জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সিজিপিএ ২.৯৪, ‘টুয়েলভ ফেল’ সাদিকুর হচ্ছেন বিসিএস ক্যাডার
- সিয়াম হাসান
- প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ১০:২৩ AM , আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:২৯ PM
৪৩তম বিসিএসের ক্যাডার ও নন-ক্যাডারে ২ হাজার ৮০৫ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। এতে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন ময়মনসিংহের ত্রিশালের সাদিকুর রহমান রাহাত। দ্বাদশ শ্রেণিতে ফেল এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ এর নিচে সিজিপিএ পেয়েও তার বিসিএস ক্যাডার হওয়ার গল্প যেন সিনেমা-নাটককেও হার মানায়।
সাদিকুরের বাবা শওকত আলী পেশায় শিক্ষক ছিলেন। এলাকায় শওকত আলী মাস্টার নামে পরিচিত। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে বড় বোনের নাম শারফুন্নাহার বিউটি। ছোটবেলায় বড় বোনই তাকে পড়ালেখায় সহায়তা করতেন। তিনি সাখুয়া উচ্চ বিদ্যালয় জিপিএ ৪.৮৮ নিয়ে এসএসসি পাস করেন। পরে ত্রিশালের নজরুল ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হন। তবে ২০১০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে করে বসেন ফেল।
পরবর্তীতে ২০১১ সালে জিপিএ-২.৯০ নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। জিপিএ কম থাকায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি দূরের কথা, ফর্মও তুলতে পারেননি। অবশেষে এ জিপিএ নিয়ে আবেদন করেন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে। প্রথম চয়েজে কিছু না আসলেও দ্বিতীয়বার ভর্তি হন বাংলা বিভাগে। পড়াশোনার মধ্যেই জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করেন সাদিকুর রহমান। এরপর ২০১৭ সালে সিজিপিএ ২.৯৪ নিয়ে অনার্স শেষ করেন। দুঃখের সময় পাশে থেকে এ সফলতায় অন্যতম কারণ তার স্ত্রী। তাদের এক ছেলে ও মেয়ে রয়েছে।
সাদিকুর প্রথম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহাকারী শিক্ষক হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। পরে প্রথম ৪১তম বিসিএসে অংশগ্রহণ করেন নন-ক্যাডারে বাংলার ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। অবশেষে ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। এর পেছেনের কঠিন চড়াই-উৎরাইয়ের গল্প দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন তিনি।
তিনি বলছিলেন, ২০০৪ সালে ৫ম শ্রেণিতে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেওয়ার পর রোল ৮০ নিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলাম। তখন ইংরেজি কোনও শব্দই পড়তে পারতাম না। গণিত শুধু যোগ-বিয়োগ পারতাম। বড় বোনের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় আমার কঠোর পরিশ্রম। ফলে ৭ম শ্রেণিতে রোল ২ হয়।
৮ম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে যান সাদিকুর। পরবর্তীতে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রথম ছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় এসএসসি পরীক্ষায় সাখুয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৮ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৪.৮৮ নিয়ে পাশ করেন। ত্রিশাল নজরুল কলেজে ভর্তি হন। হাইস্কুল জীবনের তার সেরা শিক্ষক হযরত আলী। তার প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা তার।
২০১০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে করে বসেন ফেল। পরবর্তীতে ২০১১ সালে জিপিএ-২.৯০ নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। জিপিএ কম থাকায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি দূরের কথা, ফর্মও তুলতে পারেননি। অবশেষে এ জিপিএ নিয়ে আবেদন করেন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে। প্রথম চয়েজে কিছু না আসলেও দ্বিতীয়বার ভর্তি হন বাংলা বিভাগে। ২০১৫ সালে সিজিপিএ ২.৯৪ নিয়ে অনার্স শেষ করেন।
এইচএসসি পরীক্ষায় ফেল করার পর কীভাবে ঘুরে দাঁড়ালেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন,২০১০ সালের জুলাই মাসে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিন নিশ্চিত ফেল ধরে নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে বাবাকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়েন কোম্পানিতে চাকরি করার জন্য। ফলাফল প্রকাশিত হলে দেখেন, দু’বিষয়ে (পদার্থ বিজ্ঞান ও গণিত) ফেল। চলে যান ফুফাতো ভাইয়ের কাছে। কিন্তু দু’দিনের বেশি টিকতে পারেননি।
কলেজে প্রথমবার ফেল করে বাড়িতেই ভবঘুরে জীবনযাপন করতে থাকেন সাদিকুর। ফলাফল দেখে মা অনেক কান্নাকাটি করেছিলেন। বাবাও অনেক হতাশ হয়ে পড়েন। কারণ বাবা কলেজ লাইফের দু’বছর নিজে রান্নাবান্না করে দিতেন। তার উনার সুনামও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। ২০১১ সালে প্রতিজ্ঞা করেন, যে করেই হোক পাস করতেই হবে। এ বছর জিপিএ ২.৯০ নিয়ে পাস করেন।
