাঠাতে হয়। বাকি দুই মেয়ের পড়াশোনা ও সাংসারিক খরচের একমাত্র আয়ের উৎস ভ্যানটি। একদিন ভ্যান নিয়ে না বের হলেই সংসারে টানাপোড়ন পড়ে। 

তিনি আরও জানান, দুই সন্তান মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনায় ডাচবাংলা ব্যাংক থেকে শিক্ষাবৃত্তি পেয়েছিল। এই শিক্ষাবৃত্তি পরিবারের কষ্ট অনেকটাই লাঘব করছে। মেয়েকে ভর্তির টাকা জোগাতে গতকাল বুধবার তিনি নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে আলাপ করেছেন। কেউ কেউ ভর্তির টাকা জোগাড় করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।

তিনি আরও জানান, বাজারে নিত্য পণ্যের দাম বেড়েছে। চিন্তা ভর্তির পরের খরচ নিয়ে। আগে ভ্যান চালিয়ে অনেক আয় হতো। কিন্তু এখন থ্রি-হুইলার ও অটোচার্জারের ভিড়ে ভ্যানে তেমন যাত্রী মেলে না।

আরও পড়ুন : মেডিকেলে চান্স পেয়েছি, কিন্তু পরিবারের পড়ানোর সচ্ছলতা নেই: জেলেপল্লীর মারুফা

স্ত্রী মাজেদা খাতুন জানান, রক্তের শেষবিন্দু থাকা পর্যন্ত সহযোগিতা নেব না। সন্তানদের পড়ালেখার খরচ চালিয়ে যাবো। তবে মানবিক কারণে কেউ যদি সহযোগিতার হাত বাড়ান, তাহলে তা নেবো।

আলপনা উপজেলার কুশডাঙ্গী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মুন্না কুশলডাঙ্গী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং সমিরউদ্দিন স্মৃতি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের ধাপ শেষ করেছেন।

বাবার স্বপ্ন পূরণের ইচ্ছা রয়েছে আলপনার। তিনি জানান, বাবা অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করাচ্ছেন। চিকিৎসক হয়ে বাবা, মাসহ অসহায় মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখবো। বাবার স্বপ্ন পূরণে সকলের কাছে দোয়া চান তিনি।

সমিরউদ্দিন স্মৃতি মহ্যাবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বেলাল রব্বানী জানান, অনেক অভিভাবক এখনো মেয়েদের বোঝা বলে মনে করেন। সামর্থ্য থাকার পরও পড়ালেখা না করিয়ে বিয়ে দিয়ে দায়ভার থেকে মুক্তি নেন। এমন একটা পরিবেশের মধ্যেও ভ্যানচালক বাবা তার দুই সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন, যা বাস্তব হতে চলেছে। এটা আমাদের জন্য বড় পাওয়ার। এমন বাবার আদর্শ ধারণ করা উচিত সকল বাবাদের।

বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যোবায়ের হোসেন জানান, ওই ভ্যানচালক বাবা চাইলে তার সন্তানদের পড়ালেখার ব্যয় বহনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হবে।


সর্বশেষ সংবাদ