শাওন ক্যাডার না হলেই বরং সবাই বেশি অবাক হত
৪৩তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাওন রেজা। পুলিশ ক্যাডারে তার অবস্থান সপ্তম। এক সময় ভাবতেন, দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে স্থায়ী হবেন। যদিও পারিবারিক নানা কারণে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হয়েছে তাকে। নিতে হয়েছে বিসিএসের প্রস্তুতি। চাকরির পড়াশোনার পাশাপাশি কোচিং পেশার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন শাওন। বেশকিছু কোচিংয়ে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। স্বভাবতই একসঙ্গে শিক্ষকতা ও বিসিএস প্রস্তুতি নেওয়াটা তার কাছে চ্যালেঞ্জিং ছিল। তবে তিনি পেরেছেন এবং সফল হয়েছেন। সম্প্রতি শাওন নিজের সাফল্যের গল্প নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের মুখোমুখি হয়েছেন। তার কথাগুলো শুনেছেন— তাওফিকুল ইসলাম হিমেল
৪৩তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। এমন সাফল্যে আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
শাওন রেজা : বিসিএস একটা সিম্পল চাকরির পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। তবে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এটাকে সবাই একটু আলাদা করে দেখেন। সেই পরীক্ষায় ভালো করায় বাঁধভাঙা উল্লাস থাকার কথা ছিল। তবে আমার ক্ষেত্রে এর চেয়ে স্বস্তি বেশি কাজ করেছে। আমাকে যারা ব্যক্তিগতভাবে চেনেন, তারা জানতেন আমি বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছি। সবাই ধরেই নিয়েছিল আমি নিশ্চিত ক্যাডার হব। ব্যাপারটা এমন, আমি যদি ক্যাডার হতে না পারতাম এটাতেই সবাই বেশি অবাক হতেন। এজন্য যে রেজাল্ট এসেছে আমি তাতে খুশি। সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা।
আপনার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বলুন।
শাওন রেজা : আমার স্কুল ছিল বাগেরহাট মোল্লাহাটের কচুড়িয়া বাজার এইচএসএমএম হাইস্কুল। পরে নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। অনার্স-মাস্টার্স জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ থেকে।
কখন থেকে বিসিএস প্রস্তুতি শুরু করেছেন, অনুপ্রেরণা কে ছিল?
শাওন রেজা : ইদানিং অনেকে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েই বিসিএস প্রস্তুতি শুরু করেন। তবে আমি মাস্টার্স পাস করার পর থেকে শুরু করেছি। কারণটা বলি… বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় আমি একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম— বুয়েটে ভর্তি হব নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে সব কিছু বিবেচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হই।
তখন চিন্তা করতাম, এখান থেকে পড়াশোনা করে দেশের বাইরে চলে যাব। প্রথম দুই বছর আমার এ ধরনেরই চিন্তাই ছিল। বিসিএস বা এ ধরনের কিছু তখনও মাথায় আসেনি। তারপর কিছু পারিবারিক ইস্যুর কারণে পরিকল্পনায় পরিবর্তন আসে। দেশে থাকার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু তখনও আমি বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করিনি। মাস্টার্সে থাকাকালীন বিসিএস দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
সিদ্ধান্ত স্থির করলেও তখনও আমার প্রস্তুতি শুরু হয়নি। কারণ ২টা একসাথে চালাতে চাইনি। মাস্টার্স শেষ করার পর প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। তবে আমার এমন চিন্তাভাবনাও ছিল না যে, বিসিএস ক্যাডার হতেই হবে। সবসময় এমন কিছু চিন্তা করেছি যে, আমি একটি জার্নিতে নেমেছি। এই জার্নি আমাকে শেষ করতে হবে। সেটা বিসিএস হোক বা অন্য কিছু। আর আমার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে আমার পরিবার ও আমার বাবা-মা।
আরও পড়ুন: পুলিশ ক্যাডারে প্রথম হয়েছি, আর বিসিএস দেয়ার ইচ্ছা নেই
প্রস্তুতির সময়টা কেমন ছিল? আপনি যেহেতু কোচিং পেশায় যুক্ত ছিলেন সেক্ষেত্রে পড়াশোনা সময়টা কীভাবে বের করতেন?