কোনও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরম তোলার যোগ্যতা সাদিকুরের ছিল না। বাধ্য হয়েই আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দেন। প্রথম চয়েজ লিস্টে নাম না আসায় হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। দ্বিতীয় চয়েজ লিস্টে যখন বাংলা বিভাগে চান্স পেলেন, সেদিন খুশিতে কান্না করেছিলেন। অনার্স তৃতীয় বর্ষে নিজের হাত খরচ চালানো ও বাবার ওপর চাপ কমানোর জন্য প্রথমে একটি দোকানের সেলসম্যান হিসেবে তিনমাস চাকরি করেন। পরে স্পিনিং মিলে চাকরি শুরু করেন সুপারভাইজার পদে।
সেখানে তিন-চার মাস চাকরি করার পর অনার্স তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা চলে আসায় চাকরি ছেড়ে দেন। তৃতীয় বর্ষের লিখিত শেষ হবার পরই জীবনে ট্রাজেডি ঘটে যায়। মানসিক সমস্যায় পড়লে সাত-আট মাস চিকিৎসা চলে। এ সময়ে সাপোর্ট দিয়েছেন চাচা সাইদুজ্জামান (মানিক), শফিকুল ইসলাম, নবী হোসেন, দুলাভাই ওয়াহিদুজ্জামান ও চাচাতো ভাইয়েরা। এদিকে আমার অনার্স তৃতীয় বর্ষের ভাইভা পরীক্ষা চলে যায়, দিতে পারেননি। পরবর্তীতে গাজীপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাইভা দিয়ে পাস করেন।
তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালটা আমার জন্য ছিল বিশেষ। কারণ ২০১৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আমি বিয়ে করি। ২০১৬ সালে ঘরে প্রথম পুত্র সন্তান সাদাফ রহমান লিসানের জন্ম হয়। ২০১৭ সালে অনার্সে সিজিপিএ ২.৯৪ নিয়ে পাস করি। সে বছর বাবা একটু আর্থিক সংকটে পড়ে যান। আমার বড় ভাই বাক্ প্রতিবন্ধী। তার সংসার খরচ ও মায়ের চিকিৎসা খরচ বাবাকে বহন করতে হতো। তখন বাধ্য হয়েই আমি একটি কোচিং সেন্টারে যোগ দিই। পরবর্তীতে চকরামপুর বাজার আমজাদ আলী মডেল স্কুল থেকে মাসিক ৩ হাজার টাকা বেতনে চাকরির অফার পাই। আমার পরিবার নিয়ে সেখানে চলে যাই।’
এরপর থেকে আসল জীবন যুদ্ধ শুরু হয় জানিয়ে সাদিকুর আরও বলেন, সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত টিউশনি করতাম। ১১ থেকে ৪টা পর্যন্ত স্কুল। সাড়ে ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত হোম টিউশন। সন্ধ্যার পর এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়তাম যে, বই নিয়ে বসার মতো ধৈর্য বা শক্তি কোনটাই থাকত না। তবুও আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। এ সময়ে আমাকে সাপোর্ট দিয়েছে সহধর্মিণী। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ২৫ তারিখ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। আমি সুপারিশ প্রাপ্ত হই। সে রাত আমার জীবনের সেরা রাত ছিল।’
আরো পড়ুন: আমার ছেলে বিসিএস ক্যাডার, বাবা চিৎকার করে সবাইকে বলছিলেন
২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে বিসিএস প্রস্তুতি স্থবির হয়ে পড়ে সাদিকুরের। ২০২১ সালের শেষ দিক থেকে পুরোদমে বিসিএস যাত্রা শুরু করেন। ৪১তম বিসিএসে প্রথমবার প্রিলিমিনারি পাশ করে পরে নন-ক্যাডারে ইন্সট্রাক্টর (বাংলা) পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। ২০২২ সালের ১৪ এপ্রিল মেয়ে সাদিকা আফসান রোশার জন্ম হয়। ২০২৩ সালে ৪৩তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। বিসিএস যাত্রায় পাশে বন্ধুর মতো ছিলেন সহধর্মিণী। পুরো সময়েই তার ডেডিকেশন ছিল অন্য রকম।
অনুভূতি জানতে চাইলে সাদিকুর বলেন, ‘আমার অনুভূতি আসলে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যদিও আমি এটাকে চূড়ান্ত সফলতা মনে করি না। আমি যেদিন দেশ ও জাতির জন্য ভালো কিছু করতে পারব, সেদিন নিজেকে সফল মনে করব। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত টুয়েলভথ ফেল সিনেমাটি আমি দেখেছি। নিজের সঙ্গে মিল পেয়ে ভীষণ ভালো লেগেছে। আমিও তো উচ্চ মাধ্যমিকে ফেল করেছিলাম। যদিও তেমন মেধাবী নই। কিন্তু আমার জীবনের গল্পও কখনো কখনো সিনেমার মতোই মনে হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘মনোজের মতোই আমার জীবনেও বড় ভূমিকা রেখেছে জীবনসঙ্গী। মনোজ যেমন অসৎ উপায়ে পাস করতে চায়নি, আমিও। মনোজ যেমন আটার মিলে কাজের পাশাপাশি পড়ত, আমিও টিউশনি করে, স্কুলে পড়িয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছি। তবে সবচেয়ে বড় মিল বোধ হয় একটাই—আমরা হাল ছাড়িনি। আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যারা চেনেন, তারা জানেন কতটা কণ্টকাকীর্ণ পথ আমাকে পাড়ি দিতে হয়েছে।’
তার ভাষ্য, ‘আমার জীবন যুদ্ধের গল্পটিতে শিক্ষণীয় বিষয় হলো, জীবনে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে হতাশ না হয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে কিভাবে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। আমি খুবই স্বল্প মেধাবী ও অল্প জ্ঞানের অধিকারী। আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন। মানুষের ভালোবাসা ও দোয়া নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।’