গণঅভ্যুত্থানে শহীদের কথা

মায়ের ওড়না মাথায় বেঁধে আন্দোলনে যান শ্রাবণ, ফেরেন লাশ হয়ে

ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ
ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ  © সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৪ আগস্ট বিকেলে ফেনীর মহিপালে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী গুলিতে প্রাণ হারান ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ। তিনি ফেনী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করে ভর্তি পরীক্ষা জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আন্দোলনে না যেতে একমাত্র ছেলেকে বারবার বারণ করেছিলেন মা ফাতেমা আক্তার শিউলি ও বাবা নেছার আহম্মদ। 

শ্রাবণের মা ফাতেমা আক্তার শিউলি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ৩ আগস্ট একটু অস্থির আচরণ করছিল। রাত তিনটায় উঠে আমার কক্ষে এসে আমাকে ডাকে, কিছু কথা বলে আবার চলে যায়। সে বলে, তার ভাত খেতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু সে খায়নি। তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে এবং পরবর্তীতে ফজরের নামাজ পড়ে সে ঘুমায়। সেটিই আমার সাথে তার শেষ কথা ছিল।

অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে শ্রাবণের মা বলেন, আন্দোলনে যাওয়ার সময় আমার একটি ওড়না মাথায় বেঁধে রাখত এবং তার নিজের নাম লেখা একটি জার্সি পরে যেত। আন্দোলনে যেতে বারণ করার পরও সে সে প্রতিদিন আন্দোলন অংশ নিতে চলে যেত। আন্দোলন যেতে বারণ করার পর উত্তরে সে বলে এখনই সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার। 

বাবা নেছার আহম্মদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শ্রাবণ ৪ আগস্টে বেলা ১১টায় নাস্তা করে ঘর থেকে বের হয়। ওইদিন তাকে নিষেধ করা হয়েছিল বাইরে না যাওয়ার জন্য। সে তখন বলে আমি যাবো না, বাসার নিচে যাচ্ছি আবার চলে আসব। 

কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাবা নেছার আহম্মদ বলেন, আর তার বাসায় আসা হলো না। আন্দোলন যেতে নিষেধ করার পর, সে তার মাকে বলে আমি যদি আন্দোলন না যাই, আমার ভাইদের যেভাবে মেরে ফেলতেছে, যেভাবে তাদের রক্ত ঝরাচ্ছে এটা তো তাদের সাথে বেইমানি করা হবে। আমি যদি বাসায় মারা যাই তখন তুমি কি করবা, আমি আন্দোলন যেতে চাই দেশের জন্য, জাতির জন্য ও সুশাসনের জন্য। 

e1c9177b-4129-4270-8cdf-ec352cf5ce8d

৪ আগস্টের কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ওইদিন দুপুরে কল আসে শ্রাবণ গুলি খেয়েছে। আন্দোলনে যেতে নিষেধ করার পরও গিয়েছে সেটি ভেবে তখন খুব রাগান্বিত হয়েছিলাম। কিন্তু বাবা হিসেবে মন তো মানে না। তখনই তার মা এবং খালাকে নিয়ে খোঁজ নিতে বের হয়েছিলাম কিন্তু অবস্থা এমন ছিল কোনো দিকে যেতে পারছিলাম না। তখন খবর আসে ফেনী সদর হাসপাতালে শ্রাবণ। তখন সেখানে গিয়ে দেখি সে আর নেই। 

অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মা শিউলি বলেন, ৪ আগস্টে আমার শ্রাবণের বন্ধু মাহফুজ তার লাশ নিয়ে এসেছিল। স্থানীয় কিছু মানুষরূপী শয়তান তাড়াহুড়ো করে আমার ছেলেকে দাফন করতে চেয়েছিল। আমি আমার শ্রাবণকে একটু আদর করতে চেয়েছি, তার মুখটা আরও কিছু সময় দেখতে চেয়েছি। কিন্তু তারা সেই সুযোগ আমাকে দেয়নি। আমার ছেলেকে আমার কাছেও রাখতে দেয়নি।

শ্রাবণের বন্ধুরা জানান, ফেনীতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শ্রাবণ ছিল নিয়মিত মুখ। সে প্রতিদিন আন্দোলন অংশ নিত আমাদের সাথে। তারা আরও বলেন, গত ৪ আগস্ট সরকার পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনের অবস্থান কর্মসূচিতে মহিপালে অংশ নেন শ্রাবণ। আনুমানিক দুপুর ২টার দিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নির্মমভাবে গুলি চালায় শিক্ষার্থীদের ওপর। এসময় একটি গুলি এসে লাগে শ্রাবণের বুকে। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। 

শ্রাবণের বন্ধু মো. রাশেদুল ইসলাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আন্দোলনের সময় শ্রাবণ আমাদের ফেনী পাইলট হাই স্কুলের আন্দোলনকারীদের সুসংগঠিত করার দায়িত্ব পালন করেছিল। আন্দোলনকারীরা ঠিকমতো আসছে কিনা, কেউ আহত হয়েছে কিনা, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়গুলো সে তদারকি করত। ৪ আগস্টের কথা স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, সেদিন শ্রাবণের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমরা একে অপরকে সাবধানে এবং নিরাপদে থাকতে বলেছিলাম।

আরও পড়ুন: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে প্রেম, অতঃপর বিয়ে

উল্লেখ্য, শ্রাবণ ২০০৪ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ২০২৩ সালে ফেনী সরকারি কলেজ হতে এইচএসসি পাশ করেন। উচ্চশিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি তরুণ সংগঠক এবং ক্রিকেটার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বাবা মায়ের সাথে শহরের বারাহীপুরে বাস করতেন। তার পৈত্রিক বাড়ি ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর ইউনিয়নে। তিন ভাইবোনের মধ্যে শ্রাবণ সবার বড় এবং পরিবারের একমাত্র ছেলে।


সর্বশেষ সংবাদ