শাওন রেজা : হ্যাঁ, এটা ঠিক। আসলে আমাকে অনেক কিছু মেইনটেইন করতে হয়েছে। আমার একটা ফেসবুক পেজ, ফেসবুক গ্রুপ, ইউটিউব চ্যানেল আছে। এগুলোতে বেশ সময় দিতে হয়। এছাড়া আমি অনলাইন এবং অফলাইন মিলে অনেকগুলো ব্যাচ পড়াই। সেখানেও অনেক সময় আর এনার্জি দিতে হয়।
তবে আমি বিশ্বাস করি, কেউ যদি ফেসবুক-ইউটিউব স্ক্রলিং, র্যান্ডম চ্যাটিং, রিলস, স্টোরি এই টাইপের জিনিস থেকে দূরে থাকে; তবে তার হাতে যথেষ্ট সময় থাকে। কেউ যদি বলে কাজের পরে আমার হাতে সময় নেই, এটি একটি অজুহাত মাত্র। এখানে ইচ্ছেশক্তিই আসল। হ্যাঁ, সব মেইনটেইন করে পড়াশোনা করতে বেশ কষ্ট করতে হয়েছে। তবে এটা অসম্ভব কিছু না। কাজের বাইরের সময়গুলোকে একটা রুটিনের মধ্যে দিয়ে কাজে লাগাতে হবে।
এর বাইরে প্রস্তুতির বিশেষ কোনো টেকনিক ছিল কিনা, কোন বিষয়টি আপনাকে প্রস্তুতি এগিয়ে রেখেছিল বলে মনে করেন?
শাওন রেজা : আমি আমার জীবনে যতগুলো পরীক্ষা দিয়েছি, তার মধ্যে বিসিএসের পরীক্ষা ছিল সব থেকে এনার্জি কনজিউমিংয়ের ছিল। আর এটি যেহেতু একটি লং প্রসেস, এখানে অধিকাংশ প্রার্থী অনেক হতাশ হয়ে যান। সেখান থেকে ফিরে আসা অনেক কঠিন হয়। এখানে মেধার চেয়ে ধৈর্য বেশি লাগে। যারা বিসিএস দিয়েছেন অধিকাংশই আমার সাথে একমত পোষণ করবেন। অর্থাৎ ধৈর্য ধরে লেগে থাকতে হবে। এটাই এখানে ম্যাজিক।
বিসিএসের জন্য পড়তে হবে অনেক, এটা ঠিক আছে। কিন্তু আমি আমার আশেপাশে অনেক মানুষজনকে দেখেছি, তারা কিছু ভুল স্ট্রাটেজি অনুসরণ করেন। যেমন কোন একটা টপিক যখন তারা পড়েন; তারা শুধু ইনফরমেশন মুখস্ত করেন। মানে বিভিন্ন বইয়ে শুধু যে ইনফরমেশন আছে সেটা মুখস্থ করেন। যেমন ঢাকা কতবার রাজধানী হয়েছে, কত সালের রাজধানী হয়েছে এমন টাইপ। কিন্তু এভাবে না পড়ে যদি ঢাকা সম্পর্কে একটা বিবৃতি পড়া যায়, তখন সবকিছু রিলেট করা যায় এবং পরে কিছু প্রশ্ন প্র্যাকটিস করলে তথ্যগুলো আরও ভালোভাবে দখলে নেওয়া যায়। সেটা অনেকদিন মাথায় থাকে।
এছাড়া অনেকে চিন্তা করেন আগে প্রিলি পাস করি, পরে রিটেন নিয়ে ভাববো। এটাও ঠিক না। প্রিলি পাস করলে আপনি ক্যাডার হয়ে যাবেন না। রিটেন পরীক্ষাটাই এখানে আসল। এজন্য শুরু থেকেই রিটেন নিয়ে ভাবতে হবে। অর্থাৎ প্রিলির জন্য একটু বিস্তারিত পড়াশোনা করলে সেটা রিটেনে বেশ কাজে দেয়।
রিটেনের ক্ষেত্রে আমাদের অধিকাংশ পরীক্ষার্থীরা বিগত বছরে আসা প্রশ্নগুলো সরাসরি মুখস্ত করেন। আসলে এভাবে রিটেনের প্রস্তুতি ভালোভাবে হয় না। রিটেনে আসলে শিক্ষকরা যেটা দেখেন তা হলো শুরুটা লেখা কেমন আর শেষের লেখা কেমন। কী পরিমাণ ডাটা সেখানে রয়েছে। আমি এখানে আসলে একটি স্ট্রাটেজি অনুসরণ করেছিলাম। কিছু টপিক যেমন, দেশের উন্নতি, সমস্যা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মুক্তিযুদ্ধ, রাষ্ট্রব্যবস্থা—এমন আরও কমন কিছু টপিকের ওপর সুন্দর করে ‘বিগিনিং আর এন্ডিং’ তৈরি করেছিলাম। যেটা লেখার মান আরও বাড়িয়েছে। এছাড়া প্রাসঙ্গিক প্রশ্নে সংবিধানের ধারা অ্যাড করলেও লেখার মান বাড়ে। এর বাইরে ড্যাটা, পাই চার্ট, বার চার্ট, গ্রাফ এগুলো তো ছিলই।
পরিবারে কে কে আছেন?
শাওন রেজা : আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচজন। বাবা-মা, আমি, আমার ছোট ভাই এবং বড় বোন। আমার বড় বোন মাস্টার্স শেষ করেছেন। আর আমার ছোট ভাই স্কুলে পড়াশোনা করছে।
ক্যাডার চয়েজ সম্পর্কে বলুন। আপনি কীভাবে দিয়েছিলেন? কোন কোন বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে ক্যাডার চয়েজ দেওয়া উচিত।
শাওন রেজা : আমার চয়েজ লিস্ট ছিল ফরেন, পুলিশ, অ্যাডমিন, কাস্টমস, ট্যাক্স। বিসিএসের সব জবই যেহেতু প্রেস্টিজিয়াস, তাই যার যেটা ভালো লাগে সে সেটা আগে দেবে। আমার ইউনিফর্ম জব পছন্দ। এজন্য পুলিশ দ্বিতীয়তে রেখেছি। এছাড়া আমার একটু ফিটনেস ফ্যান্টাসিও আছে। তাই এক্ষেত্রে পুলিশ ট্রেনিংটা আমার অনেক কাজে দেবে।
যারা বিসিএস দিতে চান, তাদের প্রতি পরামর্শ কী থাকবে?
শাওন রেজা: বিসিএস পরীক্ষা দিলে ক্যাডার হওয়ার জন্য দিন। শুধুমাত্র প্রিলিমিনারি পাস করার জন্য বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে তো লাভ নেই। আগে প্রিলি পাস করে তারপর রিটেন তারপর ভাইবার জন্য আলাদা প্রিপারেশন নেওয়াটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এভাবে প্রিপারেশন নিয়ে আসলে ভালো করা সম্ভব নয়।
তবে প্রিলিমিনারি পরীক্ষাটাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু এটার ফলাফল দুই মাসের মধ্যে দিয়ে দেওয়া হয়। তাই কেউ প্রিলিতে ভালো স্কোর না করলে তার রিটেনের প্রস্তুতির নিতে মোটিভেশন থাকে না। আর ২টার বেশি বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার দরকার নেই। সর্বোচ্চ চেষ্টা করে ২টা দিয়েও যদি না হয় তাহলে পরেরগুলো দিয়ে সময়টা নষ্ট করার তো মানে নেই। অনেকে ৪-৫টা বিসিএস দিয়ে লাইফের এই প্রাইম টাইমটা নষ্ট করে। পরে অনুশোচনা হয়।
চাকরিপ্রার্থীদের বিসিএসকে একমাত্র লক্ষ্য বানানো কি ঠিক?
শাওন রেজা : যেহেতু বিসিএস পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের অনেক লম্বা এবং কঠিন প্রসেসের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তাই সবারই উচিত অল্টারনেটিভ প্ল্যান থাকা। আর বিসিএসকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য না বানানো। যেমন আমি যদি আমার কথাই বলি, আমার বিসিএসের প্রস্তুতির পাশাপাশি অন্যান্য বিভিন্ন কাজ ছিল। তবে আমি আমার আশেপাশের এমন অনেক বড় ভাইকে দেখেছি, যারা শুধুমাত্র বিসিএস নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। দিনশেষে যখন বিসিএস হয়নি, তখন তাদের উভয় দিকেই সবকিছু হারিয়ে গেছে।
আমার সবার প্রতি সাজেশন থাকবে, বিসিএস প্রস্তুতির পাশাপাশি তাদের যেন অল্টারনেটিভ কর্মসংস্থানের ব্যাকআপ রাখতে হবে। যেহেতু বিসিএস আমাদের দেশের আর্থসামাজিক দিক থেকে অনেক সম্মানজনক চাকরি, তাই অনেকে এদিকে আসতে চায়। আসলে আমি সবাইকে বলব, যারা এদিকে আসতে চান এই বিষয়টা কতটুকু লং প্রসেস, কেমন হবে সবকিছু জেনে যেনো এদিকে আসবেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই।
শাওন রেজা : বেশিদিন হয়নি রেজাল্ট প্রকাশিত হয়েছে। আমার এখনো সে ধরনের কোন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেই। এখনো এই মোমেন্টটা উপভোগ করছি। পরেরটা পরে দেখা যাবে।